নারী-শিশু নির্যাতন মামলা

আইনের মারপ্যাঁচে প্রমাণ করা আরও কঠিন

ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোয় ১৫ বছরে যৌনপীড়নের কম মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। কিন্তু ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগগুলো টেকেনি। আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলাগুলোরও প্রায় একই হাল।

পুলিশ কর্মকর্তা, সরকারি কৌঁসুলিসহ (পিপি) বিভিন্ন পক্ষের কেউ কেউ বলেছেন, দুটি অভিযোগেই অনেক মিথ্যা মামলা হচ্ছে। তবে অনেকের মতে, সমস্যাটা আসলে সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকার।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় যৌনপীড়নের যে ব্যাখ্যা, তাতে অধরা আর জটিল কিছু ব্যাপার আছে। সবার আগে এর পেছনে পীড়নকারীর অবৈধভাবে ‘যৌন কামনা চরিতার্থ করার’ উদ্দেশ্য থাকতে হবে। এই উদ্দেশ্যে শরীরের কোনো অঙ্গ বা কোনো বস্তু দিয়ে কোনো নারী বা শিশুর যৌনাঙ্গ বা অন্য অঙ্গ স্পর্শ করতে হবে। অথবা নারীর ‘শ্লীলতাহানি’ করতে হবে।

আইনে শ্লীলতাহানির কোনো ব্যাখ্যা নেই। আইনটি ২০০০ সালের। তখন আলাদা উপধারায় ‘যৌন হয়রানি’ হিসেবে ‘শ্লীলতাহানি’র পাশাপাশি অশোভন অঙ্গভঙ্গির কথা বলা ছিল। ২০০৩ সালের সংশোধনীতে উপধারাটি বাদ পড়ে।

উদ্দেশ্য আর শ্লীলতাহানি তো বটেই, অঙ্গ ছোঁয়া হয়েছে কি না, সেটাও প্রমাণ করা খুব কঠিন। কেউ যখন কুকামনা নিয়ে কোনো নারী বা শিশুর শরীরে হাত দেন, তার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী দুর্লভ। ডাক্তারি পরীক্ষায় এর আলামত পাওয়ার উপায় নেই, যদি না কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকে।

সাবেক পিপি আরফান উদ্দিন খান নারী-শিশু নির্যাতন মামলা পরিচালনা করছেন অন্তত ২০ বছর। তিনি বলছেন, যৌনপীড়নের অভিযোগে যেসব মামলা হচ্ছে, তা আইনের শর্তগুলো পূরণ করে না। মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাও হচ্ছে অনেক।

তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারটির (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তারের মতটি ভিন্ন। তিনি বলছেন, এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে বিজ্ঞানভিত্তিক আলামত আর প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর অভাব, ‘একজন নারী রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, কেউ তাঁর ওড়না ধরে টান দিল বা শ্লীলতাহানি করল। তখন তিনি মামলা করতে গেলে বলবে, ঘটনা যে ঘটেছে, তার প্রমাণ কী?’

আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলার সমস্যাটি একই ধরনের। সে ক্ষেত্রে ডাক্তারি পরীক্ষায় আত্মহত্যার প্রমাণ হয়তো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আত্মহত্যাকারীকে কেউ প্ররোচিত করেছে কি না, তার প্রমাণ কী? তার ওপর আইন বলছে, এই প্ররোচনা হতে হবে কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া তাঁর ‘সম্ভ্রমহানি করা’র প্রত্যক্ষ কারণে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনি সহায়তা ইউনিটের পরিচালক মাকছুদা আখতার বলছেন, কখনো হয়তো চিরকুট, আগের নিপীড়নের জিডি, সালিসের ঘটনা অথবা প্রত্যক্ষদর্শী শিশুসন্তান থাকে। কিন্তু এ রকম কিছু না থাকলে আত্মহত্যায় প্ররোচনা প্রমাণ করা কঠিন।

যৌনপীড়নের প্রমাণ-অপ্রমাণ
প্রথম আলোর দেখা প্রায় আট হাজার মামলার মধ্যে ধর্ষণসংক্রান্ত তিনটি অপরাধের মামলা সবচেয়ে বেশি। তারপরেই আছে যৌনপীড়নের মামলা (১ হাজার ৮৮৫)।

পাঁচটি ট্রাইব্যুনালের বিচারিক নিবন্ধন খাতা থেকে ২০০৮ সালে ৯৮টি যৌনপীড়নের মামলা আসার তথ্য পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংখ্যাটি দুই শর কাছাকাছি হয়েছিল।

মামলাগুলোর বড় অংশেরই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সাজার হার মাত্র ১ শতাংশ। প্রায় অর্ধেক মামলা বিচারে যাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়নি, আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন। আরও প্রায় অর্ধেক বিচারে গেছে, কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। আসামিরা খালাস পেয়েছেন।

ঘটনা কে দেখেছে, ঠিক কী দেখেছে-এ প্রশ্নগুলো বড়। বিশেষ করে যৌনপীড়নের সঙ্গে যখন সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির অভিযোগ মিলেমিশে আসে, তখন।

২০১২ সালে মামার সঙ্গে মুগদা এলাকায় থাকতেন একজন অভিনেত্রী। আগস্টের এক মধ্যরাতে কাজ শেষে সহকর্মী অভিনেতা তাঁকে মোড়ে নামিয়ে দেন। মামা সেদিন বাইরে ছিলেন, চাবি ছিল সামনের দোকানে। আর দোকানটি ছিল বন্ধ।

মেয়েটি সহকর্মীকে ফোন করলে তিনি ফেরত গিয়ে দারোয়ানসহ তালা খোলার চেষ্টা করেন। তালা খোলে না। দারোয়ান মেয়েটিকে নিজের পরিবারের কাছে রাখেন। আর রাত অনেক হয়েছে বলে ছেলেটিকে নিচতলার একটি ঘরে থাকতে দেন।

ঘণ্টাখানেক পর মেয়েটির নাম ধরে চিৎকার করতে করতে চার যুবক ওই বাসায় হামলা করেন। তাঁরা ছেলেটিকে মারধর করেন। মেয়েটিকে খুঁজে বের করে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামান, তাঁর গায়ে হাত দেন। তিনি ‘খারাপ কাজ’ করেন বলে মাসিক ১০ হাজার টাকা চাঁদা চান।

তারপর উত্ত্যক্তকারীরা তাঁদের টাকা, ছেলেটির হাতঘড়ি ও এটিএম কার্ড নিয়ে চলে যান। তাঁরা আগেও রাতে বাড়ি ফেরার পথে মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করতেন।

এসব অভিযোগ এনে ১১ দিন পর ছেলেটি মামলা করেন। ট্রাইব্যুনাল-৫-এ চারজন উত্ত্যক্তকারীর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হলে ওই ছেলে ও মেয়েটি এবং তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সাক্ষ্য দেন। আরও সাক্ষ্য দেন দারোয়ান ও আরেক ভাড়াটে। দুজনই বলেন, চিৎকার-চেঁচামেচি শুনেছেন কিন্তু কাউকে দেখেননি, আসামিদের চেনেন না। অতঃপর ২০১৬ সালের মাঝামাঝি আসামিরা বেকসুর খালাস পান।

কখনো হয়তো পীড়নের ডাক্তারি প্রমাণপত্র থাকে। কিন্তু মামলা ঝুলে গেলে অভিযোগকারী, ভুক্তভোগী বা সাক্ষীদের আদালতে আনা কঠিন হয়ে পড়ে।

২০১৩ সালের অক্টোবরে এক গৃহকর্মী (১৪) রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় গৃহকর্তা ও কর্ত্রীর বিরুদ্ধে যৌনপীড়ন, তাতে সহায়তা এবং মারধর-ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে মামলা করে। এজাহারে মেয়েটি বলে, এক ভোরে গৃহকর্তা তার গায়ে হাত দিলে এবং ‘খারাপ কাজ’ করতে নিলে তার ঘুম ভেঙে যায়।

মেয়েটির চিৎকারে গৃহকর্তা সরে পড়লে গৃহকর্ত্রী এসে তাকে মারধর করেন। দুই দিন পর রাতে স্ত্রীর সহায়তায় স্বামী আবারও তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। সকালে মেয়েটি পালিয়ে যায় এবং পরে মামলা করে। আসামিরা গ্রেপ্তার হন। ডাক্তারি পরীক্ষায় মেয়েটির গায়ে একাধিক জখমের আলামত পাওয়া যায়। পুলিশ ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিযোগপত্র দেয়। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল-৪-এ বিচার শুরু হয় ২০১৬ সালের আগস্টে।

তার এক আত্মীয় বলছেন, মেয়েটি আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন শুনানি হয়নি। এখন তার বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হয়েছে। মামলার শুনানির তারিখ কবে তা তাঁরা জানেন না।

গত বছর মুগদা থানার একটি যৌনপীড়নের মামলায় ট্রাইব্যুনাল-৫ পঞ্চাশোর্ধ্ব মো. সেলিমকে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন। সেলিম একটি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে ছুটির সময় অভিভাবকদের ভিড়ে মিশে থেকে মেয়েদের গায়ে হাত দিতেন।

মামলাটির অনুকূলে অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল। ২০১৩ সালে প্রধান শিক্ষিকা অন্য শিক্ষকদের নিয়ে সেলিমকে হাতেনাতে ধরে থানায় সোপর্দ করে মামলা করেন। সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তিনি এবং একাধিক ভুক্তভোগী।

প্ররোচনার প্রমাণ?
প্রথম আলো আত্মহত্যায় প্ররোচনার ১৩০টি মামলা দেখেছে। তার মধ্যে ৭২টি নিষ্পত্তি হয়েছে। মাত্র ২ টিতে সাজা হয়। অর্ধেকের বেশি মামলায় আসামিরা খালাস পান, বাকিগুলোতে অব্যাহতি। চলমান মামলাগুলোর প্রতি ৫ টিতে ১টি ১০ থেকে ১৪ বছর ধরে ঝুলে ছিল।

শ্যামলীতে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেছিল ১৩ বছর বয়সী এক মেধাবী স্কুলছাত্রী। মেয়েটির চাচা দুজনের বিরুদ্ধে মেয়েটিকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন।

মামলার নথিপত্র বলছে, এলাকার এক যুবক মো. মুরাদ হোসেন মেয়েটিকে পথেঘাটে উত্ত্যক্ত করতেন। এ কাজে তাঁর দোসর ছিলেন যৌথ পরিবারটির ভাড়া বাসার দারোয়ান মো. আবুল কালাম।

ঘটনার দিন পাড়ার ওষুধের দোকানে মুরাদ মেয়েটিকে থাপ্পড় মারেন, হাত ধরে টানাহ্যাঁচড়া করেন। সবাই তা নিয়ে হাসাহাসি করেন। মেয়েটি ঘরে ফিরে স্কুলের খাতায় দাদির উদ্দেশে এই বিবরণ লিখে রেখে আত্মহত্যা করে।

মেয়েটি লেখে, ‘আমার জন্য যাতে তোমাদের মানসম্মান না যায়, তার জন্য আমি ফাঁসি দিলাম। আমার মৃত্যুর জন্য আমার পরিবারের কেহ দায়ী না।’

পাঁচ মাসের মাথায় ট্রাইব্যুনাল-৪ মুরাদকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে অভিযুক্ত করেন। কালাম অভিযুক্ত হন তাঁকে সহযোগিতার দায়ে। প্রায় আট বছর হলো মামলাটি চলছে। এজাহারকারী চাচা সাংবাদিক আলী আশরাফ আখন্দ প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটির বাবাসহ তাঁরা তিন ভাই অনেক আগেই সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ এত বছরেও বাকি সাক্ষীদের হাজির করেনি।

আসামিরা ঘটনার পরপর গ্রেপ্তার হন, দ্রুত জামিনও পান। মামলার তারিখ পড়লে তাঁরা হাজিরা দিচ্ছেন। তবে তারিখই পড়ছে কম। চলতি মাসের গোড়ায় আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে কয়েক বছর দফায় দফায় বিচারকের সংকট ছিল। ভারপ্রাপ্ত বিচারক শুধু সাক্ষী হাজিরের জন্য সময় মঞ্জুর করে তারিখ ফেলে গেছেন।

আশরাফ বলেন, এখন বিচারক এসেছেন কিন্তু শেষ শুনানির পর প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়েছে। এখনো পিপি তাঁকে পরবর্তী তারিখ জানাতে পারেননি। গত ১৫ দিনে তিনি তিনবার পিপি আর সহকারী পিপিকে (এপিপি) ফোন করেছেন।

পিপি ফোরকান মিঞা ঢাকা সিটি দক্ষিণের আওয়ামী লীগের নেতা। আশরাফ বলেন, (পিপি) এখন খুব ব্যস্ত। উনি সময় দিতে পারেন না, এপিপিরাও ডেট দিতে পারলেন না। পিপিরা বলেছেন, অনেক মামলা ঝুলে আছে। করার কিছু নেই।

আশরাফ বলেন, প্রধান আসামি মুরাদ স্থানীয় সাংসদের (এমপি) ‘দেশের লোক’। মুরাদ গ্রেপ্তার হলে তাঁর স্বজনেরা এমপিকে বুঝিয়েছিলেন, ছেলেটি যুবলীগ করেন। অধুনালুপ্ত বাংলার বাণী পত্রিকায় ওই এমপির সহকর্মী থাকার সুবাদে আশরাফ তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। তখন ‘রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া’ সরে যায়।

কিন্তু মামলা ঝুলে থাকা আর সাক্ষী হাজির না করার সমস্যা দূর হয়নি। আদালত সাক্ষীদের সমন পাঠালে তাঁদের নির্দিষ্ট তারিখে শুনানির জন্য হাজির করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার। সমন পেলে সাধারণ মানুষ ভয় পান যে তাঁকে কোনো মামলায় অভিযুক্ত করা হলো কি না। আশরাফের অভিযোগ, পুলিশ আশ্বস্ত না করে ‘কথা আছে’ বলে থানায় ডাকে। অনেককে ডেকে নিয়ে সেখানে পয়সাপাতির একটা ব্যবসা করে।

তাঁর সাক্ষীদের হাজির করার ব্যাপারে তাগাদা দিতে বছর দেড়-দুই আগে আশরাফ নিজে থানায় গিয়েছিলেন। তখন একজন সহকারী উপপরিদর্শক তাঁর কাছে সাক্ষীদের সমন পৌঁছানোর জন্য যাতায়াতের খরচাপাতি চেয়েছিলেন।

আশরাফ বলছেন, ‘সাংবাদিক পরিচয় আর যোগাযোগ না থাকলে এই মামলা বোধ হয় অনেক আগেই ঝরে যেত।’

সালিস-বিচারে অপমানিত হয়ে কেউ আত্মহত্যা করলে প্ররোচনার দায়ে মামলা হতে পারে। ধামরাই থানায় ১২ বছর আগে এমন একটি মামলা হয়েছিল। ৩ নম্বর ট্রাইব্যুনালে মামলাটি এখনো চলছে।

আবার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা অল্পবয়সী এক পোশাকশ্রমিকের সঙ্গে স্থানীয় এক সেলুনমালিকের সম্পর্ক ছিল। ২০১১ সালে আগস্টের এক সকালে লোকটির ঘরে একত্রে পেয়ে স্থানীয় লোকজন তাঁদের আটকে রাখেন। পরে মেয়েটিকে মেরেধরে বের করে দেওয়া হয়।

দুপুরে সালিস বসে। সালিসকারীরা মেয়েটিকেই দোষী সাব্যস্ত করেন। সন্ধ্যায় তিনি আত্মহত্যা করেন। মা মোহাম্মদপুর থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা করেন। মা অভিযোগ করেন, সালিসকারীরা টাকা খেয়ে তাঁর মেয়েকে ও তাঁকে চরিত্র তুলে গালাগাল করেছিলেন। তিনি বলেন, সেলুনমালিক তাঁর মেয়েকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

ট্রাইব্যুনাল-৪ সেলুনমালিক ও আটজন সালিসকারীকে অভিযুক্ত করেন। মেয়েটির মাসহ চারজন আত্মীয় সাক্ষ্য দেন। মা পাল্টি খেয়ে সাক্ষ্যে বলেন, বাসাবাড়িতে কাজ করে ঘরে ফিরে দেখেছেন, মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কেন, তা জানেন না। তিনি ‘পুলিশের কথায়’ সাদা কাগজে সই করেছেন, এজাহারে কী লেখা আছে, জানেন না এবং ‘আসামিরা সম্পূর্ণ নির্দোষ’।

অন্য স্বজনেরাও একই রকম সাক্ষ্য দেন। তাঁদের কাউকে আসামিপক্ষের আইনজীবী জেরা করেননি। রাষ্ট্রপক্ষের পিপিও তাঁদের বৈরী ঘোষণা করেননি। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিচারক তাঁর রায়ে এসব সাক্ষ্যের বরাতে আসামিদের বেকসুর খালাস দেন।

তদন্ত ও মামলা পরিচালনায় অদক্ষতা-গাফিলতি-দুর্নীতি, আপস-আঁতাত বা আদালতে মামলার চাপের মতো সমস্যাগুলো তো আছেই। আত্মহত্যায় প্ররোচনা বা যৌনপীড়নের ক্ষেত্রে আইনের শর্তের ঘোরপ্যাঁচ অভিযোগ প্রমাণের কাজটিকে প্রায় দুঃসাধ্য করে তোলে।

>

একনজরে অনুসন্ধান
ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গুরুতর ছয় অপরাধে আসা ৭৮৬৪টি মামলার বিচার পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর বিশ্লেষণ
*মামলার সময়কাল: প্রায় ১৫ বছর (জানুয়ারি ২০০২ থেকে অক্টোবর ২০১৬)
*ছয়টি অপরাধ: ধর্ষণ, গণধর্ষণ (মৃত্যু-হত্যাসহ), ধর্ষণজনিত মৃত্যু ও হত্যা, আত্মহত্যার প্ররোচনা, যৌনপীড়ন এবং যৌতুকের জন্য হত্যা বা হত্যাচেষ্টা
*নিষ্পত্তি: ৪২৭৭টি (৫৪ শতাংশ)
*নিষ্পন্ন মামলার মধ্যে সাজা: ১১০টি (৩ শতাংশ)
*চলমান মামলা: ৩৫৮৭টি (৪৬ শতাংশ)
*১০ থেকে ১৪ বছর চলেছে: যৌতুকের জন্য হত্যার ২২ শতাংশ, ধর্ষণজনিত মৃত্যুর ২১ শতাংশ, আত্মহত্যায় প্ররোচনার ২০ শতাংশ, গণধর্ষণের ১৭ শতাংশ, যৌনপীড়নের ৮ শতাংশ এবং ধর্ষণের ৭ শতাংশ মামলা
*কোন অভিযোগে কত মামলা: ধর্ষণ-সংক্রান্ত তিন অপরাধ: ৫৫০২টি (৭০ শতাংশ), ১৩ টিতে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগও ছিল। যৌনপীড়ন: ১৮৮৫টি (২৪ শতাংশ)। যৌতুকের জন্য হত্যা বা হত্যাচেষ্টা: ৩৫৪টি (৪ দশমিক ৫ শতাংশ)। আত্মহত্যায় প্ররোচনা: ১১৭টি (১ দশমিক ৫ শতাংশ)। এ ছাড়া ফৌজদারি দণ্ডবিধির হত্যার ধারাযুক্ত মামলা ৬টি
*তথ্যসূত্র: ট্রাইব্যুনালের বিচারিক নিবন্ধন খাতা
*তথ্য সংগ্রহ, যাচাই ও বিশ্লেষণের সময়: আগস্ট ২০১৬ থেকে অক্টোবর ২০১৭

প্রথম আলোর নিবিড় অনুসন্ধান: ৬৫টি মামলা
*ধর্ষণ: ১৮টি, ধর্ষণে মৃত্যু-হত্যা: ৮ টি, গণধর্ষণ (হত্যাসহ) : ২৬টি, আত্মহত্যায় প্ররোচনা: ৫টি, যৌনপীড়ন: ৩টি, যৌতুকের জন্য হত্যা: ৫টি
*সাজা: ৫টি, খালাস: ৩৪টি, চলমান: ১৫টি, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অব্যাহতি: ১১টি (গৃহীত ৫টি)
*ভুক্তভোগীদের আর্থসামাজিক অবস্থা-নিম্নবিত্ত: ৫১ জন, নিম্নমধ্যবিত্ত: ৬ জন, মধ্যবিত্ত: ৭ জন, উচ্চবিত্ত: ১ জন
*অনুসন্ধানের সময়কাল: আগস্ট ২০১৭ থেকে এপ্রিল­­ ২০১৮

আরও পড়ুন...
প্রমাণ না হলে কিসের হত্যা?
নারী ও শিশুরা বিচার পায় না
কাঠগড়ায় পিপি ও পুলিশ
ধর্ষণের বিচারে নারীর সামনে পদে পদে বাধা
অনেকেই মামলা করতে চায় না