আপিল বিভাগের রায়

আইনটির কথা ভুলে গেছেন বিচারক

তুচ্ছ ঘটনায় সংশোধনমূলক সাজা না দিয়ে আসামিকে কারাগারে পাঠানোয় সর্বোচ্চ আদালতের হতাশা।

সুপ্রিম কোর্ট
ফাইল ছবি

তুচ্ছ ঘটনায় সংশোধনমূলক সাজা না দিয়ে আসামিকে কারাগারে পাঠানোয় নিম্ন আদালতের দুই বিচারক সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সংশোধনমূলক সাজার আইন সম্পর্কে ওই বিচারকেরা অবগত কি না, সে সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, ‘আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, বিচারিক আদালতের বিচারক ও আপিল আদালতের বিচারক সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছেন যে আমাদের দেশে দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ নামে একটি আইন আছে।’

নূর মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তির করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের ভার্চ্যুয়াল আপিল বেঞ্চ গত ২৮ জানুয়ারি এ রায় দেন। বাংলায় লেখা আট পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

রায়ে বলা হয়, যখনই বিচারক আসামিকে (নূর মোহাম্মদ) দোষী সাব্যস্ত করলেন, তখনই উচিত ছিল দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০–এর ৫ ধারা বিবেচনা করা।

উল্লেখ্য, প্রবেশন বলতে কোনো অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি স্থগিত রেখে, কারাবদ্ধ না রেখে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ প্রদান করাকে বোঝায়। প্রবেশন ব্যবস্থায় প্রথম ও লঘু অপরাধে আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে বা সংস্পর্শে আসা শিশু-কিশোরেরা বা অন্য কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাক্তিকে প্রথম ও লঘু অপরাধের দায়ে কারাগারে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে না রেখে আদালতের নির্দেশে প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে এবং শর্ত সাপেক্ষে তার পরিবার ও সামাজিক পরিবেশে রেখে কৃত অপরাধের সংশোধন এবং তাকে সামাজিকভাবে একীভূতকরণের সুযোগ দেওয়া হয়।

প্রবেশন বলতে কোনো অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি স্থগিত রেখে, কারাবদ্ধ না রেখে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ প্রদান করাকে বোঝায়।

রায়ে বলা হয়, মামলার বিষয়বস্তু থেকে প্রতীয়মান হয় যে ঘটনাটি ঘটেছিল দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে। এসব ক্ষেত্রে আসামিকে এক বছরের জন্য জেলে না পাঠিয়ে প্রবেশনে রাখা সমীচীন ছিল। যেহেতু দণ্ডবিধির ৩২৩ ও ৩২৫ ধারা আপসযোগ্য অপরাধ এবং দুই পক্ষ হচ্ছে পরস্পর আত্মীয়/প্রতিবেশী, কাজেই মামলাটির আপস মীমাংসা যুক্তিযুক্ত ছিল।

আপিল বিভাগ রায়ে বলেছেন, বাংলাদেশের ৬২ শতাংশের বেশি লোক গ্রামাঞ্চলে বাস করেন। যেখানে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শহরের তুলনায় বেশি এবং তাদের মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদও বেশি হয়। এই মামলার ঘটনা শুরু হয়েছিল খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে।

নথিপত্র থেকে জানা যায়, মারধরের অভিযোগে ১৯৯৪ সালে নূর মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তিকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রথমে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরে গাজীপুরের অতিরিক্ত দায়রা জজ (প্রথম আদালত) আদালত এই রায় দেন। ২০১৭ সালে হাইকোর্টও এই রায় বহাল রাখেন। এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেন নূর মোহাম্মদ। শুনানি শেষে হাইকোর্টের রায় ও আদেশ সংশোধন করে আপিল বিভাগ রায় দেন, যা গতকাল প্রকাশ পায়।

রায়ে বলা হয়, নিম্ন আদালতের দুজন বিচারক এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক—কেউই দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ অথবা আপস মীমাংসার ব্যাপারে চিন্তা করেননি এবং দণ্ড ও সাজা বহাল রাখেন। পূর্বের আদালতগুলোর তিনটি রায় থেকে বোঝা যাচ্ছে না যে বিচারকগণ এই আইনের বিষয়ে আদৌ অবগত আছেন কি না। রায়ের শেষাংশে বলা হয়, ইতিমধ্যে দরখাস্তকারী নূর মোহাম্মদ ৩১ দিন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। অভিমতে আদালত বলেছেন, নূর মোহাম্মদের দোষী সাব্যস্তের আদেশ এবং জরিমানা বহাল থাকবে। তবে তিনি যত দিন কারাভোগ করেছেন, তত দিনই তাঁর দণ্ড হিসেবে গণ্য হবে।

আপিল বিভাগে নূর মোহাম্মদের পক্ষে শুনানিতে থাকা আইনজীবী জয়নুল আবেদিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নূর মোহাম্মদ এ মামলায় জামিনে ছিলেন।

প্রবেশন ব্যবস্থায় লঘু কোনো অপরাধে (প্রথমবার) জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিকে কারাগারে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে না রেখে আদালতের নির্দেশে প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে এবং শর্ত সাপেক্ষে পরিবারের সঙ্গে রেখে কৃত অপরাধের সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়।

আইন ও পরিপত্র

প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্সের কার্যকর প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায় না। কারাগারের ওপর চাপ কমানো এবং ‘সংশোধনমূলক’ সাজার নীতি প্রয়োগে আইনটির বিধান প্রতিপালনে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিচারকদের প্রতি নির্দেশনাসংবলিত পরিপত্র জারি করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এতে বলা হয়, সাজা প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য সংশোধনমূলক, প্রতিহিংসামূলক নয়। সাজা প্রদানের ওই আদর্শিক বিষয় বিবেচনায় রেখে অপরাধীদের বয়স, পূর্বাপর আচার-আচরণ, দৈহিক ও মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে উপর্যুক্ত আইনের বিধানাবলির যথাযথ প্রয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।