সামনে এমন সময় যে তথ্যপ্রযুক্তির (আইটি) জ্ঞান ছাড়া দক্ষতার কথা কল্পনাই করা যাবে না। তাই মৌলিক আইটি জ্ঞান দেওয়ার ব্যবস্থা করা এখন জরুরি। পাশাপাশি জোর দিতে হবে কারিগরি শিক্ষায়। মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে ভবিষ্যতে বিনিয়োগের কথা বললে মূলত দুই খাতেই বিনিয়োগ করতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় প্রথম আলো আয়োজিত ‘অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দক্ষতার উন্নয়নে বিনিয়োগ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম বলেন, আইটি শিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। সরকার এ ব্যাপারে গুরুত্বও দিচ্ছে। তবে কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্যের এই যুগে প্রবৃদ্ধি, অসাম্য হ্রাস ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব দূর—এ তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
শামসুল আলম আরও বলেন, ‘শিক্ষার প্রসার হয়েছে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এই শিক্ষা কতটা বাজার উপযোগী হচ্ছে? বাজার অর্থনীতির এই সময়ে বাজার চায় দক্ষতা, শুধু সনদ নয়। কারিগরি, ব্যবসায়িক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া আমরা এগোতে পারব না।’
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন বলেন, দক্ষতা উন্নয়নে অনেক কাজই চলছে, কিন্তু কাজগুলো সমন্বয়হীন। আবার দক্ষতার জন্য প্রশিক্ষণের কাজ প্রচণ্ডভাবে ওভারলেপিং (একবারের প্রশিক্ষণকে বারবার দেখানো) হচ্ছে। এনএসডিএর বয়স মাত্র ৭ মাস। সব গুছিয়ে আনা হচ্ছে, সমস্যাগুলো কেটে যাবে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দক্ষতা উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল, সেগুলো কেন অর্জন করা গেল না, সেগুলো বের করে অষ্টম বার্ষিক পরিকল্পনায় কাজে লাগানো হবে বলে জানান ফারুক হোসেন।
আইএলওর বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পটিআইনেন বলেন, এই যুগে দক্ষ জনগোষ্ঠীর বিকল্প নেই। এ জন্য চাই প্রশিক্ষণ। আর প্রশিক্ষণের জন্য দরকার কৌশল, বিশেষ করে বাজারভিত্তিক কৌশল। যথাযথ নীতিকৌশল ঠিক করে তা বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মানবসম্পদ উন্নয়নের সূচকের মানদণ্ডের উদাহরণ দিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগে ধরা হতো শিক্ষাকে, এখন ধরা হয় প্রযুক্তি ও দক্ষতাকে। ফলে কেতাবি পড়াশোনার কী হবে, সেই প্রশ্নই এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মৌলিক আইটি শিক্ষা এখন জরুরি। এর অভাবে দক্ষতা আসবে না। তাই এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিও এখন জরুরি। দক্ষতা উন্নয়নে কত টাকা বরাদ্দ রাখা হলো—ভবিষ্যতের বাজেটে তার উল্লেখ থাকা চান তিনি।
বিশ্বব্যাংকের যোগাযোগবিষয়ক পরামর্শক সাজিয়া উমর বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈচিত্র্যময়। ফলে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা এখানে বেশি জরুরি। এখানে নারীরা কাজ করছেন।
ঢাকায় কানাডীয় হাইকমিশনের জ্যেষ্ঠ উন্নয়ন উপদেষ্টা রিফুল জান্নাত বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে জোরালোভাবেই আসে যে দেশে দক্ষ জনগোষ্ঠী দরকার। কিন্তু এ জন্য দরকার দক্ষ শিক্ষক। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে গেলেই শোনা যায় শিক্ষক নেই, শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াও লম্বা। তিনি বলেন, ‘দক্ষতা উন্নয়নে আমরা সহযোগিতা করতে চাই। কিন্তু চালকের আসনে সরকারকেই থাকতে হবে।’
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রকল্প বিশ্লেষক তানিয়া ফেরদৌস বলেন, দক্ষতা উন্নয়নে ভালো মানের একটি ইনস্টিটিউট দরকার। কিন্তু সরকারের দিক থেকে এ কথা বলতে শোনা যায় না।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, তুলনামূলক দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করায় বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের প্রবাসী আয়ের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির পথ তৈরি করতে হবে। আবার শুধু দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করলেই হবে না, দক্ষ উদ্যোক্তাও তৈরি করতে হবে। এ জন্যও দরকার প্রশিক্ষণ। কারণ, একজন দক্ষ ব্যক্তি একটি চাকরি করতে পারেন, একজন উদ্যোক্তা অনেক দক্ষ ব্যক্তির চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেন।
ইউসেপ বাংলাদেশের প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইনোভেশন বিষয়ক পরিচালক দিদারুল আনাম বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখী শিক্ষায় সম্পৃক্ত করতে হবে। তৈরি করতে হবে যুগোপযোগী পাঠপদ্ধতি। এ ছাড়া বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ঊর্ধ্বতন পরিসংখ্যান কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানান, ১৭৩টি দেশে ১ কোটি ২৬ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। ধীরে ধীরে তাঁদের দক্ষতা বাড়ছে।
বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ইইউ বাংলাদেশের শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের দলনেতা হ্যান্স ল্যাম্বব্রেস্ট, ব্র্যাকের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালক আফতাব উদ্দিন আহমেদ, আইএলওর বিশেষ দক্ষতা বিশেষজ্ঞ কিশোর কুমার সিং ও দক্ষতা ২১ প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মানস ভট্টাচার্য।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম এতে স্বাগত বক্তব্য দেন। পুরো বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।