হোলি আর্টিজানে হামলার ৬ বছর

আইএসপন্থীরা সক্রিয় ‘ভার্চ্যুয়াল সেলে’

আইএসপন্থী নব্য জেএমবি মূলত অনলাইনে সক্রিয়। আল-কায়েদাপন্থী আনসার আল ইসলাম অনলাইন ও অফলাইন দুটোতেই তৎপর।

ভয়াবহ জঙ্গি হামলার শিকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি
ফাইল ছবি

গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ছয় বছরের মাথায় এখন দেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো অনেকাংশেই স্তিমিত। গত কয়েক বছর মাঠে জঙ্গিদের সক্রিয়তার তেমন আলামত দৃশ্যমান না হলেও, এই সময়ে অনলাইনে বেশ সক্রিয় রয়েছে। গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় এমন অ্যাপে গ্রুপ খুলে তারা প্রচারণা চালাচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে এসেছে।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও পর্যবেক্ষণে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি সংস্থার বিশ্লেষণ হচ্ছে, ইসলামিক স্টেটপন্থী (আইএস) জঙ্গিরা ২০১৮ সালের পর থেকে বিভিন্ন ‘ভার্চ্যুয়াল সেল’ বা ‘মডিউল’ গড়ে তুলেছে। এসব সেল বা তাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ কেউ ‘লোন উলফ’ (একক বা ছোট গ্রুপ) আক্রমণের মাধ্যমে নাশকতার চেষ্টা করতে পারে। এর আগে ২০১৯ সালে পুলিশকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন স্থানে যেসব বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, তাতে জঙ্গিদের এ ধরনের সেল বা সংগঠিত ছোট গ্রুপ জড়িত ছিল।

তবে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত কর্মকর্তাদের মতে, আইএসপন্থী জঙ্গিদের চেয়ে এখন আল-কায়েদাপন্থী আনসার আল ইসলামকে বেশি বিপজ্জনক মনে করা হচ্ছে। কারণ, ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টানা অভিযানে এ দেশে আইএসপন্থী সংগঠন নব্য জেএমবির সাংগঠনিক ও নেতৃত্বকাঠামো অনেকটা ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

এর শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই নিহত হয়েছেন, অনেকে ধরা পড়েন। কিন্তু আনসার আল ইসলাম সাংগঠনিকভাবে ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সংগঠনটি অনলাইন ও অফলাইন—দুভাবেই সদস্য সংগ্রহ করতে পারছে।

মাঝেমধ্যেই জঙ্গিদের আস্তানা বা সরঞ্জাম উদ্ধারের খবর আসে। বলা যায়, জঙ্গিরা কিছুটা স্তিমিত, কিন্তু অক্ষম হয়ে যায়নি।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রেসিডেন্ট, বিআইপিএসএস
আ ন ম মুনীরুজ্জামান

এর বাইরে দেশের সবচেয়ে পুরোনো জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ (হুজি-বি) এখন মৃতপ্রায়। আর জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ—জেএমবির (পুরোনো জেএমবি) উত্তরাঞ্চল এবং ময়মনসিংহ-জামালপুর অঞ্চলকেন্দ্রিক কিছু সমর্থক গোষ্ঠী থাকলেও সংগঠনটিকে আপাতত বড় হুমকি মনে করছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

তবে জঙ্গিবিষয়ক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, জঙ্গিদের স্তিমিত মনে হলেও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। ‘জঙ্গিরা নিয়ন্ত্রণে আছে’ বলে আত্মতুষ্টিতে পড়লে সেটা বিপদ ডেকে আনতে পারে।

‘অ্যাট্রিশনের যুদ্ধে’ আইএসপন্থীরা

আইএসের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে এমন সূত্রগুলো বলছে, ২০১৯ সালে সিরিয়ায় আইএসের পতনের পর তাদের পরবর্তী প্রচারমূলক আখ্যানটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যাট্রিশনের যুদ্ধ’ বা দীর্ঘস্থায়ী লড়াই। এই আখ্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের সহযোগী ও সমর্থকদের যার যার জায়গায় আক্রমণ পরিচালনার আহ্বান জানানো হয়েছে।

এ দেশেও আইএস মতাদর্শী এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সমর্থক একটি অংশ এই ডাকে সাড়া দিয়ে ছোট ছোট গ্রুপে অনলাইনে বেশ কিছু সেল বা মডিউল তৈরি করতে সক্ষম হয় বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে।

গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মে সদস্য সংগ্রহ বা অনুসারী তৈরির মাধ্যমে তারা একটি ভার্চ্যুয়াল কাঠামো গড়ে তোলে, যা সেল বা মডিউল নামে পরিচিত। এই সেল বা মডিউলগুলোতে কথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দেশের ভেতর নাশকতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সদস্যদের উৎসাহিত করা হয়। তাদের সদস্যরা গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় (এনক্রিপটেড), এমন অ্যাপ ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ পরিচালনা করে থাকে।

২০১৮ সালের পর থেকে তৈরি হওয়া আইএসপন্থী জঙ্গিদের এই ভার্চ্যুয়াল সেলগুলোর লক্ষ্যবস্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা সর্বশেষ ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ও খুলনায় পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা ও বোমা পেতে রাখার ছয়টি ঘটনা ঘটায়।

বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে সময় ও দূরনিয়ন্ত্রিত বোমার (আইইডি) বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। তবে এই গোষ্ঠী এখন বড় ঘটনা ঘটানোর মতো অবস্থায় নেই বলে মনে করেন জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত কর্মকর্তারা। সুযোগ পেলে ‘লোন উলফ’ ধরনের আক্রমণ বা ছোটখাটো ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করতে পারে বলে মনে করা হয়।

আনসার আল ইসলাম

ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসা আনসার আল ইসলাম আল–কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা অর্থাৎ একিউআইএসের বাংলাদেশ শাখা হিসেবে দাবি করে আসছে। শুরুতে সংগঠনটি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে পরিচিত ছিল।

সদস্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে সব কার্যক্রমে সংগঠনটি ‘কাট-আউট’ পদ্ধতি অনুসরণ করে। এতে এক গ্রুপ সম্পর্কে অন্য গ্রুপ জানতে পারে না। যার ফলে কেউ গ্রেপ্তার হলেও পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায় না। এমন কৌশলের কারণে এই সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এখনো অজানা। এ কারণে আনসার আল ইসলামকে একটা হুমকি মনে করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত এ গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তু ব্লগার, তাদের বিবেচনায় নাস্তিক, ধর্ম ও নবীর অবমাননাকারী এবং সমকামী অধিকারকর্মী।

জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত কর্মকর্তাদের মতে, অনেক দিন ধরে আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা কোনো ঘটনা না ঘটালেও তাদের সদস্য সংগ্রহ, সদস্যদের কাছ থেকে সাদাকাহ (চাঁদা) সংগ্রহ এবং অন্যান্য উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ নেই। তারা সাংগঠনিক নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমের কারণে জঙ্গিবাদ এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। নাশকতা বা হামলার কোনো সক্ষমতা এখন জঙ্গিদের নেই। বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ সূচক (গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স) বলছে, জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ দেশ।

বৈশ্বিক থিঙ্কট্যাংক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ সূচক প্রকাশ করে আসছে। সন্ত্রাসবাদী হামলা ও জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এটা করা হয়। ২০২২ সালে প্রকাশিত সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০। খারাপের দিক থেকে শীর্ষে আছে আফগানিস্তান। তারপর ইরাক।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থা ভুটানের, দেশটি আছে ৯৩ নম্বরে। ভারতের অবস্থান ১২, আর পাকিস্তানের অবস্থান ১০। নেপাল (৩৪) ও শ্রীলঙ্কার (২৫) অবস্থানও বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ। ২০২০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে কোনো জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক বছর অপারেশনাল টেররিজম বা হতাহত করার ঘটনা না ঘটলেও সংগঠনগুলো সম্পূর্ণ সক্ষমতা হারিয়েছে, এটা বলা যাবে না।

কারণ, মাঝেমধ্যেই জঙ্গিদের আস্তানা বা সরঞ্জাম উদ্ধারের খবর আসে। বলা যায়, জঙ্গিরা কিছুটা স্তিমিত, কিন্তু অক্ষম হয়ে যায়নি। কোভিডের সময় তাদের অনলাইনে সক্রিয়তা বেড়েছে।

আ ন ম মুনীরুজ্জামানের মতে, ‘আমাদের মধ্যে একটা আত্মতুষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এটা ক্ষতির কারণ হতে পারে। এখনো সজাগ থাকার প্রয়োজন আছে। জঙ্গিবাদ বিস্তৃত হওয়ার মতো পরিস্থিতি শেষ হয়ে যায়নি। এটা বন্ধের জন্য সে ধরনের জাতীয় নীতি-কৌশল দৃশ্যমান নেই। যা কাজ হচ্ছে, অস্থায়ী (অ্যাডহক) ভিত্তিতে হচ্ছে।’