অদম্য মেধাবী

আঁধার ফুঁড়ে আলো হয়ে ফুটলেন তাঁরা

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী তহবিলের আওতায় শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া শোভা রানী ও রনি মোল্লা এবার বুয়েটে ভর্তি হয়েছেন। অপেক্ষা এখন ক্লাস শুরুর। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

বাড়িভাড়া বাকি। তাই ঘরে বাতি জ্বালানো বারণ—বাড়ির মালিকের এই নির্দেশ উপেক্ষা করার উপায় ছিল না তখন। তাঁদের আছে কেবল ভাড়া করা এই ঘর, খুব অন্ধকার। আর কে না জানে, আলো কেবল অন্ধকারেই ফুটে ওঠে। তাই বাতিবন্ধ ঘরের ভেতর পাশের ঘরে জ্বালানো লাইটের আলো মিহি হয়ে ঢুকে পড়ে। সেই আলো আসার পথ বরাবর বই-খাতা নিয়ে বসে পড়েন শোভা রানী। স্বপ্ন দেখেন—অকারণে একদিন খিলখিল হেসে উঠবেন মা, ঘুচে যাবে জীবনের জমে থাকা দেনা। সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি।

অদম্য ইচ্ছার জোরে স্বপ্ন পূরণে অনেক দূর এগিয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী তহবিলের আওতায় শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শোভা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি। শুধু শোভা নন, একই শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে বুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং (ইউআরপি) বিভাগে ভর্তি হয়েছেন নাটোরের রনি মোল্লা। তাঁদের ঘরে এখন কুরচি ফুলের মতো উজ্জ্বল হাসির আলো।

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী তহবিলের আওতায় প্রতিবছর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলের ওপর ভিত্তি করে যথাক্রমে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণিতে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩৬ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। তাঁদের মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহায়তায় ৮১০ জন, অন্যান্য ব্যক্তি ও দাতা সংস্থার সহায়তায় ২২৬ জনকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বৃত্তি পাচ্ছেন ২৫১ জন শিক্ষার্থী। এই অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথমবারের মতো শোভা ও রনি মোল্লা বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেলেন।

স্বপ্নপূরণের পথে রনি

নাটোর সদরের আগদীঘা গ্রামের রনি মোল্লার বাবা আলেক মোল্লা সবজি বিক্রেতা। সবজি বিক্রির টাকায় রনিসহ তিন ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম অবস্থা। কিন্তু হাল ছাড়েননি বাবা ও গৃহিণী মা নুরভানু বেগম। জানিয়ে দিয়েছিলেন, পড়াশোনা করাতে যদি ভিটাবাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়, তা-ও দেবেন; তবু পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। পড়াশোনার জেদ চাপে রনিসহ তিন ছেলের মাথায়। মা-বাবা ঋণ করে পড়াশোনার খরচ চালাতে থাকেন। এভাবেই জিপিএ-৫ নিয়ে ২০১৮ সালে আগদীঘা উচ্চবিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন রনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় চরম অর্থাভাবে পড়েন। আগের ঋণ পরিশোধ হয়নি, তাই নতুন করে ঋণ নেওয়ারও উপায় নেই। দিশাহারা অবস্থায় পড়ে পুরো পরিবার। এ সময় এগিয়ে আসে প্রথম আলো

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি পান রনি। সেই টাকায় নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ২০২০ সালে ওই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পান। এলাকার বুয়েটপড়ুয়া এক বড় ভাইয়ের সান্নিধ্যে থেকে প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু কলেজে পড়ার সময় থেকেই। সুযোগও পেয়ে যান বুয়েটে। বুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং (ইউআরপি) বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। রনির অপেক্ষা ক্লাস শুরুর।

রনি বলেন, ‘আমার জীবনের চরম দুঃসময়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল প্রথম আলো। ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছিলাম বলেই কলেজ পেরিয়ে এখন প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। প্রথম আলো শিখিয়েছে দুঃসময়ে মানুষের পাশে থাকতে হয়। আমি প্রতিষ্ঠিত হলে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব।’

সবার মুখে হাসি ফোটাতে চান শোভা

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের মধ্যপাড়া এলাকার শোভা রানীর জীবনের গল্পটা প্রায় সবার জানা। মায়ের পেটে থাকার সময় বাবা বুলু চন্দ্র লোদকে হারান। জন্মের পর থেকে শোভাকে নিয়ে মা প্রতিমা রানী দাসের সংগ্রাম শুরু। সংগ্রাম শুরু হয় ছোট্ট শোভারও। কারণ, স্বজনদের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে মা-মেয়ে নানা জায়গায় ঘুরেছেন। শেষ পর্যন্ত মেয়ের ভালো হবে—এই চিন্তায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন প্রতিমা। কিন্তু সেখানেও ভাগ্য ফেরেনি। সহ্য করতে হয় স্বামীর নিয়মিত নির্যাতন।

শোভাকে পড়াশোনা করাতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন মা। নামমাত্র মজুরিতে আচারের প্যাকেট ও চকলেট বানানোর কাজ করেছেন তিনি। শোভা নিজে কাজ করেছেন মুদিদোকানে, ছাত্র পড়িয়েছেন। এভাবেই চলেছে মা-মেয়ের সংসার। সব প্রতিকূলতা জয় করে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পান শোভা।

এসএসসি পরীক্ষার সময় ও ফল প্রকাশের কয়েক দিন পর সৎবাবা দুই দফা শোভাকে ঘর থেকে বের করে দেন। নিয়াজ মুহাম্মদ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহিদুল ইসলামের কাছ থেকে এসব জানতে পেরে এগিয়ে আসে প্রথম আলো। ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য মনোনীত হন শোভা রানী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে সহায়তা করেন সহযোগী অধ্যাপক হামজা মাহমুদ। বই-খাতা-কলম দেন প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা।

অশান্তি দেখে বড় হওয়া শোভার মনে হতো, পড়ালেখাই একমাত্র সম্বল। কারণ, ভালো করলে অন্তত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হবে না। তাই যত বাধা এসেছে, পড়ায় তত মন দিয়েছেন তিনি।

শোভা বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে সৎবাবা আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। স্থানীয় একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষকেরা সহায়তা করেন। এসএসসি পর্যন্ত তাঁরা বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। কলেজে কেন্দ্রবিন্দু একাডেমিক কেয়ার বিনা মূল্যে পড়িয়েছে, অর্থসহায়তা দিয়েছে। সঙ্গে প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তি তো ছিলই। তাই সাহস পেয়েছি। ভেঙে পড়েছি অনেকবার, কিন্তু হাল ছাড়িনি।’

এই হাল না ছাড়া শোভা এবার বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ৭২২তম হয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছেন। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যাঁরা একসময় তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরাই এখন আমার খবরে গর্ববোধ করছেন। মায়ের মুখে হাসি ফুটেছে। প্রকৌশলী হয়ে আমার মতো আর সব শোভাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’