কঠোর আইনি ব্যবস্থা, গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার ও বহুমুখী কার্যক্রমের ফলে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা তিন অঙ্ক (ডিজিট) থেকে এক অঙ্কে নেমে এসেছে। গত দেড় যুগের মধ্যে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনার সংখ্যা এখন সবচেয়ে কম। শুধু তা-ই নয়, এই সন্ত্রাসকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার নারীরাও।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০ বছরের মধ্যে ২০০২ সালে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি—৪৯৪টি। চলতি বছরে জুন (ছয় মাসে) পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটেছে আটটি। সেই হিসাবে, ১৮ বছরে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ৯৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ কমেছে।
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সরকারি পর্যায়ে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দুটি শক্ত আইন ও তার প্রয়োগ এই অপরাধ কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার নারী ও শিশু অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় ৬৮৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে শাস্তি হয়েছে মাত্র ৩৩৮ জনের। এই সময়ে মোট মামলা হয়েছে ২ হাজার ১৪৭টি, অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ২৭০টি। এর মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয় ৮৬০টি।
আইনজ্ঞরা বলছেন, অ্যাসিড-সন্ত্রাস কমলেও বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২ অনুযায়ী ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার কথা বলা আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র ৯ শতাংশ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাজা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত একটিও কার্যকর হয়নি।
অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা কমলেও এ অপরাধে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোর প্রতি প্রশাসনের সক্রিয় নজরদারি কমে এসেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অ্যাসিড মামলা তদারক করার জন্য গঠিত জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের তিন মাস পরপর বৈঠক হওয়ার কথা। কিন্তু গত চার বছরে একটি সভাও হয়নি। জেলা কমিটির বৈঠক প্রতি দুই মাসে একবার হওয়ার কথা, তা-ও নিয়মিত হচ্ছে না।
>২০০২ সালে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি—৪৯৪ টি।
চলতি বছরে জুন (ছয় মাসে) পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটেছে আটটি।
১৮ বছরে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ৯৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ কমেছে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি এমন পদক্ষেপ নিতে, যাতে আসামিরা সাজা পায়। আগে অ্যাসিড সহজলভ্য ছিল। যেখানে-সেখানে পাওয়া যেত। সরকার এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ছাড়া কঠোর আইন করা হয়েছ। এর ফলেই মূলত অ্যাসিড-সন্ত্রাস কমে এসেছে।’
সম্মিলিত উদ্যোগের সুফল
অ্যাসিড সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা প্রদান, আইনি সহায়তা, পুনর্বাসন, মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠা এবং অ্যাসিড-সন্ত্রাস নির্মূলের লক্ষ্যে ১৯৯৯ সাল থেকে কাজ করছে অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)। একই লক্ষ্যে ২০০০ সালে গঠিত হয় অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল। এ ছাড়া সারা দেশে সরকার এবং ব্র্যাক, একশনএইডসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা অ্যাসিড সন্ত্রাস মোকাবিলায় একযোগে কাজ করে আসছে।
২০০১ সালে পারিবারিক শত্রুতার জের ধরে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন মারজিয়া আক্তার। এখন তিনি গাজীপুরের কাপাসিয়ার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। অ্যাসিডে তাঁর গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে গিয়েছিল। হাসপাতালের বিছানায় বসেই পড়াশোনা করেছেন। মারজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনকে আমি থামিয়ে রাখতে চাইনি। আমি চেয়েছি আলো ছড়াতে। সেই কাজটিই করছি। আমার এখন ওসব কথা মনে পড়ে না।’
গ্রামীণ চেকের ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন ঝিনাইদহের শামীমা আক্তার। বিয়ের ১১ মাসের মাথায় স্বামী অ্যাসিডে ঝলসে দিয়েছিলেন তাঁকে। তিনি এখনো ডানচোখে দেখতে পান না। শামীমা এর আগে কাজ করেছেন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। কীভাবে তিনি নিজেকে এত দূর নিয়ে এলেন, জানতে চাইলে শামীমা বলেন, ‘আমি বাইরের সৌন্দর্য নিয়ে ভাবিনি। ভেবেছি কিছু একটা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমার স্বপ্নপূরণ হয়েছে। অ্যাসিড আমার স্বপ্ন পোড়াতে পারেনি।’
১৯৯৬ সালে অ্যাসিড সহিংসতার শিকার হওয়ার সময় শামীমা অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। ঘটনার পর তাঁর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল থেকে শামীমাকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। এরপর তিনি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
এভাবে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার অনেক নারী ঘুরে দাঁড়িয়ে জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন। তাঁরা ব্র্যাক, এএসএফ, গ্রামীণ চেকসহ বড় বড় জায়গায় কাজ করছেন। বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় তাঁদের মানসিক শক্তি বেড়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সামন্তলাল সেন ১৯৮৬ সাল থেকে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার মানুষদের নিয়ে কাজ করছেন। এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যখন শুরু হয়, তখন একজন চিকিৎসক হিসেবে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার অসহায় মানুষদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণসচেতনতা অ্যাসিড-সন্ত্রাস কমাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। প্রথম দিকে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের মা ছাড়া পাশে কেউ ছিলেন না। পরে আমরা সারা দেশে অ্যাসিডে আক্রান্ত বহুজনের সাহায্য এবং বিভিন্ন জেলায় সচেতনতামূলক সভা করি।’
অ্যাসিড-সন্ত্রাস ভয়াবহ রূপ নিলে প্রথম আলোর কর্মীদের এক দিনের বেতন ৩২ হাজার টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করে অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল। এই তহবিল থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫৬ জন নারী সহায়তা পেয়েছেন। এর মধ্যে ৩০২ জনকে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ‘আর একটি মুখও যেন অ্যাসিডে ঝলসে না যায়’ অঙ্গীকার নিয়ে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে প্রথম আলো। অ্যাসিড-সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হংকংয়ের ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাব প্রথম আলোকে দ্য গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাওয়ার্ড-২০১০ প্রদান করে।
সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং শিল্পের মাধ্যমে সৃজনশীল যোগাযোগের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৫ সালে র্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার লাভ করেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। এই পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ অ্যাসিড-সন্ত্রাস মোকাবিলায় তাঁর বড় ধরনের ভূমিকা।
অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হওয়া মানুষের জন্য যাঁরা কাজ করে আসছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ইউনিসেফের সাবেক কর্মকর্তা জওশন এ রহমান, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, পারসোনার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কানিজ আলমাস খান, বার্জারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী প্রমুখ।
কীভাবে এক ডিজিটে নেমে এল অ্যাসিড-সন্ত্রাস—জানতে চাইলে এএসএফের সদ্য সাবেক নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৃণমূল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত বিষয়টিকে আন্দোলন হিসেবে নিয়ে অ্যাসিড-সন্ত্রাস কমাতে অনেকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছে। ক্ষমতাবানদের চাপ মোকাবিলায় দুটো কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগও অ্যাসিড সহিংসতা নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া এএসএফের পাশাপাশি গণমাধ্যম, বিশেষ করে প্রথম আলোর এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে। প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের চিকিৎসা-সহায়তা, আইনি সহায়তা ও শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।