হাসপাতালের কর্মচারী ও প্রভাবশালীরা ‘সিন্ডিকেট’ করে বেশি ভাড়া আদায় করেন। ভাড়ার ওপর কমিশনই ২০%। করছাড়ের সুফল নেই।
ঢাকার বড় হাসপাতালের সামনে সার বেঁধে অলস দাঁড়িয়ে থাকে অ্যাম্বুলেন্স। রোগী পরিবহনে চাহিদা যতটা, তার চেয়ে অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা বেশি। কিন্তু রোগী পেলেই ভাড়া হাঁকা হয় অনেক বেশি।
এই করোনাকালেও হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্স না নিয়ে অন্য কোথাও থেকে কম টাকায় ভাড়া করবেন, সে সুযোগ নেই। হাসপাতালকেন্দ্রিক ‘অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট’ রোগীকে বাইরের অ্যাম্বুলেন্সে তুলতেই দেবে না। তাদের এক কথা, অন্য অ্যাম্বুলেন্স নিতে হলে তাদের টাকা দিতে হবে।
হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অ্যাম্বুলেন্সের মতো একটি জরুরি পরিবহনসেবাকে ঘিরে এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে বছরের পর বছর ধরে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হয় হাসপাতালের কর্মচারী অথবা ওয়ার্ডবয়দের। এ ছাড়া অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় ট্রিপ কমে গেছে। এ কারণে খরচ পোষাতে মালিকেরা রোগীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করেন। এ ক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেন্সমালিক ও চালকদের ঐক্য রয়েছে।
অথচ মানুষের জন্য অ্যাম্বুলেন্সসেবা সহজ করতে সরকার কর ছাড় দিয়ে রেখেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক তালিকা অনুযায়ী, দেড় হাজার সিসি (ইঞ্জিন ক্ষমতা) পর্যন্ত একটি পুরোনো বা রিকন্ডিশন্ড অ্যাম্বুলেন্স আমদানিতে মোট করভার ৩১ শতাংশ। একই ক্ষমতার একটি মাইক্রোবাস আমদানিতে কর দিতে হয় ১২৮ শতাংশের মতো। সরকার অবশ্য কর ছাড় দেওয়ার বাইরে আর কিছুই করেনি। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই।
ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার কোনো তালিকা নেই। নেই সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালাও। যে যেভাবে পারছে, রাস্তায় সমানে অ্যাম্বুলেন্স নামাচ্ছে।’ তিনি বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে হাসপাতালগুলোর কর্মচারীদের (ওয়ার্ডবয় ও আয়া) ওপর। এ জন্য তাদের ভাড়ার অন্তত ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হয়। এই কমিশন–বাণিজ্য না থাকলে ভাড়া অনেকটাই কমে যেত।
রাজধানীকেন্দ্রিক অ্যাম্বুলেন্সচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেসরকারি একেকটি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার ভেতর রোগী বহন করতে দেড় থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করে। ঢাকার হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আশপাশের জেলায় যেতে হলে একজন রোগীকে চার হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা গুনতে হয়। একটু দূরের জেলার ক্ষেত্রে ভাড়া দিতে হয় দূরত্ব ভেদে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা।
ফেনীর মনির আহমেদকে গত বুধবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তাঁর করোনা উপসর্গ ছিল। আড়াই ঘণ্টার রাস্তায় মনিরের স্বজনদের অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া গুনতে হয় সাড়ে সাত হাজার টাকা।
মনিরের স্বজন কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোগী অসুস্থ। ঢাকায় আনতেই হবে। তাই ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষি করার সুযোগ ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সচালকেরা সংঘবদ্ধ। রোগীদের জিম্মি করে তারা সব সময় বেশি ভাড়া আদায় করে থাকে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কিছু করার নেই।’
ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোরও অ্যাম্বুলেন্স সেবা রয়েছে। তবে তা সংখ্যায় সীমিত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫টি, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ৪টি এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ৪টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে একজন রোগীকে ঢাকার ভেতরে আনা-নেওয়া করতে ভাড়া মাত্র ৩২০ টাকা। এর বাইরে কম ভাড়া নেয় বেসরকারি আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ৫২০ টাকা।
সমস্যা হলো, সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা সাধারণ মানুষ পায় না। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের কর্মচারীদের যোগসাজশে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স বসিয়ে রাখা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা বিশেষ বিশেষ রোগী পরিবহন করে।
বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সচালকেরা রোগীর জরুরি কোনো পরিস্থিতি দেখলে জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, আশুলিয়ার গার্মেন্টস কর্মী রাবেয়া খাতুন গত বুধবার ভোরে কীটনাশক পান করেন। পরে আত্মীয়স্বজন একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ভাড়া গুনতে হয় চার হাজার টাকা।
রাবেয়ার আত্মীয় মরিয়ম খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোন বিষ পান করার পর অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গিয়ে দেখি, কেউ চার হাজার টাকার কমে যাবে না। তাই কিছু করার ছিল না।’
অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা মহানগরে অ্যাম্বুলেন্স মালিকের সংখ্যা ৬৩৪। তাঁদের মালিকানায় রয়েছে দেড় হাজারের বেশি অ্যাম্বুলেন্স।
সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, ব্যক্তিমালিকানায় অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শুধু চিকিৎসা সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাম্বুলেন্সের নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল দেওয়ান বলেন, অধিকাংশ অ্যাম্বুলেন্সের মালিক বেসরকারি হাসপাতালের নামে নিবন্ধন নিয়ে ব্যবসা করেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করা হয়। মাইক্রোবাসের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের পার্থক্য শুধু এটুকুই যে অ্যাম্বুলেন্স নামের মাইক্রোবাসে শুধু অক্সিজেন রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেটাও থাকে না। অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির নেতারাও এটি স্বীকার করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের সামনেই অ্যাম্বুলেন্সের স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। বেসরকারি বড় হাসপাতালের সামনে একই চিত্র। এই স্ট্যান্ডগুলো মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কিছু প্রভাবশালী কর্মচারী, ওয়ার্ডবয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা।
কিছু কিছু সরকারি হাসপাতালের প্রভাবশালী কর্মচারীরা নিজেরাই অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের আরেক সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি বাদল মাতবর প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে কমপক্ষে ৩০ জন কর্মচারী নামে-বেনামে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি হাসপাতালেই অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ী কর্মচারী রয়েছেন।
বিধিবিধান অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালের কর্মচারীদের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায় জড়িত থাকার সুযোগ নেই।
সরকারি দুই হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল ও মিটফোর্ড হাসপাতালের দুই পরিচালক চান রোগীকে জিম্মি করে এই ব্যবসার অবসান হোক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু আমাদের হাসপাতালের সামনে প্রতিদিন গড়ে ২০০ অ্যাম্বুলেন্স সব সময় দাঁড়িয়ে থাকে। রোগীদের জিম্মি করে অনেক অ্যাম্বুলেন্স মালিক অধিক ভাড়া আদায় করছে। এটা অবসান হওয়া দরকার।’
অন্যদিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশীদ-উন-নবী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ডবয় থেকে শুরু করে অনেকে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। রোগীদের ভোগান্তি দূর করতে একটা বড় উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নির্ধারণের কোনো উদ্যোগ নেবে কি না জানতে চাইলে সংস্থাটির পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, খুব শিগগির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেবে।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে অতীতেও এ ধরনের কথা বলা হয়েছে। কাজ হয়নি। এ ক্ষেত্রে তাঁদের একটি পরামর্শ হলো, অ্যাম্বুলেন্সে অ্যাপভিত্তিক সেবা চালু করা যেতে পারে। অ্যাপেই কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ঠিক করা থাকবে। তবে হাসপাতাল থেকে রোগী নিতে কাউকে যাতে বাধা না দেওয়া হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের উদ্যোগ দরকার।
করোনাকালে রোগী পরিবহন বেড়েছে। এর মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার নৈরাজ্যও লাগামহীন। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, অবিলম্বে অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়ার তালিকা তৈরি করে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা উচিত। এতে সাধারণ রোগীরা উপকৃত হবেন। তিনি বলেন, রোগীদের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি দিতে হলে সরকারি হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যাও বাড়ানো দরকার।