প্রযুক্তির জবাব প্রযুক্তি দিয়েই দিতে হবে। প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ মোকাবিলা ও দমন প্রযুক্তি দিয়েই করতে হবে। অ্যাপস বন্ধ করে এর সমাধান সম্ভব নয়। নিরাপত্তার কথা বলে ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাপস বন্ধ করা নিয়ে এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।
তাঁরা মনে করেন, এ জন্য জাতীয় টেলিকম মনিটরিং সেন্টারকে (এনটিএমসি) প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী করতে হবে। আর এনটিএমসিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনী ও সংস্থার সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তৈরি করতে হবে।
সাধারণত বড় কোনো সফটওয়্যার ছোট পরিসরে হাতে বহনযোগ্য যন্ত্রে ব্যবহৃত হলে তাকে অ্যাপ্লিকেশন বা অ্যাপস বলা হয়। মুঠোফোনে কথোপকথন, বার্তা ও ভিডিও বিনিময়ের জন্য বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে জনপ্রিয় অ্যাপসের মধ্যে রয়েছে ভাইবার, ট্যাংগো, হোয়াটসঅ্যাপ, মাইপিপল ও লাইন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিনা মূল্যে মুঠোফোনে কথোপকথন, বার্তা ও ছবি-ভিডিও বিনিময়ে বিশ্বব্যাপী এমন শত শত অ্যাপস ব্যবহার হচ্ছে। তাঁরা বলেন, কয়েকটি অ্যাপস বন্ধ করে কোনো কিছুর সত্যিকার সমাধান হবে না। কোনো অ্যাপস বন্ধ করলে প্রযুক্তির দুনিয়ায় কোনো না কোনোভাবে সেটা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা যায়। এ প্রসঙ্গে তাঁরা কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ করার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, সে সময় প্রক্সি সার্ভার দিয়ে তরুণেরা নানাভাবে ফেসবুক ব্যবহার করেছেন।
তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থা।’ তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। কোনো অ্যাপস বন্ধ করা নয়; বরং সক্ষমতা বৃদ্ধিই সমাধান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রকে দুর্বল দেখতে পাই।’
মোস্তাফা জব্বার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম জনবল তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘এখন যে অবস্থা হয়েছে সেটা সরকারের অবহেলার জন্য হয়েছে। সরকারের মধ্যে প্রযুক্তিগত অপরাধ মোকাবিলার মতো পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও জনবল নেই। এখনই এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ আমরা সামাল দিতে পারব না।’
শ্রীলঙ্কাভিত্তিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সায়ীদ খান বলেন, ‘সন্ত্রাস দমনে সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে অ্যাপস বন্ধ করে সন্ত্রাস কার্যকরভাবে বন্ধ করা গেছে এমন নজির আমরা দেখি না।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা এনটিএমসিকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দেন তিনি। তাঁর পরামর্শ হলো, জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার দিক থেকে এনটিএমসিকে এমনভাবে শক্তিশালী করতে হবে যাতে এর সক্ষমতা টেকসই হয়।
নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধে গতকাল বুধবার ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, লাইন, ট্যাংগো ও হ্যাংআউটসহ সামাজিক যোগাযোগের কয়েকটি মাধ্যম ও অ্যাপস বন্ধ করে দেয় সরকার। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এসব অ্যাপস বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এ পদক্ষেপ নিতে গিয়ে এক ঘন্টারও বেশি সময় সারা দেশে বন্ধ ছিল ইন্টারনেট সেবা।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী শাহজাহান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বন্ধের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব মাধ্যম বন্ধ করতে গিয়ে ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের ওপর কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের রায় ঘোষণার পর এসব অ্যাপস বন্ধের নির্দেশনা জারি করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব মাধ্যম ব্যবহার করে যাতে কোনো ধরনের উসকানি দিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি না করা যায় এবং কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত করতে না পারে সে জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে বিটিআরসির পক্ষ থেকে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এ ব্যবস্থা নেওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশ স্থিতিশীল করতেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার ও ভাইবার সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে উৎকণ্ঠিত সরকার। দেশে তারা (বিএনপি-জামায়াত) অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ঘটাতে পারে, সে জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। দু-চার দিন হয়তো বন্ধ থাকবে।’
এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনগণের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই ফেসবুক, ভাইবারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। একটি জীবনের মূল্যের চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। তাই এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে না পারার সাময়িক কষ্টটুকু জনগণকে মেনে নেওয়ার অনুরোধ করছি।’
কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সামাজিক যোগাযোগের কয়েকটি মাধ্যম বন্ধের ইঙ্গিত দেন। নেদারল্যান্ডস থেকে ফিরে ৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে জঙ্গি অর্থায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধরতে জটিলতার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল করেছি। এর শুভ ফলও যেমন আছে, খারাপ ফলও আছে। আমরা থ্রি-জি ও ফোর-জিতে চলে গেছি। এ কারণে জঙ্গিরা ইন্টারনেট, ভাইবার থেকে শুরু করে নানা ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে। সে জন্য আমাদের চিন্তাভাবনা আছে, যদি খুব বেশি ব্যবহার করে হয়তো একটা সময়ের জন্য বা কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেব। এই লিংকগুলো (জঙ্গি অর্থায়নের সূত্র) যাতে ধরা যায়।’ ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদেও একই ধরনের বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কোনোভাবে সহ্য করা হবে না। কিছুদিনের জন্য হলেও এটা বন্ধ করে সন্ত্রাসীদের যাতে ধরা যায় সে পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য এটা বন্ধ করে সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে ধরা হবে।’
প্রসঙ্গত চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় ‘নিরাপত্তার’ কারণ দেখিয়ে ভাইবার, ট্যাংগো, হোয়াটসঅ্যাপ, মাইপিপল ও লাইন নামের পাঁচটি অ্যাপসের সেবা বন্ধ করে দেয় সরকার। তখন বলা হয়েছিল, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এসব অ্যাপস ব্যবহার করতেন।
আরও পড়ুন: