রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীরাই সংগঠনের কমিটিতে বড় পদ পেয়েছেন। গত কমিটিতে এ রকম অন্তত চারজন স্থান পেয়েছেন, যাঁরা অতীতে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপরে চড়াও হয়েছিলেন।
ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাসের রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এমন তথ্য দিয়েছেন। ছাত্ররা বলছেন, অতীতে যাঁরা অস্ত্রবাজি করেছেন, তাঁদের নতুন কমিটিতে বড় পদ দেওয়ায় অস্ত্রবাজি উৎসাহিত হয়েছে। গত রোববারের ঘটনাকে তাঁরা এই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখছেন।
অস্ত্রবাজির ঘটনায় কাউকে কাউকে বহিষ্কার করা হলেও তাঁদের বরাবরই সংগঠনের হয়ে কাজ করতে দেখা গেছে। তাঁদেরই আবার কমিটিতে ফিরিয়ে নিয়ে বড় জায়গা করে দেওয়া হয়েছে।
রোববার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি ও সান্ধ্য কোর্সবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ ও ছাত্রলীগ হামলা করে। এ সময় ছাত্রলীগের ছয়জনকে অস্ত্র হাতে তাড়া করতে ও গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এঁদের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি এই অস্ত্রধারীদের মধ্যে দুজনকে বহিষ্কার করেছে।
তৌহিদ আল হোসেন: ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম তৌহিদ আল হোসেন ওরফে তুহিন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ২০১২ সালের ২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের সময় তৌহিদকে পুলিশের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। পরদিন সে ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তৌহিদ তখন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ২০১৩ সালের ২০ জুলাই গঠিত ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কমিটিতে তৌহিদকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। গত বছরের ২২ আগস্ট দুর্বৃত্তরা তাঁর হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়। এর জন্য ছাত্রলীগ শিবিরকে দায়ী করে।
আখেরুজ্জামান: ২০১২ সালের ২ অক্টোবরের ওই ঘটনায় তৌহিদের পাশাপাশি পিস্তল রেব করে গুলি ছুড়তে দেখা যায় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালীন সহসভাপতি আখেরুজ্জামান ওরফে তাকিমকে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, তাঁর পুরো নাম এ কে এম তৌহিদ আলম আখেরুজ্জামান। বিশ্ববিদ্যালয়ে আখেরুজ্জামান তাকিম নামেই পরিচিত ছিলেন। আখেরুজ্জামান ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে ক্লাসে উপস্থিতি না থাকার কারণে তিনি প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিতে পারেননি। ২০০৯ সালেও তিনি প্রথম বর্ষ পরীক্ষার ফরম পূরণ করেননি। ২০১০ সালেও করেননি। ফলে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায়।
ছাত্রত্ব না থাকলেও ২০১২ সালের জুন মাসে গঠিত ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সহসভাপতির পদ পেয়েছিলেন। এই বছরের ১৫ জুলাই রাতে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান ওরফে সোহেল রানা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন এবং পরে মারা যান। অভিযোগ রয়েছে, ওই ঘটনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন আখেরুজ্জামান ও তখনকার সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন।
ওই ঘটনার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁদের দুজনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর দুর্বৃত্তরা আখেরুজ্জামানের বাঁ পায়ের ও একটি হাতের রগ কেটে দেয়। এরপর তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন।
আতিকুর রহমান: ২০১২ সালের ওই একই ঘটনায় অস্ত্র হাতে দেখা গিয়েছিল ছাত্রলীগের সেই সময়ের কমিটির উপদপ্তর সম্পাদক আতিকুর রহমানকে। এবার তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। গত বছরের ২০ জুলাই গঠিত ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে তিনি সংগঠনের সহসভাপতির পদ পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি ক্যাম্পাসে নেই। তিনিও নিজ দলের কর্মী সোহেল হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।
নাসিম আহাম্মেদ: নাসিম আহাম্মেদ ওরফে সেতু ছাত্রলীগের আগের কিমিটির উপপাঠাগার সম্পাদক ছিলেন। ২০১২ সালের ২ অক্টোবর তাঁকে পুলিশের সামনে পিস্তলে গুলি ভরতে দেখা গেছে।
নাসিম আহাম্মেদের বিরুদ্ধে দলের কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান হত্যার মামলা রয়েছে। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন। গত বছরের ৩১ জানুয়ারি তিনি নিজ দলের কর্মীকে অস্ত্র দেখাতে গেলে গুলি বের হয়ে নিজেই আহত হয়েছিলেন।
নতুন কমিটিতে নাসিমকে ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়।
রোববার ছাত্রলীগের মিছিল থেকে নাসিম আহাম্মেদকে পিস্তল হাতে গুলি করতে করতে দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের দিকে যেতে দেখা যায়।
বহিষ্কার পরিষ্কার কোনো অবস্থান না: ২০১২ সালের ১৫ জুলাই রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আহম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইনের পক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান। ওই ঘটনার জের ধরে ১৬ জুলাই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালীন সহসভাপতি আখেরুজ্জামান ও সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেনকে।
২১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চোরাগোপ্তা হামলার শিকার হন আখেরুজ্জামান। শিবিরের নেতা-কর্মীরা তাঁর হাত ও পায়ের রগ কেটে দেন। ওই সময় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা আখেরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আট নেতা-কর্মীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ওই আটজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আওয়াল কবির ও সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল ইসলাম।
২০১০ সালের ১৫ আগস্ট শাহ মখদুম হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারির একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কর্মী ও ইতিহাস বিভাগের ছাত্র নাসরুল্লাহ নাসিমকে দোতলা থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ২৩ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নাসিম। তখনো একবার তৎকালীন সভাপতি আওয়াল কবির এবং সাধারণ সম্পাদক মাজিদুল ইসলামকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন ঘটনায় নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার করা হলেও তাঁরা ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হননি। তাঁরা ছাত্রলীগের সব ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের টিভি কক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের তৎকালীন সভাপতি আরিফ পারভেজকে পিটিয়েছিলেন নাসিম আহাম্মেদের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্রলীগের কর্মী। পরদিন সাংস্কৃতিক কর্মীদের তোপের মুখে ছাত্রলীগের তৎকালীন উপপাঠাগার সম্পাদক নাসিমকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কিন্তু নাসিম ছাত্রলীগের সব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। ২০১৩ সালের ২০ জুলাই ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ২৪তম কাউন্সিলে গঠিত কমিটিতে তিনি যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
একাধিক ছাত্র প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে এ ধরনের কাজের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। আবার দলে ফিরিয়েও নেওয়া হয়েছে। ফলে এবারের বহিষ্কারের ঘটনা কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করছে না।
জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি শফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহীতে জামায়াত-শিবিরের শক্তিশালী ঘাঁটি রয়েছে। তাদের মোকাবিলা করার জন্য ছাত্রলীগের শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন রয়েছে, যারা শিবিরের বিরুদ্ধে সত্যিকারের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। তবে তিনি এও বলেন, এর অর্থ এই নয় যে অস্ত্রধারীদের নেতৃত্বে জায়গা করে দিতে হবে। তার পরও এরা কীভাবে নেতৃত্বে আসছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমিটি করার সময় ওপরের নেতারা থাকেন। তাঁরা বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন।