সর্বশেষ সংসদ অধিবেশনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সমালোচনা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অথর্ব, বরাদ্দ অর্থ খরচের দক্ষতা ও সামর্থ্য তাদের নেই, দুর্নীতিতে ঠাসা—এসব অভিযোগের পাশাপাশি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ‘লজ্জা’ ও ‘শরম’ নিয়েও কথা উঠেছে। জাহিদ মালেক সাফাই গেয়ে বক্তব্যও দিয়েছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুজন মুখপাত্র, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিয়মিতভাবে যে যেখানে পারছেন কথা বলছেন। কেউ দিনে কর্মস্থলে, রাতে টক শোতে। তারপরও তাঁরা তাঁদের মনের কথা, সাফল্যের কথা পুরোপুরি দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে পারেননি। টিকা নিয়ে কথা বলার জন্য ৭ জুলাই দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন জাহিদ মালেক। দুর্নীতি, মন্ত্রী সম্পর্কে সাংসদদের মন্তব্য, সর্বশেষ ১ হাজার ২৫১ জন চিকিৎসক বদলি নিয়ে হযবরল পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্ত্রীর বক্তব্য জানার জন্য নির্ধারিত সময়ের আগেই মন্ত্রণালয় সভাকক্ষে সাংবাদিকদের ভিড় জমে। শেষ মুহূর্তে সংবাদ সম্মেলন বাতিল হয়।
অবশ্য নিজেদের কথা তুলে ধরতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে বিধিনিষেধ আন্তরিক ও কঠোরভাবে পালনের ‘আকুল আবেদন’ নামের বিজ্ঞাপন দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, করোনার বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ। সামনে ঈদুল আজহা। দেশবাসী যেন করোনাভাইরাস মোকাবিলা ও মৃত্যু ঠেকাতে বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্য পরামর্শ নিজেরা মেনে চলেন। পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন ও পাড়া–প্রতিবেশী সবাইকে এসব নিয়ম পালনে উৎসাহিত করেন। করোনা রোগীর সংখ্যা যদি বর্তমান গতিতে বাড়তে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান রোগীর চিকিৎসা দিতে অসমর্থ হয়ে পড়বে, এমন আশঙ্কার কথাও বলা হয়েছে। এমন পরামর্শ ও সতর্কতার জন্য মন্ত্রণালয়কে সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু বিজ্ঞাপনের বেশির ভাগ অংশে দেওয়া তথ্য ও বক্তব্যে রয়েছে অসংগতি।
গতকাল শুক্রবার ১০টির বেশি জাতীয় দৈনিকে বিশাল আকারের এ বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। গত বছর স্বাস্থ্যের কেনাকাটা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে একই ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে মন্ত্রণালয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা করার পক্ষে সাফাই গেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
গতকাল প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপন সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ বিজ্ঞাপন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা আস্থার সংকটে ভুগছেন। তাঁরা হঠকারিতার আশ্রয় নিয়েছেন। করোনার ভয়াবহতা ঠেকাতে মানুষকে কঠোরতা পালনের আবেদন জানিয়ে তাঁরা প্রায় পুরো বিজ্ঞাপনে নিজেদের সাফাই গাইতে দেশের বিশিষ্টজন ও বিরোধীদলীয় নেতাদের সমালোচনা করেছেন। এটা প্রতারণা। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে তাঁদের এ কৌশল বুমেরাং হবে।
বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডোজ করোনার টিকা কেনা হয়েছে। প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়েছে তিন হাজার টাকা। এ পর্যন্ত টিকার জন্য খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৪৫ কোটি টাকা।
ভারত থেকে সেরাম ইনস্টিটিউটের ৭০ লাখ ডোজ টিকা কিনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিকবার গণমাধ্যমে বলেছিলেন, এ টিকার প্রতি ডোজের দাম পাঁচ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশি ৪২৫ টাকা। সেই হিসাবে সেরামের টিকা কিনতে মোট ব্যয় হয়েছে ২৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
সেরামের টিকা বাদ দিলে সরকারি হিসাবে আরও ৩১ লাখ ৫০ হাজার টিকা কেনা হয়েছে। এর জন্য ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৭৪৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তাতে প্রতি ডোজের দাম পড়েছে ৮ হাজার ৭২২ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডোজ ১০২ মার্কিন ডলারে কিনেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সেরাম ছাড়া টিকা কিনেছে চীনের কাছ থেকে। এ ছাড়া করোনার টিকার বৈশ্বিক উদ্যোগ থেকে টিকা পেয়েছে। আর পেয়েছে ভারতের ও চীনের কাছ থেকে উপহারের টিকা।
চীনের সঙ্গে টিকা ক্রয় চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগে একজন সরকারি কর্মকর্তা অসাবধানতাবশত প্রতি ডোজ টিকা ১০ ডলার (৮৫০ টাকা) বলে উল্লেখ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কত দামে টিকা কেনা হয়েছে তা জানা যায়নি। অন্যদিকে কোভ্যাক্স থেকে বাংলাদেশ যে টিকা পেয়েছে, তার জন্য কোনো টাকা দিতে হয়নি।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি টিকার দাম কেন এত পড়ল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত জাতির কাছে টিকার দামের বিষয়টি পরিষ্কার করা। মানুষ জানে বিশ্বের কোথায় টিকার দাম কত।’
বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘মাস্কের কথা বলেন অনেকে, অথচ সেই মাস্কের জন্য কোনো টাকাই খরচ হয়নি।’
মাস্ক যদি কেনা না হয়, তাহলে মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা মুখে কী ব্যবহার করেছেন? লাখ লাখ মাস্ক কি সরকারকে কেউ দান করেছে বা উপহার দিয়েছে? তারা কারা? বিজ্ঞাপনে এমন কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়নি।
মাস্কের দুর্নীতি নিয়ে গত বছর মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালক প্রথম অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। অতি সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্তিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯–২০ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের করোনাবিষয়ক প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি সার্জিক্যাল মাস্কের দাম গড়ে ৩৫৬ টাকা ৯৬ পয়সা ধরা হয়েছে।
বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রতিদিন একজন করোনা রোগীর জন্য গড়ে ২০ হাজার টাকা খরচ করেছে সরকার। একজন রোগীকে গড়ে ১০ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। একজন রোগীর পেছনে দুই লাখ টাকা করে খরচ করে চলেছে সরকার।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর কখনো ব্যাখ্যা করেনি কোন কোন খাতে এ খরচ হয়। সাধারণ করোনা রোগীর চিকিৎসায় খুব কম ওষুধ প্রয়োজন হয়। আইসিইউতে থাকা রোগী বা অন্য রোগ থাকা করোনা রোগীর জন্য খরচ বেশি। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ পর্যন্ত সাধারণ ও জটিল রোগীর কোনো হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি।
তাই একজন রোগীর জন্য দৈনিক ২০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে—এ হিসাবে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।
মহামারির সময় যে পরিমাণ তথ্য মানুষকে জানানোর দরকার, শুরু থেকে তা দেওয়ার ব্যাপারে ঘাটতি দেখা গেছে। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ পেয়ে দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু তাঁদের করণীয় বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। বিদেশ অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা টিকা পাওয়ার জন্য কী করবেন, তা নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন নেই। এ রকম উদাহরণ আরও আছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিজ্ঞাপন কেন দিয়েছে, তা বোধগম্য নয়। মহামারির সময় ঝুঁকি যোগাযোগের মাধ্যমে পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়, সরকার কী করছে তা বলা হয় এবং জনসাধরণের কী করা উচিত, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু এ চরম সংকটকালে এর কোনো কিছুই এ বিজ্ঞাপনে নেই। অন্যদিকে বিরোধী দলের কথা বলে বিজ্ঞাপনে রাজনীতি টেনে আনা হয়েছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ বিজ্ঞাপন মহামারি পরিস্থিতির উন্নতিতে কোনো অবদান রাখবে না।