পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনে, যারা অগ্রগণ্য ছিলেন তাদের অন্যতম অশ্বিনী কুমার দত্ত। ১৮৫৬ সালে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোরে জন্ম। তৎকালীন উচ্চ শিক্ষিত রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। বরিশালে বসেই কাঁপিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত।
তখন জাতীয় কংগ্রেসের (১৮৮৫) যাত্রা শুরু হয়নি। অশ্বিনী দত্ত স্থানীয় গায়ককে সঙ্গী করে বরিশালের বাজার রোড, হাটখোলাসহ জনবহুল এলাকায়, খাল ও নদীর ধারে গানের সঙ্গে একটি কাঠের বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে সামাজিক, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে বক্তব্য দিতেন। বরিশালের নানা সমস্যা, দেশের পরিস্থিতি তিনি প্রচার করে জনমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। এভাবেই ‘জনসাধারণের সভা’ নামে এক রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগ (১৮৮৬) পরে পরিণতি লাভ করে। অশ্বিনী দত্তের এই জন গণমুখিতা ছিল অসাধারণ।
জাতীয় নেতা হতে পারতেন অশ্বিনী দত্ত। কিন্তু তিনি চাইলেন বরিশালের মানুষের ভালো মন্দের সঙ্গে জড়িয়ে আঞ্চলিক নেতা হয়ে থাকতে। তাই রাজনীতির সঙ্গে জনসেবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে বরিশালকে বদলে দিতে চাইলেন। ১৮২৯ সালে তৎকালীন বাকেরগঞ্জের কালেকটর মি গ্যারেট একটি ইংরেজি স্কুল খুললেও সেটি স্থায়ী হয়নি। অবশেষে ১৮৫৩ সালে সরকারিভাবে বরিশাল জিলা স্কুল স্থাপনের পর ১৮৮৪ সালে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৬০০-তে পৌঁছায়। শিক্ষার্থীদের জায়গা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন আরও একটি স্কুলের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল। তৎকালীন কমিশনার রমেশ চন্দ্র দত্তের প্রস্তাবে ১৮৮৪ সালের ২৭ জুন ‘সত্য-প্রেম-পবিত্রতা’কে মহা মন্ত্র করে পিতা ব্রজমোহন দত্তের নামে তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়। স্কুল স্থাপনের ৪র্থ দিনের মধ্যেই স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ৩ শত ছাড়িয়ে যায়। প্রথমে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের পশ্চিমে হরি ঘোষের ঘরে, পরে প্রসন্ন কুমার সেনের ঔষধালয়ের গৃহে, কিছুদিন কালীবাড়ি রোডে ধর্মরক্ষিণী সভা গৃহের স্থানে কিছুদিন অশ্বিনী দত্তের বাড়িতেও ক্লাস চলে। পরে বর্তমান স্থানে স্কুলটির ঠিকানা হয়। ‘সত্য-প্রেম পবিত্রতা’ শুধু কাগজের বাণী ছিল না। বিদ্যালয়ের পতাকায়, প্রবেশ পথে, অধ্যয়ন কক্ষে সর্বত্র এটি প্রচারিত হতো। শিক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থেই ‘সত্য-প্রেম-পবিত্রতা’ ভাবনায় জীবনভর চালিত হতো। এমনকি বিদ্যালয়ে সংগীতও ছিল- ‘ সত্য, প্রেম পবিত্রতা’- যেটি এ রকম ‘আয় ভাই আয় মাতি নব বলে/এই মহাব্রত সাধিব সকলে/ অদম্য উৎসাহে যতন করিলে/ স্বর্গ হইবে মরতধাম/ঘৃণা অভিমানে দেব না বেদনা/পশু পক্ষী কীট তাহারি রচনা;/ প্রচারি জীবনে দয়ার মহিমা,/ অহিংসা-মন্ত্র জপি অবিরাম/সত্যের নিশান তুলিয়ে গগনে/ পবিত্রতা মৃত পূরিয়ে পরানে/ প্রেম-ডোরে বাধি ভাই -বন্ধু গণে,/ চল পূর্ণ হবে যত মনস্কাম। ( সংক্ষেপিত)
ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে শুধু শিক্ষা গৃহ নয়, এখানে নীতি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হতো। স্কুলটি পরিদর্শনে এসে সুপন্ডিত ক্যানিংহাম মন্তব্য করেছিলেন, ‘বঙ্গদেশে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের মতো উৎকৃষ্ট বিদ্যালয় থাকিতে বাঙালি ছাত্ররা অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজে কেন যায় আমি তাহা বুঝি না।’ দরিদ্র-বান্ধব সমিতি, বান্ধব সম্মিলনী, আশ্বাসী সম্প্রদায়, কৃপালু সম্প্রদায় সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষকেরা ছাত্রদের নিয়ে, রোগীর সেবা, দরিদ্রকে সহায়তা ও বিপন্নকে উদ্ধারের অবিরাম চেষ্টা হতো। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ শিক্ষা কার্যক্রমে অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে না পারলে এগিয়ে আসত ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ব্রজমোহন স্কুলের সুনাম তখন এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে তখন বাংলার কোনো জায়গায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রয়োজন হলে এ স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থীদের চেয়ে পাঠাত। শিক্ষা কার্যক্রমেও এই স্কুল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফলে ওপরের দিকে অবস্থান করত। এসব কারণে ব্রজমোহন বিদ্যালয় ও ব্রজমোহন কলেজ (১৮৮৯) দক্ষিণাঞ্চলে আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। স্কুলের সঙ্গে ১৮৮৯ সালে এফ.এ ক্লাস ও ১৮৯৮ সালে বি.এ ক্লাস খোলা হয়েছিল। ১৮৯৮ সালে বিদ্যালয়ের এক সাথে পরিচালিত ব্রজমোহন কলেজ প্রথম শ্রেণির কলেজে পরিণত হয়ে আলাদা হয়ে যায়। ৫০ হাজার টাকায় বর্তমান জায়গায় কলেজ স্থাপিত হয়। ১৯১৭ সালে ব্রজমোহন কলেজের ভবন নির্মিত হলে কলেজটি ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের স্থান থেকে বর্তমান জায়গায় চলে আসে।
ব্রজমোহন কলেজের পরিবেশ এমন ছিল যে এক সময়ে সেখানে পরীক্ষার হলে কোনো গার্ড লাগত না। ছাত্ররাই শিক্ষক রুমে গিয়ে প্রশ্নপত্র নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকদের হাতে পরীক্ষাপত্র পৌঁছে দিত। পঠন, চরিত্র গঠনে ব্রজমোহন কলেজের সুনামের কারণে এই কলেজ টিকে ‘অক্সফোর্ড অব বেঙ্গল’ নামে অভিহিত করা হতো। অশ্বিনী দত্ত শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েই বসে ছিলেন না। ব্রজমোহন কলেজে তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে বিনা বেতনে ছাত্রদের ইংরেজিও পড়িয়েছেন।
১৯০৬ সালের ১৪ এপ্রিল বরিশালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনের তারিখ ঘোষিত হয়। হিন্দু মুসলমান মিলনের অগ্রদূত ব্যারিস্টার আবদুল রসুল ছিলেন সম্মেলনের সভাপতি। অশ্বিনী কুমার দত্ত ছিলেন অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি। সম্মেলনে যোগ দিতে স্টিমারে আসেন সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জি, অরবিন্দ ঘোষ, ভূপন্দ্রকুমার বসু, যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী, কৃষ্ণ কুমার মিত্র, কালী প্রসন্ন কাব্য বিশারদ, মনোরঞ্জন গুহ ঠাকুরতা, লিয়াকত হোসেন, হেদায়েত বকশি, ললিত মোহন ঘোষালসহ অসংখ্য প্রতিনিধি। বর্তমানে অশ্বিনী কুমার হল এর স্থানটি ছিল রাজাবাহাদুরের হাবেলী। এখানেই সম্মেলন হয়। সারা দেশের নেতারা তখন অনুষ্ঠান স্থলে। মুকুন্দ দাস উদ্বোধনী সংগীত গাইলেন ‘তরণ অরুণ কিরণে প্রকৃতি’। কিন্তু সম্মেলন আর বেশি দূর চলতে পারল না। ইংরেজ শাসকের আদেশ হলো ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি করা যাবে না। এমনকি স্বেচ্ছাসেবকদের কুচকাওয়াজ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ হলো। তৎকালীন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ক্যাম্প সাহেব সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জিকে আটক ও জরিমানা করেন। ক্যাম্প সম্মেলনে এসে ঘোষণা দেন, রাস্তায় বন্দে মাতরম ধ্বনীসহ কোনো শোভাযাত্রা মিছিল না করলে সভা চলবে অন্যথায় সভা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু উপস্থিত ডেলিগেটরা এ মুচলেকা দিতে অস্বীকার করলে সভা বন্ধের নির্দেশ দেন ক্যাম্প। বন্দে মাতরম উচ্চারিত হলো। অকস্মাৎ লাঠি বৃষ্টি শুরু হয় পুলিশের। পুলিশ নির্মম ও বেপরোয়াভাবে ডাইনে ও বামে, সম্মুখে ও পশ্চাতে লাঠি চালাইতেছে। কেউ রাস্তায়, কেউ পার্শ্বে নর্দমায় পড়েন রক্তাক্ত দেহে। যতীন বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুতর আহত হলেন। কিন্তু লাঠির পর লাঠির আঘাতে মনোরঞ্জন গুহ ঠাকুরতার পুত্র চিত্ত রঞ্জন পুকুরের মধ্যে পড়েও সংজ্ঞা লুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মাতৃ মন্ত্রত্যাগ করেননি।
সম্মেলন ব্রিটিশ পুলিশের আকস্মিক লাঠি চার্জসহ ঘোড়া উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনায় সম্মেলন পণ্ড হয়ে যায়। নেতৃবৃন্দ, সাধারণ ডেলিগেট ও বহু তরুণ আহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। কালীশচন্দ্র কবিতায় লিখলেন-‘ এই বরিশাল পুণ্যে বিশাল হলো লাঠির ঘায়ে’।
১৯০৮ সালে বরিশালের বিখ্যাত স্বদেশ বান্ধব সমিতিকে ইংরেজ শাসক নিষিদ্ধ করেন। অশ্বিনী দত্ত এ সমিতিরও সভাপতি ছিলেন। একই সঙ্গে অনুশীলন সমিতি, ফরিদপুরের সুহৃদ, ময়মনসিংহের ব্রতী এই সংগঠনগুলোকেও নিষিদ্ধ করা হয়। একই সঙ্গে ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেজুলেশন দ্বারা আরও নয়জন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অশ্বিনী দত্তকে ২ বছর বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। শুধু তাই নয় সরকারি রোষানল ব্রজমোহন স্কুলের প্রতিও পরে। স্কুলের বৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯০৮ সালে দেবপ্রসাদ ঘোষ ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রাশ পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১ম স্থান অধিকার করেও বৃত্তি হতে বঞ্চিত হলেন। দেব প্রসাদ এতেও হতোদ্যম না হয়ে ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হলেন। এমনকি একবার ব্রজমোহন কলেজের আর্থিক অবস্থা সঙিন হলে সরকারি সহায়তার জন্য আবেদন করা হলে, ইংরেজ সরকার পাঁচ শিক্ষকের একটি তালিকা ধরিয়ে দেয়। এদের বহিষ্কার করলেই মিলবে সরকারি সহায়তা। অশ্বিনী দত্ত অস্বীকার করলেন এ সহায়তা। এই পাঁচ শিক্ষক ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও দেশ প্রেমিক। তারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে পরে কলেজটিকে বাঁচাতে পদত্যাগ করেন।
অশ্বিনী দত্তের প্রভাবে যারাই এসেছেন, দেশপ্রেমিক সোনার মানুষে পরিণত হয়েছেন তারাই। এর উদাহরণে চারণ কবি মুকুন্দ দাস রূপে গড়ে তোলে যাত্রার মাধ্যমে লোক শিক্ষার আহ্বান জানান। অশ্বিনী দত্তের ভাষায়, ‘আমরা যে সব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি তা যদি কেউ যাত্রা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা আমাদের এই রূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেকটা কার্যকরী হয়’। মুকুন্দ দাস নেমে পড়লেন দেশের কাজে। গ্রামে গ্রামে মুকুন্দের যাত্রাপালার মাধ্যমে স্বদেশ চেতনার জাগরণের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। ব্রিটিশরাজ প্রমাদ গুনলেন। যেখানেই মুকুন্দ দাস সেখানেই ১৪৪ ধারা ঘোষিত হলো। তারা বই বাজেয়াপ্ত হলো- এক সময়ে গ্রেপ্তার করল তাকে।
১৯২১ সালে বরিশালে কংগ্রেসের আরেকটি প্রাদেশিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধী সে সময়ে আসতে না পারলে পরের বছর তিনি জনসভা করেন। এ সময় অশ্বিনী দত্তের বাসভবনেও মহাত্মা গান্ধী অশ্বিনী কুমার দত্তের সঙ্গে দেখা করেছেন। সে সময়ে বরিশালের ব্রিটিশ বিরোধিতা ছিল সারা ভারতবর্ষের মতো প্রবাদ সম। মহাত্মা গান্ধীর উচ্চারণে-‘সমগ্র ভারত যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন তখন বরিশাল সদা জাগ্রত’।
রাজা বাহাদুর হাভেলির এই রক্তাক্ত স্মৃতি, যেখানে জনগণের কথা বলার স্থান এই স্থানটিকে জনগণের চিরতরে কথা বলার স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে একটি হলো স্থাপনের উদ্যোগ নেন অশ্বিনী কুমার। শেরে-ই বাংলা ফজলুল হকসহ অনেক দানশীল ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষ এই উদ্যোগে যুক্ত হলে শুরু হয় হল নির্মাণকাজ। কিন্তু হলো নির্মাণের ২ বছরের মধ্যে অশ্বিনী দত্ত ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর মারা যান। পরে নাগরিকেরা অশ্বিনী দত্তের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে অশ্বিনী কুমার মল নামকরণ করেন।
১৯২৩ সালে অশ্বিনী দত্তের মৃত্যুর পরে তার ভাইয়ের ছেলে সরল দত্ত অশ্বিনী ভবনে অবস্থান করেন। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানে প্রতিরক্ষা আইনে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মতো তাকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেন। কিছুদিন পরে তিনি কলকাতায় চলে গেলে মৌখিকভাবে ব্রজমোহন কলেজকে বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দিয়ে যান। এ সময় এখানে অশ্বিনী কুমার কসমোপলিটন হোম নামে সব ধর্ম ও বর্ণের জন্য একটি ছাত্রাবাস চালু হয়। জন নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদ ব্রজমোহন কলেজে পড়াকালীন এই ছাত্রাবাসেই থাকতেন। ১৯৬৩ সালে দি বরিশাল নাইট কলেজ অস্থায়ীভাবে ব্রজমোহন স্কুলে শুরু হয়। এই কলেজের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা ছিল বরিশাল কালেকটরেটেরর কর্মাচারী। অনেকেই এই কলেজ থেকে পাশ করে দ্রুত উচ্চ পদে আসীন হতে পেরেছিলেন। ১৯৬৬ সালে এই কলেজটি বরিশাল কলেজ নাম দিয়ে দিবা শাখা চালু করে অশ্বিনী দত্তের বাসভবনে। ১৯৮৬ সালে যা সরকারি করণ করা হয়।
১৯৬৩ সালে নাইট কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে এটিকে অশ্বিনী কুমার কলেজ নামে নামকরণের প্রস্তাব দেন সাবেক মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত। কিন্তু তখন উদ্যোক্তাদের অনেকেই মুসলিম লীগের রাজনীতির ধারক থাকায় তা প্রত্যাখ্যাত হয়। পরবর্তীতে বলেজের গভর্নিং বডির সম্পাদক, আইনজীবী, বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন কলেজটির নাম অশ্বিনী কুমার দত্তের নামে করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুস একই প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করে কলেজের নাম অশ্বিনী দত্তের নামে করার প্রস্তাব করেন।
বাটাজোর অশ্বিনী কুমার ইনস্টিটিউশনে ১৯৯৬ এর পরবর্তী সময়ে অশ্বিনী মেলায়, তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসানাতের উপস্থিতিতে কলেজটিকে অশ্বিনী দত্তের নামে নামকরণে প্রস্তাব জানায় উদ্যোক্তারা। ২ বছর ধরে ‘মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত স্মৃতি সংসদ’ ধারাবাহিকভাবে অশ্বিনী মেলা উপলক্ষে জেলা প্রশাসক বরাবরে এই আহ্বানে স্মারকলিপিও প্রদান করে, যা গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক প্রস্তাবটিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরিশাল শিক্ষা বোর্ডকে এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি প্রদান করার নির্দেশ দিলেই প্রথমে একদল হইচই শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা মন্তব্য হতে থাকে। পরবর্তীতে সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের ব্যানারে মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাঠে সোচ্চার হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিয়ে গঠিত হয় ১০১ সদস্য বিশিষ্ট অশ্বিনী কুমার দত্তের নামে বরিশাল কলেজ বাস্তবায়ন কমিটি। এ ছাড়া বাসদও কলেজের নামকরণ অশ্বিনী দত্তের নামে নামাকরণের পক্ষে সরব হয়। এ বিষয়ে পাল্টা পাল্টি অবস্থান, সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরকারি দলের প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ এখন বরিশালের প্রধান আলোচিত বিষয়। সুযোগ বুঝে ইসলামি শাসন তন্ত্র আন্দোলনও বিভিন্ন কর্মসূচি দেয়। এমনকি তাদের মতবিনিময় সভায় অশ্বিনী কুমার দত্তকে নিয়ে নানান নেতিবাচক বক্তব্য আসে। একটি কলেজের নামকরণ ঘিরে বরিশালের এই পাল্টাপাল্টি অবস্থান কারও কাম্য হতে পারে না। অশ্বিনী দত্ত বরিশালের মহান নেতা। তার স্মৃতি রক্ষায় তার বাসভবনে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণ এটি কোনো অন্যায় বা অন্যায্য দাবি নয়। দীর্ঘদিন ধরে বরিশালের সংস্কৃতি অঙ্গন, সুধীজন এই দাবি জানিয়ে আসছিল।
২০১২ সালে সংসদেও শাসকদলের পক্ষে এটি প্রস্তাবনা হিসেবে উত্থাপিত হয়েছিল। এটি একটি হেরিটেজও বটে। এই বাড়িতে স্থাপিত তমাল তলায় যেখানে মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বহু রাজনীতিবিদদের আগমন ঘটে। যে অশ্বিনী কুমার আধুনিক বরিশালের রূপকার তার বাসভবনে তার স্মৃতি রক্ষা এটি সময়ের দাবি- তা না হলে আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে আমরা পরিচিত লাভ করব সর্বত্র। আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের কৃতকর্ম অত্যন্ত জঘন্য হিসেবে চিত্রিত হবে। আমরা বরিশালের অশ্বিনীকে তার বাসভবন থেকেই উচ্ছেদ করব? যেখানে অশ্বিনী দত্ত বরিশালের প্রতি ভালোবাসায় বলেছিলেন ‘মরার পর যেন আবার জন্ম গ্রহণ করি এই বরিশালের মাটিতে।’
*লেখক: সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক