রোগে আক্রান্ত হলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকের কাছে যায় না। ৫৮ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেয় ওষুধের দোকানদার, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, হাকিম-কবিরাজ, ওঝা, পীর, বৈদ্যসহ অন্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে। এ কারণে অর্ধেকের বেশি রোগী সুচিকিৎসা পায় না। এই তথ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপের।
বিবিএস ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এ বছর জুন মাসে। এতে দেখা গেছে, ১৬ শতাংশ রোগী সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে উপজেলা-জেলাসহ বিভিন্ন স্তরের হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। ২৬ শতাংশ রোগী সেবা নেয় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে। বেশ কিছু রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়।
দেশে বড় বড় হাসপাতাল হচ্ছে, বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি আসছে, চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, চিকিৎসক ও নার্সরা বিদেশ থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরছেন, তারপরও চিকিৎসার বিষয়ে নানা অভিযোগ আছে। তবে চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্টিও আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক অসিত বরণ অধিকারী প্রথম আলোকে বলেন, হৃদ্রোগের শল্যচিকিৎসায় (কার্ডিয়াক সার্জারি) দেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। জন্মগত হৃদ্রোগ থেকে শুরু করে হৃদ্রোগ সচল রেখে শল্যচিকিৎসার দক্ষ চিকিৎসক ও উপযুক্ত হাসপাতাল দেশে আছে। প্রতি মাসে প্রায় এক হাজার সফল অস্ত্রোপচার দেশেই হচ্ছে। এই সাফল্যকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
কত রোগী, কার কাছে চিকিৎসা
বিবিএসের রোগগ্রস্তবিষয়ক জরিপ (২০১৪) বলছে, প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে ১৭০ জন কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত থাকে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় জ্বরে। অন্যদিকে গেঁটেবাত, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, ক্যানসার—এসব অসংক্রামক রোগ আগের চেয়ে বাড়ছে।
তবে রোগে ভুগলেই সব মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায় না। প্রায় ৫৮ শতাংশ মানুষ মনে করে, সমস্যাটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্য একটি অংশ চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে চিকিৎসা নেয় না। এরা প্রায় ১৭ শতাংশ। বাড়ির কাছে হাসপাতাল বা চিকিৎসক না থাকার কারণে অনেকে চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকে। অনেকে মনে করে, চিকিৎসকের কাছে গেলে বড় কোনো রোগ ধরা পড়তে পারে। এই আতঙ্কেই অনেকে চিকিৎসকের কাছে যায় না। এমনও হয় যে সঙ্গে যাওয়ার লোক থাকে না বলে অনেকে চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে যায় না। চিকিৎসা না নেওয়ার এই প্রবণতা নারী ও পুরুষের মধ্যে যেমন আছে, তেমনি আছে শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে।
চিকিৎসাসেবার কথা উঠলেই সাধারণভাবে চোখের সামনে হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, যন্ত্রপাতি—এসবের চিত্র ভেসে ওঠে। নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা, বাজেট বরাদ্দ হয় মূলত এসবের জন্য। চিকিৎসাবিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্রেও তাই দেখা যায়। কিন্তু অধিকাংশ রোগগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিবিএসের সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে দেখা যাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে, সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, বিশেষায়িত হাসপাতালে, বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রতিষ্ঠানে ও যোগ্য চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ৪২ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেয়।
এর অর্থ, বাকি ৫৮ শতাংশ রোগী বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে নিবন্ধিত নন, এমন চিকিৎসক ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভাষায় ‘অযোগ্য চিকিৎসক’দের ব্যক্তিগত চেম্বারে ২৩ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেয়। ওষুধের দোকানদার বা কর্মচারী ও কম্পাউন্ডাররা সবচেয়ে বেশি মানুষকে চিকিৎসা দেন। চিকিৎসা নিতে আসা ৩৩ শতাংশ রোগী তাঁদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়। ২ দশমিক ২৩ শতাংশ রোগী যায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিতে। হেকিম ও কবিরাজের কাছে যায় দশমিক ৭৬ শতাংশ রোগী।
তবে যারা চিকিৎসা নিতে যায়, তারা রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরপরই চিকিৎসার জন্য যায় না। রোগে আক্রান্ত হওয়ার গড়ে চার দিন পর তারা চিকিৎসার জন্য যায়। অন্যদিকে প্রয়োজনের ৯৩ শতাংশ ওষুধ মানুষ দোকান থেকে কেনে। সরকারি হাসপাতাল থেকে ৩ শতাংশ ওষুধ রোগীরা পায়।
জানতে চাইলে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ঝাড়-ফুঁক, ওঝা, কবিরাজের কাছে রোগীদের যাওয়ার প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। মানুষ সচেতন হলে এবং দেশব্যাপী সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে সব রোগী মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাবে।
কোথায়, কীভাবে চিকিৎসা
চিকিৎসা নেওয়া বা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে চিকিৎসাকেন্দ্র বা চিকিৎসক থেকে রোগীর দূরত্ব, ব্যয় করার সামর্থ্য ও সময়। পরিসংখ্যান বলছে, বাড়ির কাছে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা চিকিৎসক না থাকায় প্রায় ২ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকে। হাঁটার দূরত্ব মানুষের পছন্দ। চিকিৎসা নিতে ৪৪ শতাংশ মানুষ হেঁটেই যায়। যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় অটোরিকশা। ২৭ শতাংশ রোগী অটোরিকশা ব্যবহার করে। ১৭ শতাংশ রোগী রিকশা বা ভ্যান ব্যবহার করে।
অবশ্য রোগী হাসপাতাল বা ক্লিনিকে পৌঁছানোর পরপরই চিকিৎসা পায় না। চিকিৎসক বা অন্য স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়। একজন রোগীকে গড়ে ১৯ মিনিট অপেক্ষায় থাকতে হয়। সবচেয়ে বেশি অপেক্ষা করতে হয় সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে। এখানে গড়ে ৫৩ মিনিট অপেক্ষায় থাকতে হয়। মাতৃ ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ৪০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। ওষুধের দোকানে যারা চিকিৎসা নেয়, তাদের অপেক্ষার সময় গড়ে ৯ মিনিট।
কোন কারণে রোগীরা নির্দিষ্ট হাসপাতাল বা চিকিৎসককে বেছে নেয় বা পছন্দ করে, তারও তালিকা দিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় হাসপাতাল বা চেম্বারের দূরত্ব। এরপরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চিকিৎসার মান। তালিকার ৩ নম্বরে আছে সেবার মূল্য।
সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যয় হিসাবের তথ্য অনুযায়ী, মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ রোগী নিজের পকেট থেকে খরচ করে। ব্যক্তির নিজস্ব খরচের ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ যায় ওষুধ কিনতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে, এটা বলার সুযোগ কম। কয়েকটি রোগের চিকিৎসায় হয়তো অগ্রগতি হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, রোগ হলে অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসাই নেয় না। নিলে হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছ থেকেই নেয় বেশি। তিনি বলেন, এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে দেশের সিংহভাগ মানুষ মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পায় না।