করোনার প্রাদুর্ভাব জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে
দেশে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম অন্যতম সফল একটি কার্যক্রম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৯। অর্থাৎ ওই সময় বাংলাদেশের একজন মা গড়ে প্রায় সাতটি সন্তানের জন্ম দিতেন। সবশেষ ২০১৭–১৮ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, টিএফআর এখন ২ দশমিক ৩। ১৯৭৫ সালে সক্ষম দম্পতির মাত্র ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৬৩ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর থেকে দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে প্রজনন হার কমেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হারও বেড়েছে। তবে একই সঙ্গে বাল্যবিবাহ, কিশোরী মাতৃত্ব, জন্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী পদ্ধতির ব্যবহার না বাড়া, পদ্ধতি গ্রহণে পুরুষের অনাগ্রহ, পদ্ধতি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা, গুজব, কুসংস্কারসহ অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান।
পরিবার পরিকল্পনা খাতের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। করোনাকালে এ কার্যক্রম কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নির্ণয়ে দ্রুত সমীক্ষা ও গবেষণা করতে হবে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে। জনগণকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি, বিশেষ করে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে কাউন্সেলর নিয়োগ দিতে হবে। সব থেকে বড় কথা হলো, এ কার্যক্রমের গুণগতমানের দিকে নজর বাড়াতে হবে। এতে মানুষের, বিশেষ করে নারীদের যাতে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের দক্ষ জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি নজরদারি জোরদার করার সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনার নেতিবাচক সামাজিক প্রভাব হিসেবে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের দেওয়া তথ্য বলছে, দেশে বাল্যবিবাহ বেড়েছে। এ কারণে মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া, অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ধারণ, অনিরাপদ গর্ভপাত, কিশোরী মাতৃত্ব, মা ও সন্তানের মৃত্যু—এ বিষয়গুলো ঘটার আশঙ্কাও বেড়ে গেছে। দেশে কিশোরী মাতৃত্বের হার দাঁড়িয়েছে ২৮। তাই করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পুরো কার্যক্রম নিয়ে সরকারের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।
এ পরিস্থিতিতে আজ ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবস। ২০০৭ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের কম। উচ্চ প্রজনন হারের এটি অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’ বলছে, ২০১৬–২০২০ এই পাঁচ বছরে দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার তেমন বাড়েনি। এ পাঁচ বছরে আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার বেড়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ অনুসারে, ৫২ শতাংশ নারী-পুরুষ আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ২০১৪ সালে তা ছিল ৫৪ শতাংশ। পদ্ধতি ব্যবহারে অনিয়মিত হয়ে পড়ার হার ২০১৪ সালে ৩০ শতাংশ ছিল। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশে। সব মিলে পরিবার পরিকল্পনা, বিশেষ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের যে অর্জন তা ধরে রাখার পথে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ বা উদ্বেগের জায়গা তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহারের আগে ব্যবহারকারীর স্ক্রিনিং—তাঁর বয়স, শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে কোন পদ্ধতি কার্যকর, তা নিশ্চিত করতে হবেমাহবুব ইলাহী চৌধুরী, বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি
ইউএসএআইডির অর্থায়নে পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের ‘সুখী জীবন’ প্রকল্পের কারিগরি পরিচালক ও পরিবার পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ মো. মাহবুব উল আলম প্রথম আলোকে জানান, এ প্রকল্পে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়ানো, পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ড্রপ আউট কমানো, স্থায়ী পদ্ধতি ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, কিশোরীসহ নবদম্পতিরা যাতে দেরিতে সন্তান নেন, এক সন্তান হয়ে গেলেও যাতে দ্বিতীয় সন্তান দেরিতে নেন—এ ধরনের বিভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সরকারকে সহায়তা করা হচ্ছে।
মাহবুব উল আলম বলেন, সুখী জীবন প্রকল্পের অধীন বিয়ের আসরে কনের হাতে সরকারের মাঠকর্মীরা একটি উপহারের বাক্স (গিফট বক্স) তুলে দিচ্ছেন। এতে একটি ঘড়ি, কনডম, পিল, বুকলেটসহ বিভিন্ন জিনিস থাকছে। এ গিফট বক্স দেওয়ার পাশাপাশি দম্পতিকে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন বিষয়ে। ১০টি উপজেলায় ছয় মাস ধরে এ কার্যক্রম চলছে। এর আগে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এ কার্যক্রমকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাইলট কার্যক্রম হিসেবে পরিচালনা করে, যার মূল্যায়নে বিভিন্ন ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়।
সুখী জীবন প্রকল্পের অধীন বিয়ের আসরে কনের হাতে সরকারের মাঠকর্মীরা একটি উপহারের বাক্স তুলে দিচ্ছেনমাহবুব উল আলম, পরিবার পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ ও কারিগরি পরিচালক, সুখী জীবন
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী মাহবুব ইলাহী চৌধুরী জোর দিলেন পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের গুণগতমান বাড়ানো ও ঢেলে সাজানোর বিষয়ে। তিনি বলেন, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহারের আগে ব্যবহারকারীর স্ক্রিনিং, অর্থাৎ তাঁর বয়স, শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে কোন পদ্ধতি তাঁর জন্য কার্যকর, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ নিয়ে সরকারের গাইডলাইন, নীতিমালা সবই আছে। দেখতে হবে এগুলো বাস্তবায়নে কোনো ঘাটতি আছে কি না। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে কারও কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি কাম্য নয়।
সন্তান জন্ম দেওয়ার পরপরই মাকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করাসহ যেকোনো পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য কাউন্সেলর নিয়োগ জরুরি মনে করেন মাহবুব ইলাহী চৌধুরী। তিনি বলেন, বর্তমানে জরুরি প্রয়োজনে ইমার্জেন্সি কনট্রাসেপটিভ পিল ব্যবহারের হার বেড়েছে। তবে এটি কত দিন পরপর ব্যবহার করতে পারবেন, ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, তা নিয়ে ব্যবহারকারীকে সচেতন করতে হবে। আর পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে প্রচারের কোনো বিকল্প নেই। আর যে কার্যক্রমই হাতে নেওয়া হোক না কেন, তার গুণগতমান নিশ্চিত করতে পারলে এ খাতের যে অর্জন, তা ধরে রাখা সম্ভব হবে।