অরুণ বসুও চলে গেলেন। মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় চলে গেলেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে খবরটি জানার পর থেকে একদিকে যেমন বেদনাহত হলাম, বিমর্ষ হলাম, পাশাপাশি বারবার মনে পড়ছে বন্ধু অরুণ বসুর সঙ্গে দীর্ঘ ২২ বছরের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য আর বন্ধুত্বের কথা।
এটা খুব কষ্টের কথা যে যখন দেশে-বিদেশে করোনার ভয়াবহতা কমে যাচ্ছে, করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নগামী, যখন এর প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়েছে এবং মানুষ টিকা নিচ্ছে, সে সময় অরুণ বসুর কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনাটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এক বন্ধুর বার্তা পেলাম, ‘সরি টু নো অ্যাবাউট অরুণ দাদা। হোয়াট আ টেরিবল টাইম!’
৬ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু ও জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন অরুণ বসু। সুস্থ হয়ে কিছুটা বিশ্রামে—হয়তো এক-দুদিন ছুটি নিচ্ছেন, বাসায় থাকছেন, আবারও অফিস করছেন—এভাবে চলছিল। আসলে কি অরুণ পুরোপুরি সুস্থ হয়েছিলেন? ৪ অক্টোবর পেলাম তাঁর কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ।
অরুণ বসু নেই। একটি বড় শূন্যতা তৈরি হলো আমার চারপাশে। অরুণের সঙ্গে যদি আরেকটু সময় নিয়ে জীবনের গল্প করা যেত, তাহলে আরও একটু ভালো হতো। কত কিছু অজানা রয়ে গেল অরুণ বসুর। কিন্তু আর তো কোনো সুযোগ রইল না!
এমনিতে বেশ কিছুদিন ধরে অরুণ বসু খুব সুস্থ ছিলেন না। ঠান্ডা-কাশির প্রকোপ ছিল। ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন, উচ্চ রক্তচাপও ছিল; ২০০৭ সালে ওপেন হার্ট সার্জারি হয় তাঁর। শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন তিনি।
২.
প্রথম আলোতে যোগ দেওয়ার আগে অরুণ বসুকে আমি জানতাম না। প্রথম আলো বের হওয়ার পাঁচ মাস পর সম্পাদকীয় সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে আমাদের সঙ্গে বহুমুখী কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। আমাদের অনেক কাজের মধ্যে প্রথমা প্রকাশন শুরু হয়েছিল তাঁরই হাত ধরে। সর্বশেষ তিনি প্রথমা প্রকাশনে সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন।
অরুণ আবৃত্তি করতেন দারুণ। লেখক ও শিক্ষক কুদরত-ই-হুদা গতকাল বলছিলেন, ‘অরুণদা আবৃত্তি করতেন—রবীন্দ্রনাথের “বিদায় অভিশাপ” কবিতা, ইডিপাস নাটকের ইডিপাসের দীর্ঘ সংলাপ, বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের প্রায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবন্ধ, তপন রায়চৌধুরীর আত্মজীবনী থেকে দীর্ঘ দীর্ঘ অংশ।’
প্রথম আলোতে নিজে লিখেছেন, আবার সম্পাদকীয়, বার্তা বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন লেখার সংশোধন করা বা শিরোনাম দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন অরুণ বসু। আমাদের নানা অনুষ্ঠান, বিশেষ করে ভাষা প্রতিযোগের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে ছিলেন গভীরভাবে। ভাষা প্রতিযোগ সফল করতে ঢাকাসহ সারা দেশে তাঁর ভূমিকা ভোলার নয়। সেসব অনুষ্ঠানে বিচিত্র বিষয়ে কথা বলে বা আবৃত্তি করে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের শান্ত করার এক সহজাত ক্ষমতা ছিল অরুণের।
ঢাকা ও কলকাতার বিশিষ্ট সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল অরুণের। বাংলাদেশে সন্জীদা খাতুন, আনিসুজ্জামান, জামিল চৌধুরীসহ আরও অনেকের এবং কলকাতায় সম্প্রতি প্রয়াত শঙ্খ ঘোষ, দেবেশ রায়, অরুণ সেন প্রমুখের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সখ্য ছিল। সাহিত্যসহ বিচিত্র বিষয়ে তাঁর পাঠ ছিল অতুলনীয়। এসব নিয়ে তিনি কথা বলতেন, বিশেষ মতামতও দিতেন। অরুণ আবৃত্তি করতেন দারুণ। লেখক ও শিক্ষক কুদরত-ই-হুদা গতকাল বলছিলেন, ‘অরুণদা আবৃত্তি করতেন—রবীন্দ্রনাথের “বিদায় অভিশাপ” কবিতা, ইডিপাস নাটকের ইডিপাসের দীর্ঘ সংলাপ, বিষাদ-সিন্ধু উপন্যাসের প্রায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবন্ধ, তপন রায়চৌধুরীর আত্মজীবনী থেকে দীর্ঘ দীর্ঘ অংশ।’
প্রথম আলোর বাইরেও অরুণ বসু দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ প্রগতিশীল রাজনীতিতে—প্রথমে ফরিদপুরে, পরে ঢাকায় ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল। এ সময় নির্যাতন চালানো হয় তাঁর ওপর। এক পুলিশের (নিম্নপদস্থ) সহায়তায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। সে সময় অরুণ দশম শ্রেণির ছাত্র।
প্রথম আলোর নিয়মিত-অনিয়মিত কাজগুলোর বাইরেও আমার নিজের বহুমুখী কাজ—সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে সাংগঠনিক কাজ বা লেখালেখি—নানা ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা থাকত অরুণ বসুর। আমার কত লেখার যে শেষ পাঠ করেছিলেন বন্ধু অরুণ, তার হিসাব নেই।
আপাদমস্তক একজন আড্ডার মানুষ, গল্পের মানুষ ছিলেন অরুণ। অনেক আড্ডা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। চা পান করতে করতে বা দুপুরের খাবার খেতে খেতে দীর্ঘ আড্ডা দিয়েছি আমরা। এই মহামারিকালেও আমাদের সে আড্ডা অব্যাহত ছিল। এর মধ্যেও অনেকবার আমার বাড়িতে গল্প করতে একত্র হয়েছি। সঙ্গে কখনো ছিলেন বিদায়ী বন্ধু আবুল হাসনাত, কখনো আলতাফ পারভেজ, জাভেদ হুসেন বা পিয়াস মজিদ। কত কথা যে হয়েছে সেসব আড্ডায়।
৩.
আজ অরুণ বসু যখন আমাদের মাঝে নেই, মনে হচ্ছে, আমার লেখালেখির প্রস্তুতির শেষ পাঠকটিকে হারালাম। এমন এক বন্ধুকে হারালাম, যাঁর সঙ্গে বিশেষ আত্মিক সম্পর্কই শুধু নয়, সম্পর্ক ছিল বিশেষ বন্ধুত্বের; যাঁর সঙ্গে সব বিষয়ে কথা বলা যেত। যখন অরুণ নেই, তখন ভাবছি, শরীর-স্বাস্থ্য বা কাজের ব্যাপারে অরুণ বসু আরেকটু নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে থাকলে ভালো হতো। এসব নিয়ে আমাদের অনেক তর্ক-বিতর্ক, মান-অভিমানও হয়েছে। কিন্তু কেউ যেভাবে গড়ে ওঠে, সেটার কি আর পরিবর্তন করা যায়? জানি না। শেষের দিকে হয়তো সে চেষ্টা করেছিলেন অরুণ। এখন সেসব কথা বড় বেশি করে মনে পড়ছে।
অরুণ বসু নেই। একটি বড় শূন্যতা তৈরি হলো আমার চারপাশে। অরুণের সঙ্গে যদি আরেকটু সময় নিয়ে জীবনের গল্প করা যেত, তাহলে আরও একটু ভালো হতো। কত কিছু অজানা রয়ে গেল অরুণ বসুর। কিন্তু আর তো কোনো সুযোগ রইল না!
অরুণ বসু নেই। এটা মেনে নেওয়া যায় না। এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। তারপরও বিদায় নিতে হয়। এটাই নিয়ম জীবনের।
অরুণ বসুর জন্য ভালোবাসা। বউদি কবিতা গোস্বামী ও ছেলে মেঘমল্লার বসুর প্রতি আমাদের সমবেদনা।