রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনিসহ শীর্ষ নেতাদের নাম না থাকায় কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
কুতুপালং ক্যাম্পের মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) জালাল আহমদ বলেন, আরসা প্রধান আতাউল্লাহর নির্দেশে এবং আরসা কমান্ডার মাস্টার আবদুর রহিমের নেতৃত্বে সশস্ত্র ওই সংগঠনের নেতা–কর্মীরা প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে। হোতাদের বাদ দেওয়ার কারণ তিনি বুঝতে পারছেন না।
আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে ক্যাম্পজুড়ে রোহিঙ্গাদের মুখে মুখে আতাউল্লাহ, আরসার সহযোগী সংগঠন উলামা কাউন্সিল নেতা ওস্তাদ হাশিম, ওস্তাদ খালিদ, মাস্টার আবদুর রহিমকে নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের দুজন রোহিঙ্গা মাঝি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আতাউল্লাহর ঠিকানা জানা না থাকলেও অভিযোগপত্রে আসামি করা যেত। কিন্তু মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনা থেকে মূল হোতাদের দূরে রাখার পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। এখন ক্যাম্পের ভেতরে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। ক্যাম্পের অলিগলিতে এখনো আরসার শত শত নেতা–কর্মী ও সমর্থক রয়েছে।
সাজেদা বেগম (৪৫) নামে এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘মুহিবুল্লাহ সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে আমরা দ্রুত মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যেতে পারতাম। এখন সে আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। মুহিবুল্লাহর মতো বিচক্ষণ নেতা আর তৈরি হবে না। আমরা রোহিঙ্গারা মুহিবুল্লাহ হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ফাঁসি চাই।’
গতকাল সোমবার কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আরসার ২৯ নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজী সালাহ উদ্দিন। ২৯ জনের মধ্যে ১৫ জন জেলা কারাগারে বন্দী। মুহিবুল্লাহকে প্রথম গুলি চালানো মাস্টার আবদুর রহিমসহ ১৪ জন ঘটনার পর থেকে পলাতক।
নাম–ঠিকানা শনাক্ত না হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে হামলার ঘটনায় নির্দেশদাতা আরসার প্রধান আতাউল্লাহ, ওস্তাদ খালেদ ওরফে খালিদ, ওস্তাদ হাশিম, ইব্রাহিম, আলমগীর, শুভ ওরফে আলমগীর, মৌলভী মোস্তাকসহ সাতজনের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। যদিও আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কয়েকজন আসামি (আরসা সদস্য) মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় আতাউল্লাহর সম্পৃক্ত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন।
অভিযোগপত্র থেকে আতাউল্লাহসহ সাতজনের নাম বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও উখিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক গাজী সালাহ উদ্দিনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি কল রিসিভ করেননি।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি থানায় যোগ দিয়েছেন মাত্র কয়েক দিন আগে। ঘটনার কিছুই তিনি জানেন না।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের সময় রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৫ জনের মধ্যে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ১৪ এপিবিএন। গত ১৬ জানুয়ারি অস্ত্র, মাদক, টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয় আরসা নেতা শাহ আলীকে (৫৫)। তিনি আরসার প্রধান নেতা আতাউল্লাহর আপন ভাই। তবে তাঁকে মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়নি।
১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার মো. নাঈমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আতাউল্লাহর ভাই হলেও শাহ আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল অপহরণের ঘটনায়। তা ছাড়া তিনি মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। আতাউল্লাহসহ আরসার আরও সাতজন চিহ্নিত নেতাকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসামির পুরোপুরি নাম–ঠিকানা শনাক্ত না হলে অভিযোগপত্রে নাম রাখা যায় না। মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার অভিযোগপত্রেও তা–ই হয়েছে।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়া মাস্টার আবদুর রহিমসহ পলাতক ১৪ আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে মাস্টার আবদুর রহিমসহ অন্যরা সীমান্ত (নাফ নদী) পাড়ি দিয়ে মিয়ানমারে আত্মগোপন করেছে। এখনো তারা সেখানে আছে বলে খবর পাচ্ছি। অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়লেও তাদের আর আশ্রয়শিবিরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ক্যাম্পজুড়ে কড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আছে।’