বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন আদালত। বুধবার দুপুরে শুনানি শেষে অভিযোগপত্র আমলে নেন বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম সিরাজুল ইসলাম গাজী।
অভিযোগপত্রের সঙ্গে রিফাত শরীফকে কোপানোর ঘটনায় প্রকাশ পাওয়া দ্বিতীয় ভিডিওটি আদালতে আলামত হিসেবে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন করে প্রকাশ পাওয়া কোপানোর পর সরকারি কলেজের সামনে থেকে স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা রক্তাক্ত রিফাতকে রিকশায় করে বরগুনার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ভিডিওটি আলামত হিসেবে আদালতে জমা দেয়নি পুলিশ।
অভিযোগপত্র গ্রহণের পর এই মামলার প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শার বাবা মোজাম্মেল হোসেন অভিযোগ করেছেন, ‘আমরা কোনোভাবেই এ অভিযোগপত্র মানি না। এটা পুলিশের মনগড়া, বানোয়াট ও ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্র। একটি প্রভাবশালী মহল থেকে আয়শাকে এই মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পুলিশকে প্রভাবিত করা হয়েছে। আমরা এই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব’।
গত ১ সেপ্টেম্বর আলোচিত এই মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে প্রধান সাক্ষী নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাসহ ২৪ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বরগুনা থানার পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। এতে আয়শাকে ৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে আয়শাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ আনে পুলিশ।
আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক আসামিদের জন্য আলাদাভাবে তৈরি করা অভিযোগপত্রটি জমা দেওয়ার পর মামলার মূল নথি জেলা জজ আদালতে থাকায় শুনানি হয়নি। ফলে অভিযোগপত্রটি আদালতের উপনথিতে শামিল ছিল। মামলায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক ১৪ জন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক ১০ জনকে আসামি করে এই মালায় পৃথক দুটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। সূত্র বলছে, বিচারক অভিযোগপত্র গ্রহণের পর মামলার চার্জ গঠনের জন্য আগামী ৩ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন। ওই দিন সব আসামিকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বুধবার আয়শাসহ মামলার আট আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
অভিযোগপত্র গ্রহণের পূর্ব নির্ধারিত তারিখ ধার্য থাকায় সকাল সাড়ে নয়টায় বাবার মোটরসাইকেলে করে আদালতে আসেন আয়শা। এ সময় আয়শাকে বিষণ্ন দেখায়। সকাল ১০টার দিকে প্রিজনভ্যানে বরগুনা কারাগার থেকে এই মামলার অপর সাত আসামি রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী, আল কাইউম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজোয়ান আলী খান ওরফে টিকটক হৃদয়, হাসান, রাফিউল ইসলাম ওরফে রাব্বি ও সাগরকে আদালতে আনা হয়। এই মামলায় জামিনে থাকা অপর আসামি আরিয়ান শ্রাবণও তাঁর অভিভাবকের সঙ্গে আদালতে আসেন। তবে মামলার মূল নথি জেলা জজ আদালতে থাকায় নির্ধারিত সময়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। পরে নথি জেলা জজ আদালত থেকে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে আসার পর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
বিচারক অভিযোগপত্র গ্রহণের পর এই মামলার পলাতক নয় আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে গ্রেপ্তার থাকা ছয় আসামির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। মামলার কার্যক্রমের শুরুতে আদালত অপ্রাপ্ত বয়স্কদের অভিযোগপত্রটি আমলে নিয়ে সেটি শিশু আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আগামী রোববার শিশু আদালতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক আসামিদের জন্য করা অভিযোগপত্রটি গ্রহণের ব্যাপারে শুনানি হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মজিবুল হক বলেন, অভিযোগপত্র নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। তাই আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের অভিযোগপত্রটি শিশু আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী রোববার শিশু আদালতে পুনরায় সেটি গ্রহণের ব্যাপারে শুনানি হবে।
এ দিকে অভিযোগপত্র গ্রহণের পর আয়শার বাবা প্রথম আলোকে বলেছেন, পুলিশের মনগড়া এই অভিযোগপত্রকে আমি আগেই প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ এই মামলায় আমার মেয়েকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আসামি করেছে। একটি প্রভাবশালী মহলের ইন্ধনে এটা করা হয়েছে। রিফাত হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ আড়াল করতে এবং মামলার মান (মেরিট) নষ্ট করার জন্য এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একমাত্র সাক্ষী আয়শাকে আসামি করেছে পুলিশ। তিনি আরও বলেন, নিহত রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ সরকারি কলেজের সামনে কোপানোর ঘটনার দ্বিতীয় ভিডিও ফুটেজ দেখে আয়শা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে অভিযোগ করেছিলেন। তবে সম্প্রতি হাসপাতালের একটি ভিডিও ফুটেজে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে আয়শাই আহত রিফাতকে রিকশায় করে হাসপাতালে আনার দৃশ্য দেখা যায়। এতে আবদুল হালিমের দাবি অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমরা এই বানোয়াট অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
গত সোমবার প্রকাশ পাওয়া নতুন ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ২৬ জুন সকাল ১০টা ২১ মিনিটে আয়শা সিদ্দিকা একাই একটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে রক্তাক্ত ও অচেতন রিফাত শরীফকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে নিয়ে যান। এই ভিডিও প্রকাশের পর রিফাত হত্যা মামলা নিয়ে আলোচনায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। কারণ রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ ঘটনার ১৮ দিন পর গত ১৩ জুলাই বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন, হত্যাকাণ্ডের পর আয়শা তাঁর রক্তাক্ত স্বামী রিফাতকে ফেলে চলে যান, হাসপাতালে নিয়ে যাননি। রিফাতকে হত্যার পেছনে আয়শার হাত আছে। এই অভিযোগের পর পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামিদের ধরার চেষ্টা বাদ দিয়ে আয়শাকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ডেকে এনে গ্রেপ্তার করে। ঘটনার একমাত্র সাক্ষী আয়শাকে পুলিশ আসামিও করে।
এ দিকে আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রের সঙ্গে পুলিশ বিভিন্ন আলামত আদালতে জমা দিলেও হাসপাতালে আনার ওই ভিডিওটি এর মধ্যে নেই। বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের জেনারেল রেজিস্ট্রার (জিআরও) পরিদর্শক মো. হান্নানুর প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কোনো ভিডিও ফুটেজ আদালতে জমা দেওয়া হয়নি।
আয়শার আইনজীবী মাহবুবুল বারী বলেছেন, ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওই ভিডিওটি আদালতে আলামত হিসেবে জমা দিয়েছেন কি না সেটা জানি না। তবে ওই ভিডিওটি এই মামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুলিশ এটা আদালতে জমা না দিলেও আমরা মামলার চার্জ গঠনের সময় এটা আদালতে উপস্থাপন করব।’
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মে. হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, আমরা ওই ভিডিওটি আগে পাইনি। তা ছাড়া এই মামলার অভিযোগ প্রমাণের জন্য ওই ভিডিওটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, বাদী মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, আয়শা রিফাতকে কলেজের সামনে থেকে রিকশায় করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ঘটনাস্থল থেকে জুতা ও ব্যাগ গুছিয়ে হাতে নিয়ে তিনি (আয়শা) পরে রিকশায় উঠেছিলেন।
গত ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফকে তাঁর স্ত্রী আয়শার সামনে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে সন্ত্রাসীরা। এরপর তাঁকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর ওই দিন বিকেলে মারা যান রিফাত শরীফ। পরদিন ২৭ জুন নিহত রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বাদী হয়ে বরগুনা থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেন। পরে মামলার অন্যতম আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।