অভাব তাঁকে টেনে নেয় ভারতের যৌনপল্লিতে

মানসিক আঘাতে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে চেয়েছেন এই তরুণী
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রামের এক বাড়িতে থাকতেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক ইদ্রিস মিয়া আর তাঁর পরিবার। পরিবার মানে ইদ্রিস মিয়ার স্ত্রী আর তাঁদের ছোট্ট এক মেয়ে। আশপাশের মানুষ বাচ্চাটা দেখলেই কোলে তুলে নিতে চায়। কেউ বলে চীনা পুতুলের মতো শিশু। অটোরিকশা চালিয়ে রাতে ফেরার পথে বাবা নিয়ে আসেন মেয়ের পছন্দের খাবার। সন্ধ্যায় চুল বেঁধে দেন মা। মেয়ে বড় হয়, মায়া জড়ায়। আধো বুলির টানে কোনো কোনো দিন কাজ না সেরেই বাড়ি ফেরেন ইদ্রিস মিয়া। তিনজন মানুষের এই সুখের গল্পের বয়স প্রায় এক যুগের। পরিবারটিতে এল আরও এক সন্তান। কিছুদিনের ব্যবধানে তৃতীয়জন। চীনা পুতুলের মতো শিশুটির বয়স ১৪ হয়েছে এর মধ্যে।

যৌনপল্লিতে থাকতে একপর্যায়ে নিজের ওপর অত্যাচার করেছেন নিজেই

এর কিছুদিন পরই মেয়েটার জায়গা হলো আরেক জেলার বস্তির ঘরে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক শহরের বস্তির ওই ঘরে পাঁচজন মানুষের গাদাগাদি অবস্থান। আশপাশের অন্য সব ঘর থেকে তেমন ভিন্ন কিছু নেই। দিনমজুর আবদুর রহমানের (ছদ্মনাম) চার সন্তানের খাবারই জোটে না আর তো ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকেন। হঠাৎ করে এই পরিবারে এসে অভাবের সাগরে হাবুডুবু খেতে শুরু করলেন চট্টগ্রামের সেই মেয়েটি। কিছুদিন আগেও যাঁর জীবন ছিল অন্য রকম।

তিনজন মানুষের এই সুখের গল্পের বয়স প্রায় এক যুগের। পরিবারটিতে এল আরও এক সন্তান। কিছুদিনের ব্যবধানে তৃতীয়জন। দ্রুত বদলাতে শুরু করল প্রথম সন্তানের অবস্থান।

চট্টগ্রামের ইদ্রিস পরিবারে আরও দুই সন্তান আসার পর বদলে যায় প্রথম সন্তান তাসলিমার (ছদ্মনাম) অবস্থান। পান থেকে চুন খসলেই গালি, ভাতের খোঁটা দিনরাত চলে। বাস্তবিকই হোঁচট খেলেন তাসলিমা। নতুন সন্তানদের জন্য ভালোবাসা আর আগের সন্তানের প্রতি বিদ্বেষ যেন বাড়ছিল প্রতিদিন। প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেওয়া হতো, তাঁর জন্য খরচ অনেক। অবশেষে একদিন প্রকাশ্য হলো ১৪ বছর ধরে জানা সম্পর্কটা মিথ্যা। ঝোপের ভেতর থেকে হিংস্র বাঘ বেরিয়ে আসার মতো গালাগালির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক শব্দ ‘পালক মেয়ে’।

বিয়ের দীর্ঘদিন পরও সন্তান না হওয়ায় ইদ্রিস দম্পতি সন্তান দত্তক নিয়েছিলেন। ভোলার একই উপজেলায় ভিন্ন দুই ইউনিয়নে দুই পরিবারের বসতি। তাসলিমার আসল বাবা দিনমজুর আবদুর রহমান। চার সন্তান নিয়ে তখন তাঁর বিপন্ন অবস্থা। তিনি মেজ মেয়েটি দিয়ে দিলেন নিঃসন্তান দম্পতির কাছে।

জীবিকার প্রয়োজনে ইদ্রিস দম্পতি চলে গেলেন চট্টগ্রামে। নিজেদের সন্তানের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু দীর্ঘদিন পর তাঁদের দুটি সন্তান হলো অল্প সময়ের ব্যবধানে। তখনই গুরুত্বহীন হয়ে বরং বোঝা হলো আদরের তাসলিমা। প্রতিদিন মারধর আর বকাবাজির চেয়েও বেশি আঘাত দিত, মা–বাবার স্নেহের হাতটা মাথার ওপর থেকে সরে যাওয়ার কষ্ট। অনেক চেষ্টা করেও আর তাঁদের মনোযোগ টানতে পারেন না তিনি। বিধ্বস্ত হয়ে যান মানসিকভাবে। একবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন। তখন বয়স ১৫ বছরের মতো।

পালক মা–বাবার দেশের বাড়ি তাসলিমার আসল মা–বাবার বাড়ির কাছে। ইদ্রিস দম্পতি ভোলার বাড়িতে তিন সন্তান নিয়ে গিয়েছিলেন কয়েক দিন থাকতে। পরিবারের কাছ থেকেই তাসলিমা সংগ্রহ করে তাঁর আসল মা–বাবার ঠিকানা, পরিচয়। সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে বেশি নির্ভরতার মানুষ দুজনের এই পরিবর্তন আর সামলাতে পারেনি কিশোরী।

তাসলিমা চলে আসেন নিজের মা–বাবার কাছে নিদারুণ অভাবের সংসারে। নিজের মা–বাবা সন্তানকে আদর করলেও এটুকু বুঝতে কষ্ট হয় না, আরেকটি খাবারের মুখ জুটে যাওয়ায় বিপত্তি আরও বেড়েছে আবদুর রহমানের পরিবারের।

ইটভাটায় কাজ করা বড় ভাই তত দিনে বিয়ে করে পৃথক সংসারে থাকেন। সম্প্রতি তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী রুমা ভারতের বেঙ্গালুরুতে গিয়েছেন। সেখানে আগে থেকেই গিয়ে একটি দোকানে কাজ করছেন রুমার ফুফু আর বড় বোন। রুমা মাঝেমধ্যে মুঠোফোনে কথা বলেন স্বামীর সঙ্গে। সে সুবাদে ননদের সঙ্গেও আলাপ হয়। ভাবি তাঁকে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখান। ভাবি বলেন, বেঙ্গালুরুর একটি শাড়ি তৈরির দোকানে চুমকি বসানোর কাজ করে মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন পান তিনি।

দালালের মাধ্যমে পৌঁছাতে পারলে একই কাজ তাসলিমাও পাবেন বলে আশ্বাস দেওয়া হয়। যেতে রাজি হলে রুমার ফুফু এসে নিয়ে যাবেন তাঁকে। আসলে রুমার ফুফু নিজেই একজন মানব পাচার চক্রের দালাল। আবদুর রহমানের পরিবার এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও একপর্যায়ে রাজি হয়ে যায়।

২০১৯ সালের শেষ দিকে বড় ভাবি রুমার ফুফুর সঙ্গে তিনি রওনা হন ভারতের বেঙ্গালুরুতে। পৌঁছানোর পর প্রথম দিনই তাসলিমা জানতে পারেন, যৌনপল্লিতে বিক্রি হয়েছেন তিনি। তাঁকে নিয়ে আসার জন্য অর্থ পেয়েছেন ভাবি। রুমা, তাঁর বড় বোন আর ফুফু তিনজনই এ পেশার সঙ্গে জড়িত। পরিবারের কাছে শাড়িতে চুমকি বসানোর কাজের কথা পুরোটাই বানোয়াট।

‘ফোনে যোগাযোগের সুযোগ ছিল না। কথা না শুনলেই মারত। অবৈধভাবে প্রবেশ বলে পুলিশ পেলে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখানো হতো।’

বেঙ্গালুরুতে শুরু হয় তাসলিমার জীবনের আরেক অধ্যায়। প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় কান্নাকাটি, প্রতিবাদ। যশোরের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয়ে বসে তাসলিমা বলছিলেন, ফোনে যোগাযোগের সুযোগ ছিল না। কথা না শুনলেই মারত। অবৈধভাবে প্রবেশ বলে পুলিশ পেলে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখানো হতো। যৌনপল্লির অপরিচিত নারীদের কেউই এগিয়ে আসেননি তাঁর জন্য।

সেখানে তাঁকে বিশেষ একটি ইনজেকশন দেওয়া হয় জানিয়ে তাসলিমা বলেন, ‘কয়েক ঘণ্টা থাকত এর প্রভাব। ওই সময়টুকু মনে হয় আমি অন্য মানুষ হয়ে যেতাম। প্রথম দিকে নেশাগ্রস্ত লাগত। চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতাম, সবকিছু ঘুরতে থাকত। কারও কথার প্রতিবাদ তো দূরের কথা, মারলেও মনে হয় গায়ে লাগত না। একা আমার আসলে কী করার ছিল, জানি না। দিনরাত নানা বয়সী কাস্টমার আসে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন হোটেলে নিয়ে যায়।’

এ সময় নিজেকে নিজেই নানাভাবে শাস্তি দিতেন বলে জানান তাসলিমা। সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, ‘মোমবাতির আগুন দিয়ে হাত পুড়িয়ে সেখানে ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটেছি। তবু মনের যন্ত্রণা কমত না। আসলে আমি একটা পুতুল হয়েছিলাম আপা। একবার জানলাম, জন্ম থেকে চেনা মা–বাবা আমার আপন না। এরপর ভালো থাকার জন্য কাজ করতে গিয়ে জানলাম, ওটা যৌনপল্লি। ওখানকার কম বয়সী সব মেয়েই এক একজন বোবা পুতুল।’

পাচারের এক বছর দুই মাস পর বেঙ্গালুরুর ওই যৌনপল্লিতে পুলিশের তল্লাশিতে ধরা পড়েন তাসলিমা, ভাবি রুমাসহ আরও কয়েকজন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‌‘জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার’–এর মধ্যস্থতায় ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন তাসলিমা। দেড় মাস পর ভোলায় মানব পাচারের মামলা করে তাঁর পরিবার। সেদিনই গ্রেপ্তার করা হয় ভাবি রুমা আর তাঁর ফুফুকে। রুমার ফুফু জামিনে বের হয়ে গেলেও রুমা এখন কারাগারে। শুনানির তারিখ হয়, তবে এখনো মামলাটি প্রক্রিয়াধীন।

২০২১ সালের ১৮ জুন প্রথম আলোয় ‘ভারতে পাচার ২ হাজার নারী ফিরেছে ১০ বছরে’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালে মানব পাচারের মাত্র ১৪টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে সাজা হয়েছে একটিতে।

সুতরাং এই মানব পাচার মামলায় শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে প্রথম আলোকে তাসলিমা বললেন, তিনি শেষ পর্যন্ত লড়াই করবেন। অন্তত একটা মামলায়ও যদি শাস্তি হয়, তাহলে অন্য পাচারকারীরা ভয় পাবে।

বস্তির ঘরগুলো লাগোয়া। মা–বাবার সম্মানের কথা ভেবে তাসলিমা আর বাড়ি ফিরে যাননি কখনো। জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় তিনি এখন থাকেন একটি জেলা শহরে। সেখানকার হস্তশিল্প নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থায় ছয় মাস প্রশিক্ষণ শেষে এখন এটিই তাঁর কর্মস্থল।

যৎসামান্য আয় করেন মেয়েটি। কিন্তু ওই টাকার ভেতর থেকে তিনি শখ করে পুঁতির গয়না কিনে হাতে দেন। আঙুলে মেহেদি লাগান। তাঁর হাতের মেহেদির নকশার ঠিক ওপরেই দগদগ করে কাটা পোড়া এক দাগ।

কাপড়ের পুতুল বানাতে ভালো লাগে তাসলিমার। তিনি পুতুল বানিয়ে নিজেই অবাক হয়ে দেখেন এখন।