নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। তাই ভোট নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের ইতিবাচক বক্তব্য দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সম্পাদকেরা। এ ছাড়া নির্বাচন বর্জন না করে ভোটের মাঠে থাকারও পরামর্শ দেওয়া হয়। সব ধরনের বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে নির্বাচনে থাকার কথা জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। তাঁরা বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। বেলা সাড়ে তিনটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার আলোচনায় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে গণমাধ্যমের সহযোগিতা চান ঐক্যফ্রন্টের নেতারা।
বৈঠক শেষে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে বাধা ও করণীয় জানতেই মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। আড়াই ঘণ্টা ধরে সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য তাঁরা তাঁদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। আমাদের কাছ থেকে তাঁরা কী প্রত্যাশা করেন, তা-ও জানিয়েছেন। আজ যেসব মতামত পেলাম, তা অনেক মূল্যবান। তাঁরা বিভিন্ন ব্যাপারে মতামত দিয়েছেন এবং আমাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমরা আশা করি, নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে সম্পাদকেরা সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।’
ড. কামাল আরও বলেন, জনগণ সত্যিকার অর্থে নির্ভয়ে, স্বাধীনভাবে যাতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সে নিয়ে কথা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের যেমন কর্তব্য আছে, যাঁরা বিরোধী আছেন, তাঁদেরও কর্তব্য আছে।
ওই সময় তাঁর পাশে থাকা ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা চেয়েছি।’
মতবিনিময়ের আলোচনা
একাধিক সূত্র জানায়, আলোচনার শুরুতে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, জাতির মধ্যে বিভাজন থাকলেও সবাই অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে কী কী বাধা রয়েছে এবং তা থেকে মুক্তির উপায় জানতে চান সম্পাদকদের কাছে।
এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশ নিতেই ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে দুই দফা সংলাপে গিয়ে সাত দফা দাবি তুলে ধরেছেন। কোনো দাবি পূরণ হয়নি। মামলা ও গ্রেপ্তার বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতিও রাখা হয়নি। পরিবেশ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অনুকূল নয়। সরকারের অনুগতদের নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির পোলিং এজেন্টদের আসামি করা হচ্ছে।
সম্পাদকদের মধ্যে শুরুতেই দৈনিক আমাদের অর্থনীতির সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান প্রশ্ন করেন, নির্বাচনের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকীর উৎসব হবে, তারা জয়ী বা পরাজিত হলে তা কীভাবে পালন করবেন। আর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর প্রশ্ন ছিল, ঐক্যফ্রন্ট যদি জয়লাভ করে তাহলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখনো ঐক্যফ্রন্টের কেউ কেউ নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক কথা বলছেন। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচন পেছাতে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন কমিশনে যাওয়া ও পেছানোর কারণ হিসেবে ঐক্যফ্রন্টের ব্যাখ্যা অনেক মানুষ পছন্দ করেনি।
সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, তফসিল ঘোষণার পর মন্ত্রী ও সাংসদদের সুবিধা বন্ধ হয়নি। নির্বাচন কমিশনের আচরণবিধি মেনে চলার কথা। সামনে হয়তো ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা ও গ্রেপ্তার আরও বাড়বে। তখন ঐক্যফ্রন্ট কী করবে? এ ছাড়া ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্র কীভাবে চালাবেন, কী ধরনের পরিবর্তন আনবেন, তা পরিষ্কার করে বলার পরামর্শ দেন নেতাদের।
যুগান্তর-এর মাসুদ করিম বলেন, ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যসহ বেশ কিছু বিষয়ে ভারতের উদ্বেগ আছে, জামায়াতের বিষয়েও ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার।
নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, বিরোধী দল সব সময় ক্ষমতায় যেতে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। সরকারে গেলে অবস্থান বদলে ফেলে। নির্বাচন অবাধ করার দায়িত্ব সংবাদপত্রের নয়, এ দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। ভোটের বাক্স পাহারার দায়িত্ব ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীদেরই নিতে হবে।
মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, মানুষ ভোট দিতে চায়, পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। ভোট নিয়ে আশঙ্কা দূর না হলে মানুষ জনসভায় আসবে, কিন্তু ভোটকেন্দ্রে যাবে না।
ভয়েস অব আমেরিকার-এর প্রতিনিধি আমির খসরু বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে তা এক দিনের জন্য নয়, প্রতিদিনের জন্য।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ভিন্ন ভিন্ন মতের মানুষদের তৈরি মঞ্চ (ঐক্যফ্রন্ট) একটা বড় অগ্রগতি। তবে সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু নির্বাচন অবশ্যই দরকার। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা দুবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে গেছেন, প্রয়োজনে আরও যেতে পারেন। দুবার নির্বাচন কমিশনে গেছেন, প্রয়োজনে আরও যেতে পারেন। এতে করে দেশবাসী ঐক্যফ্রন্টের দাবি সম্পর্কে জানতে পারবে। এ ছাড়া সংলাপ থেকে কিছু না পাওয়ার বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে মতিউর রহমান বলেন, সভা-সমাবেশ করতে পারছে ঐক্যফ্রন্ট, এটা অগ্রগতি। যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে যেতে হবে। ২০১৪-এর নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বিএনপির বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এতে দেশের ক্ষতি হয়েছে।
সম্পাদকদের বিভিন্ন প্রশ্ন ও মতামতের পর ড. কামাল বলেন, পাঁচ বছর ধরে দেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি। বাধা দূর করে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করতে হবে। অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি বড় চ্যালেঞ্জ।
এরপর ঐক্যফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, চ্যালেঞ্জ মনে করেই নির্বাচনে এসেছেন। জনগণের পক্ষ থেকে যে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সব চ্যালেঞ্জ প্রতিরোধ করা যাবে।
বিএনপির মওদুদ আহমদ বলেন, সরকারের সাংসদ ও মন্ত্রীরা সরকারি সুবিধা নিচ্ছেন। সমান সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।
মির্জা ফখরুল বলেন, ইভিএম নিয়ে ইসি অনেক আগ্রহী। ইভিএম দিয়ে ভোট কারচুপি করা সহজ। এটা ঐক্যফ্রন্টের নজরে আছে।
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে বিএনপির খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জেএসডির আ স ম আবদুর রব, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং সম্পাদকদের মধ্যে ঢাকা ট্রিবিউন-এর সম্পাদক জাফর সোবহান, সাপ্তাহিক হলিডে-এর সৈয়দ কামালউদ্দিন, রয়টার্সের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম কাদির, এএফপির শফিক আলম, ডেইলি স্টার-এর সাখাওয়াত লিটন ও ইনকিলাব-এর মুন্সী আবদুল মান্নান।