বহুল প্রতীক্ষিত ও স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সড়কপথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপিত হলো। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা আশা করছেন, এখন ওই অঞ্চল থেকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য গন্তব্যে আরামদায়ক ও বিলাসবহুল বাস চালু হবে। তবে পরিবহন কোম্পানিগুলো দেখেশুনে পদ্মা সেতু হয়ে এসব গন্তব্যে নতুন বাস নামাতে চায়।
এরই মধ্যে ১৯ জুন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) পদ্মা সেতু হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলকারী বাসের নতুন ভাড়া নির্ধারণ করেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) কাছ থেকে নেওয়া দূরত্ব এবং বিদ্যমান ফেরি ও সেতুর টোলের হালনাগাদ তালিকা ধরে এ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাদারীপুর হয়ে বরিশালের দূরত্ব ১৫৬ কিলোমিটার। এ পথে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪২১ টাকা। এ পথে পদ্মা সেতু ছাড়াও চারটি জায়গায় ৫৩০ টাকা টোল দিতে হয়। ঢাকা থেকে পিরোজপুরের (২০৬ কিলোমিটার) ভাড়া ৫৩২ টাকা। ঢাকা থেকে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার দূরত্ব ২৭৬ কিলোমিটার। এ পথে নতুন ভাড়া ৭০১ টাকা।
বিআরটিএর এই ভাড়ার তালিকা নন-এসি বা সাধারণ বাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এসি বাসের ভাড়া বাসমালিকেরা ঠিক করেন।
পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাসের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি। তারা পদ্মা সেতু হয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) ও নন-এসি দুই ধরনের বাসই নামাবে। বিদ্যমান বাসের বাইরে নতুন ৬০–৭০টি বাস বিভিন্ন পথে চালুর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন থেকেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের ২৩ রুটে বাস চলবে জানিয়ে বিআরটিসির জেনারেল ম্যানেজার মেজর মোক্তারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মাসখানেক পর চাহিদার ভিত্তিতে বাসের সংখ্যা বাড়ানো হবে।
বিআরটিসির পরিচালন (অপারেশন) বিভাগের তথ্য অনুসারে, ফেরি পারাপারের মাধ্যমে এত দিন ঢাকা থেকে খুলনা ও যশোরের দুটি পথে ১৬–১৭টি বাস চলাচল করত। আর বরিশাল থেকে মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি পর্যন্ত ১৫টি বাস চলছিল। এগুলো ফেরি পার হয়ে ঢাকায় আসত না। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এসব বাস বরিশাল থেকে ঢাকা পর্যন্ত চালানোর পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর, পটুয়াখালীসহ অন্যান্য জেলায়ও বাস চালু করা হবে।
গাবতলী থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী বাসের অনেক কোম্পানি পদ্মা সেতু হয়ে বাস চালাতে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে চলতে হবে।
এখন ঢাকা–খুলনা রুটে ১৬টি ও ঢাকা–যশোর রুটে ২টি বিআরটিসির বাস চলাচল করে। এসব পুরোনো রুটের সঙ্গে এখন নতুন রুট যুক্ত হচ্ছে। ২৬ জুন থেকে যেসব রুটে বাস চলবে, সেগুলো এসি বাস হবে। পরে অবশ্য নন–এসি বাস চালুর ভাবনা আছে বিআরটিসির।
বেসরকারি পরিবহন কোম্পানিগুলোও পদ্মা সেতু চালুর পর নতুন বাস নামাতে চাইছে। এর মধ্যে শরীয়তপুরের একটি নতুন কোম্পানি পাঁচটি রুটে বাস নামাতে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আবেদন করেছে। গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে বৈঠক হয় কমিশনারের কার্যালয়ে। শরীয়তপুরের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে বিআরটিএ সূত্র। বিআরটিএ বাসের রুট দেওয়ার ক্ষেত্রে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে এবং ভাড়ার হার ঠিক করে দেয়।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, গাবতলী থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলকারী বাসের অনেক কোম্পানি পদ্মা সেতু হয়ে বাস চালাতে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে চলতে হবে। এখন পর্যন্ত বিআরটিএতে এ বিষয়ে কোনো আবেদন আসেনি। বর্তমানে মাওয়া হয়ে ১৩টি রুটে বেসরকারি কোম্পানির বাস চলাচলের অনুমতি আছে।
এর বাইরে পদ্মা সেতু হয়ে বরিশাল ও কুয়াকাটা রুটে নতুন করে গ্রিন লাইন ও শ্যামলী পরিবহন বাস নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন থেকে বরিশাল রুটে বাস চালাতে চায় তারা।
শ্যামলী পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক ফারুক হোসেন বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে উদ্বোধনের পরদিন থেকে এই রুটে বাস চালাতে চান তাঁরা। প্রাথমিকভাবে ৪০টি বাস পরিচালনার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। তিনি জানান, যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা বিবেচনা করে প্রাথমিকভাবে ৩২ বা ৩৬ আসনের নন-এসি বাস চালাবেন তাঁরা। এতে ভাড়া বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার তুলনায় কিছুটা বেশি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো ৫০ থেকে ৬০ টাকা বাড়ানো হতে পারে।
গ্রিন লাইন পরিবহন কয়েক বছর আগে বরিশালে বাসসেবা চালু করেছিল। কিন্তু দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা রুটে পরীক্ষামূলকভাবে সাতটি বাস নামাতে চায় তারা।
নতুন রুটে বাস চালানোর বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে গ্রিন লাইন পরিবহনের ব্যবস্থাপক (কল্যাণপুর) আসাদুজ্জামান বলেন, ২৬ জুন থেকে সাতটি বিলাসবহুল বাস এই রুটে নামাতে চান তাঁরা। এর মধ্যে ডাবল ডেকার, স্লিপার, বিজনেস ও ইকোনমি ক্লাসের বাস থাকতে পারে। গ্রিন লাইন বর্তমানে মাওয়া ঘাট দিয়ে খুলনায় বাস সার্ভিস চালাচ্ছে।
তবে অন্যান্য পরিবহন কোম্পানি দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক আবদুস সামাদ বলেন, ঢাকা থেকে বরিশালগামী বেশির ভাগ যাত্রী লঞ্চে যাতায়াত করেন। তাই পদ্মা সেতু চালু হলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যাত্রীদের চাহিদা বুঝে ধীরে ধীরে তাঁরা বাস নামাতে চান।
আরও কয়েকটি বাস কোম্পানির কর্মকর্তাও প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে এমন মনোভাবের কথা জানান। তা ছাড়া বাস চালাতে রুট পারমিট নেওয়ার বিষয় রয়েছে।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, শরিয়তপুরের একটি পরিবহন কোম্পানি পদ্মা সেতু দিয়ে বাস চালানোর রুট পারমিটের আবেদন করেছে। এ ছাড়া বরিশালসহ অন্যান্য রুটে নতুন করে কোনো কোম্পানি বাস চালানোর আবেদন করেনি। আবেদন করলে অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-বরিশাল রুটে উন্নত ও বিলাসবহুল বাস নামানোর পরিকল্পনা আছে তাঁদের। তবে নতুন রুট হওয়ায় ব্যবসার কথা মাথায় রেখেই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নতুন গাড়ি নামাতে তিন থেকে চার মাস সময় লাগে। ইতিমধ্যে নতুন গাড়ির অর্ডার (ক্রয় আদেশ) দেওয়া হয়েছে। রুট পারমিট পাওয়া গেলে গাড়ি চালানো হবে।
বরিশালবাসী আশা করছেন, সেতু চালু হলে এই রুটে ভালো বাস নামবে। ঢাকায় চাকরি শেষে বরিশালে অবসরজীবন কাটাচ্ছেন মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা থেকে বরিশালে যাওয়ার পথে পাটুরিয়া বা মাওয়া ফেরিঘাটে অনেকবার বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে আর বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। সহজেই বরিশাল–ঢাকা যাতায়াত করতে পারবেন। তবে ভাঙ্গা থেকে বরিশালের রাস্তা সরু হওয়ায় বাস চলাচল নিয়ে আনন্দের সঙ্গে শঙ্কাও আছে।
বরিশাল রুটে প্রায় ৩০ বছর ধরে বাস চালাচ্ছে সাকুরা পরিবহন। কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক রায়হান কবির বলেন, বর্তমানে গাবতলীর কাউন্টার থেকে তাঁদের বেশির ভাগ বাস ছাড়ে। পদ্মা সেতু দিয়ে গাড়ি চালাতে হলে সায়েদাবাদে কাউন্টার করতে হবে। কিন্তু সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বাস রাখা হচ্ছে। এর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের বাস যোগ হলে টার্মিনালে চাপ আরও বাড়বে। জায়গার অভাবে অনেক গাড়ির রাস্তায় পার্ক করা লাগতে পারে। এতে যানজট ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এ জন্য গাড়ি রাখতে আলাদা বাস টার্মিনাল প্রয়োজন।
বরিশাল অঞ্চলের নৌপথ নিরাপদ ও আরামদায়ক উল্লেখ করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহ মুহাম্মদ সিরাজ সাদিক বলেন, ‘সেতু চালুর পর আরামদায়ক ও বিলাসবহুল বাসের সেবা পেলে সেটি আমাদের জন্য আরও সুখবর হবে।’