অপেক্ষা শেষে তাঁদের এই প্রাপ্তি বড় ভারী, বড় কষ্টের

বোনের লাশ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বোন ও স্বজনেরা
তানভীর আহম্মেদ

মা ফাতেমা আক্তারের ছবি হাতে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে চুপচাপ বসে ছিলেন মুস্তাকিন। কিছুক্ষণ পরপর মায়ের ছবি হাতে নিয়ে দেখছিলেন তিনি। দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর। তবে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে যখন তাঁর কাছে মা ফাতেমার মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তখন আর নিজের আবেগ সংবরণ করতে পারেননি। মায়ের মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে তোলার পর মুস্তাকিন চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠেন।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় আগুন লাগার এক মাস পর মায়ের মরদেহ বুঝে পেলেন মুস্তাকিন। এ ছাড়া বাবা সন্তানের, ভাই ভাইয়ের লাশ বুঝে নিয়েছেন। ডিএনএ নমুনা দিয়ে স্বজনের লাশের জন্য অপেক্ষা করেছেন এই স্বজনেরা।
ফাতিমা আক্তার ও মুস্তাকিন—দুজনই কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায়। তাঁদের বাসা কারখানার কাছেই। সেদিন (৮ জুলাই) ফাতেমা সকাল আটটায় কারখানায় আসেন। আর রাতের বেলা মুস্তাকিনের কাজে যাওয়ার কথা ছিল।

তবে বিকেলে খবর পান, কারখানায় আগুন লেগেছে। আগুন লাগার খবর পাওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় কারখানার সামনে চলে আসেন মুস্তাকিন। দেখতে পান, কারখানায় আগুন জ্বলছে। তখন তিনি সেখানে থাকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের কাছে কারখানার ভেতরে মায়ের আটকে পড়ার কথা জানান। কোথাও খোঁজ না পেয়ে পরে মুস্তাকিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নমুনা দিয়ে যান। পুলিশ থেকে জানানো হয়েছে, তাঁর মায়ের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ফাতেমা আক্তারের মরদেহ বুঝে নিচ্ছেন ছেলে মুস্তাকিন

হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া আরও ২১ জন শ্রমিকের মরদেহ তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে আজ শনিবার। এর আগে গত বুধবার হস্তান্তর করা হয়েছিল ২৪ শ্রমিকের মরদেহ। তাঁদের মধ্যে হাসেম ফুডস কারখানার ৪৫ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি রয়েছে তিনজনের মরদেহ।

সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ইমাম হোসেন জানিয়েছেন, কারখানায় আগুনের ঘটনায় ৪৮ জনের মরদেহ পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে ৪৫ জনের মরদেহ শনাক্তের পর তা স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি তিনজনের মরদেহের পরিচয় নিশ্চিতের পর তা স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

কম্পার মরদেহ বুঝে নিচ্ছেন বাবা পরভা চন্দ্র বর্মন

গত ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানা থেকে ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। আর আগুন লাগার পর আতঙ্কে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে গিয়ে মারা যান আরও তিন শ্রমিক। তবে পুলিশের করা মামলার এজাহারে ৪৮ শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

ভাইয়ের খোঁজে মর্গে বড় ভাই

ভোলার যুবক মহিউদ্দিন আর শামীম সম্পর্কে খালাতো ভাই। দুজনই হাসেম ফুডসে কারখানায় চাকরি করতেন। আগুন লাগার পর থেকে দুজনই নিখোঁজ ছিলেন। তবে শামীম মারা গেছেন, সে তথ্য নিশ্চিত হয়েছে তাঁর পরিবার।
শামীমের মরদেহ বুঝে নিয়েছেন তাঁর বাবা ফখরুল ইসলাম।

লাশ নিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন স্বজনেরা

তবে মহিউদ্দিনের খোঁজ মেলেনি। মহিউদ্দিনের ছবি হাতে নিয়ে সকাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে আসেন সালাহ উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার খালাতো ভাই শামীমের মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। কিন্তু আমার ভাই তো সেদিন কারখানায় গিয়েছিল।’

কারখানার দুই কর্মকর্তার মরদেহ হস্তান্তর

হাসেম ফুডস কারখানার চতুর্থ তলার উত্তর–পশ্চিম পাশের একটি শীতাতাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। ওই কক্ষেই বসতেন কারখানার ব্যবস্থাপক মাহাবুবুর রহমান।
আগুনের ঘটনার পর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। শনিবার তাঁর মরদেহ মর্গ থেকে বুঝে নিয়েছেন তাঁর বাবা। মাহাবুবুর রহমানের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। এ ছাড়া কারখানার আরেক কর্মকর্তা জিহাদ রানার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনিও কারখানার চারতলায় কর্মরত ছিলেন। তিনি কোয়ালিটি ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর মরদেহ বুঝে নেওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা শওকত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দুই ছেলে। জিহাদ বড়। চার বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করত।’

ভাইয়ের লাশের খোঁজে ঢাকা মেডিকেলে সালাউদ্দিন

কম্পার মরদেহ হস্তান্তর

মৌলভীবাজারের ১৪ বছর বয়সী কিশোরী কম্পা রানী বর্মণ ও তার চাচাতো বোন তিথি সরকার কাজ করত কারখানার চতুর্থ তলায়। আগুন লাগার সময়ও দুজন একসঙ্গে ছিল। তিথি সরকার সেদিন বেঁচে গেলেও বাঁচেনি তার বোন কম্পা। আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া তিথি জানিয়েছিল, আগুন লাগার পর তারা মোট ১২ জন দ্রুত দক্ষিণ-পূর্ব পাশের সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে যায়। কিন্তু কম্পা বর্মণ ছাদে না গিয়ে এসি রুমে আশ্রয় নেয়। কম্পার মরদেহ বুঝে নেওয়ার সময় তার মা সোমা রানী বর্মণ বিলাপ করতে থাকেন।
কম্পার বাবা পরভা চন্দ্র বর্মণ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাতিজি তিথি বেঁচে গেল, কিন্তু আমার মেয়ে আগুনে পুড়ে মারা গেল।’