১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি (ডানে)। তাঁর পাশে বসা মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। অরোরার ঠিক পেছনে নৌবাহিনীর সাদা ইউনিফর্ম পরা ভাইস অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান l ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি (ডানে)। তাঁর পাশে বসা মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। অরোরার ঠিক পেছনে নৌবাহিনীর সাদা ইউনিফর্ম পরা ভাইস অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান l ছবি: সংগৃহীত

অপরাজেয়, অমিত শক্তির বাংলাদেশ

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে তাঁর দুই পাশে জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ (বাঁয়ে) ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম l ছবি: সংগৃহীত

বিজয় দিবস আমাদের ইতিহাসের একটি রক্তচিহ্নিত দিন। ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চে পাকিস্তানের শঠতাপূর্ণ ও পৈশাচিক আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালি যে-প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, নয় মাসের কম সময়ে বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষায় অশ্রু, স্বেদ ও রক্তের বিনিময়ে তার সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছিল এই দিনে। পৃথিবীর বুকে দেখা দিয়েছিল নতুন এক রাষ্ট্র—বাংলাদেশ।

১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ : ঢাকা সেনানিবাসে জে. রাও ফরমান আলীর (ডান থেকে দ্বিতীয়) নেতৃত্বে অস্ত্রসমর্পণের পর কোমরের বেল্ট খুলে রাখে পাকিস্তানি সেনারা l ছবি: রবীন সেনগুপ্ত

আমাদের এই যুদ্ধ যেমন ছিল মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্যে, তেমনি ছিল কতকগুলি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যে। এসব মূল্যবোধ দেখা দিয়েছিল পাকিস্তান আমলের চব্বিশ বছরে বাঙালির নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের কালে আমাদের নেতারা স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন, বাংলাদেশের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ যোগ করে রচিত হয়েছিল রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেসব আমরা ধরে রাখতে পারিনি। অচিরেই শুরু হয়েছিল উল্টো পথে যাত্রা। সাম্প্রতিককালে সেসব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে রেখে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রধর্মের বিধান। এই গোঁজামিল শ্লাঘনীয় নয়।
যখন সংবিধানের মূলনীতির ওপর আঘাত এল, তখন থেকে শুরু হলো রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তির ফিরে আসা এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের প্রতিষ্ঠা করা। আজ বাংলাদেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িকতার পুনরাবির্ভাব ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানের ওপর নির্যাতনের সঙ্গে দেখা দিয়েছে মুসলমানদের এক-একটি অংশের ওপর আক্রমণ—আহমদিয়া ও শিয়ারা তার শিকার। ব্লগারদের হত্যা করা হয়েছে নাস্তিক বলে, আবার পিরকে হত্যা করা হয়েছে পিরবাদ পছন্দ নয় বলে। অর্থাৎ কিছু মানুষ চাইছে, বাংলাদেশে কেবল তাদের মত অনুসরণ করে চলতে হবে, ভিন্নমত থাকবে না। এমন সংকীর্ণ বাংলাদেশের কথা কোনো দিন আমাদের মানসপটে জায়গা পায়নি। সাম্প্রদায়িকতা ও অরাজকতার নিষ্ঠুর খেলায় যারা মত্ত, তাদের প্রতিরোধ করতে হবে, নইলে বাংলাদেশের মহিমা ও তার প্রতিষ্ঠার ন্যায্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
অবশ্য বহুকাল পর সম্ভবপর হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও অপরাধীদের শাস্তিদান। বর্তমান সরকারের এ এক বড়ো সাফল্য। এই বিচারের বিরুদ্ধে দেশে সামান্য কিন্তু বিদেশে বেশ কিছু সমালোচনা হয়েছে। যাঁরা এসব কথা বলছেন, তাঁরা ওসব অপরাধে ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকার হরণ সম্পর্কে কিছু বলেন না। যেভাবে বিন লাদেনকে দণ্ড দেওয়া হয়েছিল, সেই আন্তর্জাতিক মানই কি আমাদের দেশের অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে উপযুক্ত হতো?

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া এ ক্ষেত্রে আরও অদ্ভুত। সে দেশের নাগরিকদের অনেকে যখন ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের জন্যে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার কথা বলছেন, তখন সে দেশের সরকার এবং কোনো কোনো রাজনৈতিক দল দাবি করছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কোনো গণহত্যা ঘটেনি, মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি। ইচ্ছে করলেই কি ইতিহাসের ঘটনা অবলুপ্ত করা যায়? বড় গলায় দশবার মিথ্যে কথা বললেই কি তা সত্যের রূপ পায়? ১৯৭১ সালে যারা বাংলার সবুজকে লাল করে দিতে চেয়েছিল, বাঙালির আবহমান রক্তধারাকে যারা বদল করে দিতে চেয়েছিল, তারা তো চেষ্টার কিছু কম করেনি। সে কথা পৃথিবীর সমকালীন প্রচারমাধ্যমে ধরা আছে, পাকিস্তানিদের নিজেদের লেখায়ও তার স্বীকৃতি আছে। তাদের দোসরদের সাজা হচ্ছে বলে আজ কি তার সবকিছু বদলে দেওয়া সম্ভবপর?
সাম্প্রদায়িকতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পটভূমিকায় যখন এবারের বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের অর্জনের কথাও আমরা না ভেবে পারি না। এককালে বাংলাদেশকে যাঁরা ‘বাস্কেট-কেস’ বলেছিলেন, তাঁদের উত্তরাধিকারীরা এখন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে নানা ক্ষেত্রে এ দেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও গড় আয়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও অন্যান্য উন্নয়ন সূচকের বিচারে আমাদের অগ্রগতি—বিশেষত, নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে আমাদের ভূমিকা—শ্লাঘার যোগ্য।

তবুও আমাদের অনেক পথ চলতে হবে সামনে। দেশের প্রতিটি মানুষ যাতে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে, তার মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে সচেষ্ট হতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যার কলঙ্ক দূর করতে হলে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে অনেক দূর। আমার বিশ্বাস, আমরা তা পারব। পরস্পর হাতে হাত রেখে সেই লক্ষ্য অর্জনে আমরা অগ্রসর হব বিজয় দিবস থেকে স্বাধীনতা দিবসে, স্বাধীনতা দিবস থেকে বিজয় দিবসে। বাংলাদেশ অপরাজেয়, অমিত তার শক্তি, সাফল্য তার সুনিশ্চিত, এ-বিশ্বাস রাখতে হবে।
আনিসুজ্জামান: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।