গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারেই মৃত্যুবরণ, বারবার আবেদনেও জামিন না পাওয়া, ছোট অপরাধে বড় দণ্ড, একই বিষয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা—ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় এমন সব ঘটনা, আইনটির অপপ্রয়োগ ও এতে নানা অসামঞ্জস্যের কথা তুলে ধরে এটি সংশোধনের দাবি তুলেছেন সাংসদ ও বিশিষ্টজনেরা।
আজ বৃহস্পতিবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮: চড়া মূল্য দিচ্ছে কারা?’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে আইনটি সংশোধনের এ দাবি করা হয়। আবার সাইবার জগৎকে নিরাপদ করতে আইনটিই বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন কেউ কেউ।
ওয়েবিনারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘কোনো আইন চিরন্তন নয়। এই আইনের যেসব ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছে, সেসব বিবেচনা করা যেতে পারে।’
কিছু অতিউৎসাহী লোক মামলা করেন জানিয়ে শ ম রেজাউল করিম বলেন, মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে সারা দেশে মামলা করা হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে বলা হয়েছে, একটি অপরাধকে ঘিরে একাধিক বিচার করারই সুযোগ নেই; একাধিক মামলা করা তো দূরের কথা। একাধিক মামলা থেকে কীভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে, তা দেখতে হবে বলে জানান মন্ত্রী।
ডিজিটাল আইনের প্রয়োজন আছে, কিন্তু আইনটির কিছু ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) সাধারণ সম্পাদক সাংসদ শিরীন আখতার। তিনি বলেন, আইনের মধ্যে অনেক রকম ফাঁক আছে। এই ফাঁকফোঁকর দিয়ে যেন জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়।
ওই আইনে জামিন পাওয়া যায় না—এমনটা মনে করেন না শিরীন আখতার। তিনি বলেন, ‘আইনের কিছু কিছু জায়গা আছে যে কারণে জামিন পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু উচ্চ আদালতে গেলে জামিন পাওয়া যায়। সেই প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। কেউ আর জেলখানায় থাকেনি, তারা বের হয়ে আসছে।’
তবে জাসদ নেত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘লেখক মুশতাক আহমেদ জামিন চেয়েও পাননি। একপর্যায়ে তিনি কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেছেন।’
আসিফ নজরুল বলেন, উচ্চ আদালতে জামিন পাওয়া খুব ব্যয়বহুল ব্যাপার। সব ধরনের মানুষের উচ্চ আদালতে জামিন পাওয়ার সুযোগ থাকে না। এ কারণে আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সব প্রয়োগকেই অপপ্রয়োগ উল্লেখ করে বলেন, ভীতির রীতি সাইবার স্পেসকে ‘মাইন ফিল্ডে’ পরিণত করেছে।
এদিকে ডিজিটাল আইন সংশোধন নয়, বাতিল চান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর মধ্যেই হ্যাকিংসহ কম্পিউটারের মাধ্যমে করা যায় এমন অপরাধের বিষয়ে আইন ছিল। সেখানে যদি না-ও থেকে থাকে, তাহলে সেটিকে যুগোপযোগী করে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো তৈরি করা যেতে পারে।
সরকারি দল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেন ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক। তিনি বলেন, আইনে অস্পষ্টতা রাখায় ভিন্নমত ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মী, অধিকারকর্মী, সাংবাদিকেরা বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আইনের যে ধারাগুলো নিয়ে আপত্তি, সবার সঙ্গে আলোচনা করে তা সংশোধন করা উচিত।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির বার্তাপ্রধান জহিরুল আলম বলেন, এই আইনে সাংবাদিকেরা চড়া মূল্য দিচ্ছেন। সাংবাদিকেরা নিজেরাই বুঝতে পারেন না, কোন কথা বলার কারণে তাঁরা এই আইনের আওতায় অপরাধী হচ্ছেন।
ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল আইনে করা মোট ৮৩৫টি মামলার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে সিজিএস। এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ২ হাজার ২২ জন এবং তাঁদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭০৭ জন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় রয়েছেন রাজনীতিবিদেরা, এরপর সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা।
ডিজিটাল আইনে করা মামলাগুলো বিশ্লেষণ করেছেন জিল্লুর রহমান। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে এই সময়ে ৯৫টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে দলীয় সমর্থকেরা করেছেন ৮২টি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করেছে ১৩টি। মন্ত্রীদের মানহানির জন্য ৫০টি মামলা করা হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র চারটি করেছেন ভুক্তভোগীরা, বাকিগুলো করেছেন দলীয় সমর্থকেরা।