ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর অন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং বড় বড় কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেরও উদ্যোগ শুরু হয়েছে বা হচ্ছে। তবে ডাকসু নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের চিন্তা হলো, ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে গিয়ে যেন আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট না হয়। তাই তাঁরা দেখতে চান ডাকসুর নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হয় কি না। যদি হয়, তাহলে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নির্বাচনেরও আয়োজনে সায় দেবেন তাঁরা।
এ বিষয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রথম লক্ষ্য হলো যথাযথ শিক্ষা অর্জন করা। নির্বাচন করতে গিয়ে যেন শিক্ষা অর্জনের সুষ্ঠু পরিবেশটি নষ্ট না হয়, সেটা আগে চিন্তা করতে হবে। শিক্ষা অর্জনের পরিবেশটি নষ্ট হবে না—সংশ্লিষ্ট সবার কাছ থেকে যদি এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যায়, তাহলে ‘কেস বাই কেস’ ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন করা হবে।
ছাত্র সংসদ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদকে বলা হয়ে থাকে ‘মিনি পার্লামেন্ট’। এসব ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ তথা সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি রাখা হয়। আবার আগে এসব ছাত্র সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে, যাঁরা এখন বড় বড় রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারক। শুধু নেতৃত্বই তৈরি নয়, ক্যাম্পাসগুলোতে নানা ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমও পরিচালিত হতো এসব ছাত্র সংসদের মাধ্যমে।
মূলত তিন কারণে এসব ছাত্র সংসদের নির্বাচন আটকে আছে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘ঝুঁকি’ নিতে চায় না। দ্বিতীয়ত, সরকার চায় না নির্বাচন করে নতুন ‘ঝামেলা’ সামনে আসুক। আবার ছাত্রসংগঠনগুলোও এ বিষয়ে একমত হতে পারে না।
এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশনার আলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগামী ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। এর মাধ্যমে ২৮ বছর পর ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ ফিরে পাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগের পর একই সময় থেকে বন্ধ থাকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদসহ দেশের বড় বড় কলেজেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠেছে। এর মধ্যে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের উদ্যোগ শুরু করেছে। কোনো কোনো প্রশাসনের মধ্যে আবার দ্বিধাদ্বন্দ্বও আছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে তাদের অধীনে ২ হাজার ২৬০টি কলেজ রয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো সরকারি এবং বেসরকারি বড় কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা। একসঙ্গে না করে ভাগ ভাগ করে এই নির্বাচন করতে চাইছে তারা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ কলেজগুলোতে নির্বাচনের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভায় বিষয়টি তুলবেন। এরপর নির্বাচন করার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ শুরু করবেন।
জাকসু, রাকসু ও চাকসু
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯২ সালে। এরপর আর নির্বাচন হয়নি। ২০১৩ সালে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন জাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেও তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৪ সালে প্রথম দফায় এবং গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। নিয়োগের পরপর তিনি জাকসু নির্বাচন দেওয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ার পর এখন আবার জাকসু নির্বাচনের দাবিতে ছাত্রসংগঠনগুলো মানববন্ধন, সংহতি সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
এ অবস্থায় এই নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যেও আলোচনা শুরু হয়েছে। উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘ধীরে ধীরে জাকসু নির্বাচনের দিকে আমরা যাচ্ছি। শিগগিরই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করা হবে। এরপর শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনেরও উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এ লক্ষ্যে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ১৯৮৯-৯০ মেয়াদকালে এখানে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ জানুয়ারি সংলাপের জন্য প্রক্টর অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান। ২২ জানুয়ারি কমিটির পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর কাছে গঠনতন্ত্র, কার্যনির্বাহী কমিটির তালিকা এবং মূল দলের নিবন্ধনপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এসব কাগজপত্র জমার শেষ দিন ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ ১০টি সংগঠন তাদের তথ্য জমা দেয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের (চাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা দাবি করলেও এখানেও নির্বাচন আটকে আছে। তবে ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগের পর চাকসু নির্বাচনের দাবিতে আবারও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলে আসছেন, কোনো প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটবে না বলে যদি সব ছাত্রসংগঠন নিশ্চয়তা দেয়, তাহলে যেকোনো সময় নির্বাচন দিতে তিনি প্রস্তুত আছেন।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংবাদদাতা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়]