সুনামগঞ্জ-১ আসন

অন্যের জমি দখল করে সাংসদের ‘হাওর বাংলা’

সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার নওধার গ্রামে সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি ‘হাওর বাংলা’। এই বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে থাকা নিজের জমি দেখাচ্ছেন আলতু মিয়া। সাম্প্রতিক ছবি
খলিল রহমান

সুনামগঞ্জ-১ আসন (ধরমপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ) থেকে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন মোয়াজ্জেম হোসেন (রতন)। তখন এই সাংসদের গ্রামে টিনশেডের পৈতৃক বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ি ছিল না। এখন নিজ গ্রাম, উপজেলা ও জেলায় তিনটি বাড়ি এবং ঢাকার গুলশানে একটি বড় ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর। এর মধ্যে অন্যের জমি দখল করে গড়েছেন অট্টালিকা, নাম দিয়েছেন ‘হাওর বাংলা’।

সরকারদলীয় এই সাংসদের কানাডায়ও বাড়ি আছে এবং বিদেশে টাকা পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ আছে। যা নিয়ে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় গ্রেপ্তার হওয়া আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীমসহ প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্য থেকে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, শতকোটি টাকা অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তখন সাংসদ মোয়াজ্জেমকে দুদকে তলবও করা হয়েছিল।

সাংসদ মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ হতে পারে। সেটি তদন্ত করে দেখবে দুদক। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার সম্পদের হিসাব পরিষ্কার। সব হিসাব আমার আয়কর ফাইলে উল্লেখ আছে। বিদেশে কোনো বাড়ি নেই। টাকাও পাচার করিনি।’

অন্যের জমিতে অট্টালিকা
ধরমপাশা উপজেলায় নিজ গ্রাম নওধারে সাংসদ গড়েছেন ‘হাওর বাংলা’ নামের একটি বিরাট অট্টালিকা। বাড়িটি যেখানে নির্মিত হয়েছে, সেখানে ওই এলাকার দুই ব্যক্তির ৬২ শতাংশ জমি রয়েছে। জমির কোনো দাম পরিশোধ না করেই সীমানাপ্রাচীর দিয়ে জায়গা ঘিরে নিয়েছেন এই আইনপ্রণেতা। শুধু বাড়ি বা ফ্ল্যাট নয়, গত ১২ বছরে এই সাংসদের কৃষি-অকৃষি জমিও বেড়েছে বহুগুণ। কিনেছেন দুটি গাড়ি।

ধরমপাশা উপজেলা সদর থেকে মধ্যনগরে যে সড়কটি গেছে, সেই সড়কের পাশে পাইকুরাটি ইউনিয়নের নওধার গ্রাম। সড়কের পূর্ব পাশে একটি দোতলা বাড়ি। বাড়িটির বিশাল ফটকের এক পাশে লেখা ‘হাওর বাংলা, ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এমপি, স্থাপিত এপ্রিল ২০০৬ ইং’। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এই বাড়ি নির্মাণ করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন সাংসদ হওয়ার পর। এর সত্যতা পাওয়া যায় ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া সাংসদের হলফনামায়। ওই হলফনামায় বাড়িটির কথা উল্লেখ ছিল না।

ধরমপাশা উপজেলায় নিজ গ্রাম নওধারে সাংসদ গড়েছেন ‘হাওর বাংলা’ নামের একটি বিরাট অট্টালিকা। বাড়িটি যেখানে নির্মিত হয়েছে, সেখানে ওই এলাকার দুই ব্যক্তির ৬২ শতাংশ জমি রয়েছে। জমির কোনো দাম পরিশোধ না করেই সীমানাপ্রাচীর দিয়ে জায়গা ঘিরে নিয়েছেন এই আইনপ্রণেতা।

ওই বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে গাছতলা গ্রামের বাসিন্দা আলতু মিয়ার ৩২ শতক এবং পাইকুরাটি গ্রামের বাসিন্দা বিকাশ রঞ্জন সরকারের ৩০ শতক জমি আছে। স্থানীয়রা জানান, মোয়াজ্জেম হোসেন এখানে প্রথম একটি টিনশেড ঘর করেন। ২০০১ সালে সাংসদ মোয়াজ্জেম তাঁর এক বোনের জন্য একটি ঘর করে দেওয়ার কথা বলে প্রথমে ৮ শতক জমি আলতু মিয়ার কাছ থেকে কিনতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার সময় ৩০ হাজার টাকা দেবেন। কিন্তু টাকা দিই-দিচ্ছি করে আর দেননি তিনি। সাংসদ হওয়ার পর একটি সীমানাপ্রাচীর দেন। আর এতে আলতু মিয়ার বাকি ২৪ শতাংশ জমিও সীমানাপ্রাচীরের ভেতর ঢুকে যায়।

আলতু মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন বুঝতে পারি কিনতে নয়, দখল করতে চান মোয়াজ্জেম হোসেন, তখন বিষয়টি নিয়ে এলাকায় একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। ভুয়া দলিল তৈরি করে এসব জমি নামজারি করে নেন সাংসদের লোকজন। ২০০৮ সালে মামলা করলে আদালত রায়ে ওই নামজারি বাতিল করে দেন।’

বাড়িটর ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আলতু মিয়া সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে থাকা তাঁর জমি দেখান এই প্রতিবেদককে। তিনি বলেন, এখানে পাইকুরাটি মৌজার ৫১৮ খতিয়ানের ১৭৪৯ দাগে তাঁর ৩২ শতক জমি আছে। আবার মূল ফটকের সামনে সড়কের পশ্চিম পাশে একই মৌজার একই খতিয়ানের ১৫৬০ দাগে আছে আরও ১৭ শতক। এই জমিও দখল করে নেওয়া হয়েছে। সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে উত্তর দিকের একটি টিনশেড ঘর দেখিয়ে জানান, ২০০১ সালে এই ঘর নির্মাণের জন্য মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম তাঁর কাছ থেকে ৮ শতক জমি কিনতে চেয়েছিলেন।

আলতু মিয়া বলেন, ‘আমি জমি ফিরে পাওয়ার জন্য ঘুরতে ঘুরতে নিঃস্ব হয়ে গেছি। সবাই বিষয়টি জানে। কিন্তু কেউ কোনো সহায়তা করতে পারে না।’

‘হাওর বাংলা’র ভেতরে বিকাশ রঞ্জন সরকারেরও জমি রয়েছে। পেশায় ব্যাংকার বিকাশ রঞ্জন এখন বসবাস করেন ধরমপাশা উপজেলা সদরে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদের বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে তাঁর যে জমি রয়েছে, সেটির দাগ নম্বর ১৭৫১। এ ছাড়া সাংসদের দুই ভাইয়ের নামে আরও ২ একর ৬৫ শতক জমি তিনি দলিল করে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো টাকা পাননি। সম্পর্কের খাতিরে তিনি এ নিয়ে কখনো দেনদরবার করেননি।

আসলে উনি (সাংসদ) কথা দিয়ে কথা রাখেননি। নানা কারণে সবকিছু বলাও যাবে না। আমি রেজিস্ট্রি করে জমি দেব, টাকা পাব, এটাই হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি এখন বিষয়টিকে পাত্তা দিচ্ছেন না। তবে আমি টাকা ছাড়া কখনো জমি রেজিস্ট্রি করে দেব না।
বিকাশ রঞ্জন, ব্যাংকার

বিকাশ রঞ্জন সরকার বলেন, ‘আসলে উনি (সাংসদ) কথা দিয়ে কথা রাখেননি। নানা কারণে সবকিছু বলাও যাবে না। আমি রেজিস্ট্রি করে জমি দেব, টাকা পাব, এটাই হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি এখন বিষয়টিকে পাত্তা দিচ্ছেন না। তবে আমি টাকা ছাড়া কখনো জমি রেজিস্ট্রি করে দেব না।’

এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কখনো কোনো অন্যায় কাজ করি না। বিকাশ রঞ্জন সরকার আমার নিজের লোক। তাঁকে আমি অনেক আগেই জমির টাকা দিয়েছি। তিনি কিছু জমি রেজিস্ট্রিও করে দিয়েছেন। আবার কিছু জমি নাকি সরকারি খাস খতিয়ানে চলে গেছে। এই সমস্যা মিটে গেলে অবশ্যই তিনি বাকি জমি রেজিস্ট্রি করে দেবেন। এটা একেবারে আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়।’ আলতু মিয়ার জমির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘আমি আলতু-ফালতু কাউকে চিনি না। এ নিয়ে কথাও বলতে চাই না।’

সাংসদ হয়ে বাড়ি, গাড়ি, জমি সবই হয়েছে তাঁর
সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনে সম্পদের হিসাব বিবরণী হলফনামার মাধ্যমে জমা দেন। তাতে দেখা যায়, তখন সাংসদের নামে কোনো বাড়ি ছিল না। কৃষিজমি ছিল ৩ দশমিক ৯৩ একর। অকৃষিজমি ১ দশমিক ১৫ একর।

১০ বছর পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় হলফনামার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে আবার একটি হিসাব বিবরণী জমা দেন। সেখানে দেখা যায় সাংসদের কৃষিজমি বেড়ে হয়েছে ৫২৩ একর, অকৃষিজমির পরিমাণ এখন ৮ দশমিক ২৬ একর। স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে দুটি দালান, একটি টিনশেড ঘর। এ ছাড়া ঢাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে। সাংসদের আছে একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ও একটি টয়োটা সিডান কার।

সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনে সম্পদের হিসাব বিবরণী হলফনামার মাধ্যমে জমা দেন। তাতে দেখা যায়, তখন সাংসদের নামে কোনো বাড়ি ছিল না। কৃষিজমি ছিল ৩ দশমিক ৯৩ একর। অকৃষিজমি ১ দশমিক ১৫ একর।

দলীয় এই সাংসদের বিষয়ে কথা হয় ধরমপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ (মুরাদ), প্রচার সম্পাদক ও সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্য জুবায়ের পাশা এবং ধরমপাশা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সেলিম আহমদের সঙ্গে। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ বেশ কিছু জমি দখল করেছেন, বিষয়টি সবাই জানে। কিন্তু কেউ কিছু করতে পারছে না।

এর আগে গত বছরের ১৫ অক্টোবর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা শামীম আহমেদ সুনামগঞ্জে এক সভায় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনকে ‘চাঁদাবাজির গডফাদার’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। ওই সভায় সাংসদও উপস্থিত ছিলেন।

জলমহালে চাঁদাবাজি, খুনোখুনি
সুনামগঞ্জে ছোট-বড় অনেক হাওর, বিল ও জলাশয় রয়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে এগুলো ইজারা দেওয়া হয়। মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে জলমহাল ইজারা নেওয়া হলেও পেছনে থাকেন স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতারা। সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার সুনই জলমহালটি জেলার একটি বড় জলমহাল। এটি নিয়ন্ত্রণ করেন সাংসদ ও তাঁর ছোট ভাই ধরমপাশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন। সাংসদের নির্বাচনী এলাকার জলমহালের বড় অংশই তাঁর লোকেরা নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ আছে।

গত ৭ জানুয়ারি সুনই নদ জলমহালে হত্যাকাণ্ড ঘটে। এতে মৎস্যজীবী শ্যামাচরণ বর্মণ (৬৫) নিহত হন। আহত হন আরও ১৫ থেকে ২০ জন। ঘটনার পর নিহত ব্যক্তির ছেলে চন্দন বর্মণ (৩০) সাংসদ মোয়াজ্জেম ও তাঁর ছোট ভাই মোজাম্মেল, বড় ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মোবারক হোসেন ওরফে মাসুদকে আসামি করে থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। যদিও সাংসদের নাম থাকায় পুলিশ সেই মামলা নেয়নি। অবশ্য সাংসদ মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, এই ঘটনার দিন তিনি সেখানে ছিলেন না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত একটি পক্ষ ফায়দা নিতে এ ঘটনায় তাঁকে জড়ানোর চেষ্টা করছে।

সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়া না থাকায় এমনটা হচ্ছে। এই সাংসদ জানেন ভোটের জন্য জনগণের কাছে তাঁকে যেতে হবে না।
এম হাফিজউদ্দীন খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

সুনামগঞ্জ পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে সুনই জলমহালে ওই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। তা ছাড়া জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাঁর সম্পদের অনুসন্ধান করছে দুদক। এ কারণে সাংসদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দুদক।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি এম হাফিজউদ্দীন খান প্রথম আলোকে বলেন, একজন জনপ্রতিনিধির কাজ হলো মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু তা না করে যদি উল্টোটা করেন, তাহলে আর কী বলার থাকে। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়া না থাকায় এমনটা হচ্ছে। এই সাংসদ জানেন ভোটের জন্য জনগণের কাছে তাঁকে যেতে হবে না।’