অনুকরণীয় এক জীবন

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ (১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০—১৯ মার্চ ২০২২)
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ (১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০—১৯ মার্চ ২০২২)

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যু অনুমিত ছিল। নব্বইয়ের ওপর বয়স হয়েছিল, নানা অসুখে ভুগছিলেন অনেক দিন ধরে। কিন্তু তাঁর চিরবিদায়ে বেদনার্ত না হওয়া সম্ভব নয় তবু। তিনি রাষ্ট্রের বড় বড় পদে থেকে নির্মোহভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন, এ দেশের বিবদমান প্রধান দুটো রাজনৈতিক পক্ষেরই আস্থা ও সম্মান পেয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য রেখে গেছেন অনন্য কিছু অনুপ্রেরণা আর উদাহরণ।

ছোটখাটো, অনুজ্জ্বল, আইনজগতের বাইরে অপরিচিত এই মানুষটাকে দেখে তখন অনেকে অবাক হয়েছিল। বাঘ-সিংহের লড়াইয়ের এই নির্বাচন পারবেন তিনি ঠিকভাবে অনুষ্ঠিত করতে?

তিনি ছোটখাটো মানুষ ছিলেন, কথা কম বলতেন, অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বের, তাঁর সদিচ্ছা-সততা আর দায়িত্ববোধের শক্তি ছিল অতুলনীয়। তিনি মূলত একজন বিচারক ছিলেন। কিন্তু তিনিই স্বৈরতন্ত্র থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে ফিরে আসার প্রক্রিয়ায় অভিভাবকত্ব করেছিলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন, মাত্র মাস দশেক ক্ষমতায় থেকে সুশাসনের বহু নজির রেখে গেছেন।

তিনি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। বিচারক হিসেবে সাংবিধানিক প্রাধান্য, আইনের শাসন ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কয়েকজন পূর্বসূরির মতো তিনিও অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বাতন্ত্র্য আর বিশালত্ব সবচেয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে নব্বইয়ের সেই গণ–অভ্যুত্থানকালে।

এরশাদবিরোধী অভ্যুত্থানের সেই সময় বাংলাদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। তিন জোট (আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন এবং বাম জোট) সুশাসনের রূপরেখা দিয়েছিল, তাদের বিশ্বাস করে মানুষ ভেবেছিল, এরশাদের পতনের পর দেশে আর স্বৈরতন্ত্র থাকবে না, কালাকানুন থাকবে না, গণমাধ্যম হবে স্বাধীন, মানুষের অধিকার হবে অবাধ।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের পরিবারের কেউ কেউ স্বনামে খ্যাত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে তিনি কোনো দিন কোনোভাবেই পরিবারকে টেনে আনেননি। তিনি আপাদমস্তক সৎ ছিলেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকেও তিনি যে কতটা নিরাড়ম্বর ছিলেন, তা এই সমাজে এখন কল্পনাও করা যাবে না।

এসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রথমেই প্রয়োজন ছিল এরশাদের বিদায়ের সাংবিধানিকতা রক্ষার এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। এসব কাজ করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হলো, এর দায়িত্ব দেওয়া হলো তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে। ছোটখাটো, অনুজ্জ্বল, আইনজগতের বাইরে অপরিচিত এই মানুষটাকে দেখে তখন অনেকে অবাক হয়েছিল। বাঘ-সিংহের লড়াইয়ের এই নির্বাচন পারবেন তিনি ঠিকভাবে অনুষ্ঠিত করতে?

তাঁর সামনে কোনো নজির ছিল না, তাঁর প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও ছিল না তেমন, রাজনৈতিক সমর্থন ছিল না প্রশ্নহীন। কিন্তু তিনি দেখিয়ে গেছেন সদিচ্ছা, দৃঢ়তা আর শুদ্ধতা থাকলে কতটা সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব।

তিনি এভাবেই আমাদের জন্য একটি অবিনশ্বর উদাহরণ তৈরি করেন। তাঁর সাফল্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ফলে এ দেশে পরপর বেশ কয়েকটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলো (যেমন প্রিন্ট মিডিয়ার স্বাধীনতাবিরোধী ফৌজদারি বিধান বাতিল) সৎসাহস জুগিয়েছিল পরবর্তী বহু আইনগত সংস্কারের।

দলীয় সরকারগুলো এসবের ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি অনেক ক্ষেত্রে, তিন জোটের রূপরেখার প্রতিশ্রুতি ধূলিসাৎ হয়েছে তাদেরই একক বা যৌথ আমলে। কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের উদাহরণগুলো তারপরও এ প্রত্যয়কে অবিনশ্বর রেখেছে যে এ দেশেও ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব, মানুষের কল্যাণ আর স্বার্থকে রক্ষা করা সম্ভব।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়েও কিছু বিতর্ক রয়েছে। বলা হয়, তাঁর ইচ্ছাকে মূল্য দেওয়ার জন্যই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব শেষের পর প্রধান বিচারপতি পদে তাঁর ফেরার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল সংবিধান সংশোধন করে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এ সংশোধনী কোনো ক্ষতিকর নজির সৃষ্টি করেনি, কোনো ক্ষতিও করেনি। বরং এটি হয়েছিল বলেই সুষ্ঠু নির্বাচন কী, তা বাংলাদেশ প্রথম প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিল এবং এর বলেই বিচার বিভাগের মর্যাদা আরেকবার সমুন্নত হয়েছিল। তাঁর অভিভাবকত্বে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের নির্বাচন নিয়েও কিছু বিতর্ক হয়েছে, নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম’ কারচুপি হয়েছিল বলে পরাজিত দলটি অভিযোগ করেছিল। কিন্তু এ অভিযোগকারীরা নিজেরা ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালে তাঁকেই বলে-কয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হতে রাজি করিয়েছিল।

১৯৯৬ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন একটি দলীয় সরকারের নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এটি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের উদারতা ও সদিচ্ছার পরিচায়ক ছিল, মানুষ হিসেবে সাহাবুদ্দীনের শ্রদ্ধা, সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণও ছিল। আওয়ামী লীগ থেকে এত বড় সম্মান পওয়ার পর তিনি অভিভূত হয়ে তাঁর দায়িত্ব ভুলে যাননি। সংবিধানের সীমিত ক্ষমতার মধ্য থেকেই তিনি উপযুক্ত ক্ষেত্রে তাঁর ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন, কখনো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিমত করেছেন। বাংলাদেশে বহু রাষ্ট্রপতি ছিলেন, থাকবেন। কিন্তু তাঁর মতো করে এ পদের সম্মান ও মর্যাদা আর কেউ রক্ষা করতে পারেননি।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের পরিবারের কেউ কেউ স্বনামে খ্যাত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে তিনি কোনো দিন কোনোভাবেই পরিবারকে টেনে আনেননি। তিনি আপাদমস্তক সৎ ছিলেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থেকেও তিনি যে কতটা নিরাড়ম্বর ছিলেন, তা এই সমাজে এখন কল্পনাও করা যাবে না।

তিনি যখন যে পদে ছিলেন, শুধু ভালো উদাহরণ তৈরি করে গেছেন। তিনি মৃদু মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁর কাজ ছিল জোরালো আর শক্তিশালী। আমাদের রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রায় অক্ষয় অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে এই কর্মবীরের জীবন।