মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির রচিত এক মহাঘটনা। তাতে কেউ অংশ নিয়েছেন, কেউ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কেউ ছিলেন কোনো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁদের বয়ানে একাত্তরের স্মৃতিচারণা।
২৫ মার্চে ঢাকার গণহত্যার খবর ভারত বা বিশ্বের কোনো বেতারে প্রচারিত হয়নি। তবে ২৬ মার্চ রাতে অস্ট্রেলিয়া বেতার ঢাকার গণহত্যার খবর প্রচার করে।
পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের বাড়ি সার্চ করতে পারে—এই আশঙ্কায় আমরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ি। এ অবস্থায় তাজউদ্দীন ভাইয়ের নাম মহম্মদ আলী আর আমার নাম রহমত আলী ঠিক করে নিই। সার্চ হলে বলা হবে, মহম্মদ আলী চাঁদপুরে গফুর সাহেবের ঠিকাদারির কাজ তদারকি করেন। আর আমার বাড়ি পাবনা, আমি গৃহস্বামীর ভাইয়ের ছেলে। ঢাকায় বেড়াতে এসেছি।
২৬ মার্চ সারা দিন গফুর সাহেবের বাড়িতে আটকা থাকি। বাইরে কারফিউ। চারদিকে মিলিটারি জিপ টহল দিচ্ছে। ফিজিক্যাল এডুকেশন কলেজের ওপর সেনাবাহিনী ক্যাম্প করেছে। ওপরে সার্চলাইটের মতো কী যেন একটা বসানো হয়েছে। আমরা আশঙ্কা করছি, যেকোনো মুহূর্তে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি শুরু হতে পারে।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে লক্ষ করলাম, কারফিউ ও গোলাগুলির মধ্যেও সাধারণ মানুষের গতি অব্যাহত রয়েছে। সামনে রাজপথ দিয়ে লোকজনের চলাচল নেই। কিন্তু ভেতরের রাস্তা দিয়ে সাধারণ মানুষ চলাচল করছে। মনে মনে ঠিক করলাম, সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে গেলে আমার চলাচলেও কোনো অসুবিধা হবে না।
আমি একাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। যেকোনোভাবে সাতমসজিদ রোড পার হতে হবে। আমার অবস্থান থেকে সাতমসজিদ রোড বেশ দূরে। আমার খুবই পরিচিত কুষ্টিয়ার আতাউল হক সপরিবার সাতমসজিদ রোডের কাছাকাছি থাকেন। গলি দিয়ে পার হচ্ছি। পথে একজন মাওলানাকে পেলাম। তিনি লালমাটিয়ার পুরোনো অধিবাসী। তাঁর সাহায্যে আতাউল হকের বাড়িতে পৌঁছাই। মাওলানাকে বললাম, আমি হক সাহেবের আত্মীয়, পাবনা থেকে এসেছি।
মাওলানাকে ওই বাড়িতে আমার আত্মীয় মহম্মদ আলী আছেন, তাঁকে নিয়ে আসার জন্য বললাম। কিছুক্ষণ পর মহম্মদ আলী এসে হাজির হলেন।
হক সাহেবের বাড়িতে আমাদের নাশতা তৈরি করতে ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে আমি আবার বেরিয়ে পড়েছি। বিভিন্ন বাড়ির পেছনের অলিগলি দিয়ে পথ চলছি। হঠাৎ করে একটি মিলিটারি জিপ এই রাস্তায় ঢুকে পড়ে। রাস্তায় ঢুকেই ওরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। আমি একটি বাড়ির পাশে নিজেকে লুকিয়ে রাখি। জিপটি ফিরে যেতেই আমি আতাউল হকের বাড়িতে ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পর এ ধরনের গোলাগুলি চরম আকার ধারণ করে। কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে। ভয়ার্ত মানুষের আর্তচিৎকারে পরিবেশ ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
আতাউল হকের ঘরের বেড়া ও চালা টিন দিয়ে তৈরি। টিনের বেড়া ফুটো করে গুলি যেকোনো একজনের গায়ে লাগতে পারে। গৃহকর্ত্রী বলেন, পাশের পাকা বাড়িতে চাকর ছাড়া অন্য কোনো লোকজন নেই। আমরা ইচ্ছে করলে দেয়াল টপকে সেখানে যেতে পারি। তার কথায় আমি পাশের পাকা বাড়িতে যাই। তাজউদ্দীন ভাই ওই বাড়িতে গেলেন না।
সে সময় একজন ছাত্র এ বাড়িতে আসে। সে আমাদের চিনতে পারে। তার মুখে শহরের টুকরো টুকরো খবর পেলাম। আমাদের প্রধান জিজ্ঞাস্য ছিল, ৩২ নম্বরে কী হয়েছে? ছাত্রটি সঠিক কিছু বলতে পারল না। তবে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে দুই ধরনের খবর শুনেছে। কেউ বলেছে, বঙ্গবন্ধু সরে গেছেন। আবার কেউ বলেছে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বাইরে কারফিউ না থাকায় আমরা বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের দুজনের হাতে একটি করে বাজারের থলি। যেন আমরা বাজার করতে যাচ্ছি। তাজউদ্দীন ভাইয়ের পরনে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা টুপি।
আমরা রায়েরবাজার পৌঁছাই। সেখানে আওয়ামী লীগের কর্মীদের একটি শক্ত ঘাঁটি তখনো রয়েছে। নির্ভীক কর্মীরা সংগ্রাম কমিটির অফিস পাহারা দিচ্ছে। রায়েরবাজার থেকে দুজন লোককে দুদিকে পাঠালাম। একজন গেল ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর খোঁজখবর জানতে, আর অপরজনকে পাঠালাম মুসা সাহেবের বাসায় ড. কামাল এসেছেন কি না, তা জানার জন্য। ৩২ নম্বরের খোঁজ নিয়ে আমাদের পাঠানো লোক ফিরে এসে জানায়, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে পুলিশ নিহত হয়ে পড়ে রয়েছে। বাড়িতে কোনো লোকজন নেই। পরস্পর জানতে পেরেছে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। আর মুসা সাহেবের বাড়িতে খোঁজ করে জানা গেল, ড. কামাল হোসেন সেখানে পৌঁছাতে সমর্থ হননি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেল শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ নদী পার হয়ে জিনজিরার দিকে চলে গেছেন। শেখ কামাল ও শেখ জামাল বাসা থেকে পালিয়ে গেছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান প্রমুখ নেতার কোনো খোঁজখবর জানতে পারলাম না।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা এ স্থান ত্যাগ করব। সেখানে জমায়েত নেতা–কর্মীদের বললাম, সংগ্রামকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক গ্রামে–গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক বেরিয়েছি। তারা সময়ে সময়ে নির্দেশ পাবে।
২৭ মার্চ রায়েরবাজারের কর্মীদের কাছ থেকে আমরা বিদায় নিলাম। ওই বিদায় ছিল মর্মস্পর্শী। তাজউদ্দীন ভাইকে আমি বলি, এখন পথই আমাদের ঠিকানা, পথই আমাদের সঠিক পথে পৌঁছে দেবে। বিদায়ের সময় রায়েরবাজারের একজন কর্মী জিজ্ঞাসা করে, আমাদের পরিবারের জন্য কিছু বলার আছে কি না। আমরা দুজনে দুই টুকরা কাগজ নিয়ে কিছু লিখে তাদের হাতে দিলাম। কর্মীরা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিল। তাজউদ্দীন ভাইয়েরটা পৌঁছাল, আমারটা কর্মীরা পৌঁছাতে পারেনি। (সংক্ষেপিত)
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, খণ্ড ১৫, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮৫
ব্যারিস্টার আমীর–উল ইসলাম: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী; বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধানপ্রণেতা