অনিরাপদ ভ্যানে ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল যাত্রা

>
বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসছে যানবাহন। ডানে গাড়ি, বাঁয়েও গাড়ি। সেসবের তোয়াক্কা না করেই শিশুদের নিয়ে ছুটে চলেছেন ভ্যানচালক। ছবিটি গতকাল দুপুরে রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে থেকে তোলা l প্রথম আলো
বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসছে যানবাহন। ডানে গাড়ি, বাঁয়েও গাড়ি। সেসবের তোয়াক্কা না করেই শিশুদের নিয়ে ছুটে চলেছেন ভ্যানচালক। ছবিটি গতকাল দুপুরে রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে থেকে তোলা l প্রথম আলো
উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় স্কুল ভ্যানের মালিকদের অন্তত পাঁচটি সংগঠন বলেছে, ঢাকার রাস্তায় এখন তিন হাজারের বেশি ভ্যান চালু আছে। দূরত্ব অনুযায়ী স্কুল ভ্যানে শিক্ষার্থীপ্রতি মাসিক ভাড়া ৮০০ থেকে ৩৫০০ টাকা

তিন চাকার রিকশা-ভ্যানের ওপর পাঁচ ফুট বাই তিন ফুটের খাঁচা। চলতি নাম ‘স্কুল ভ্যান’। ঢাকার রাস্তায় চলা এ ভ্যানগুলো সিটি করপোরেশনে নিবন্ধিত নয়। এগুলোতে দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে। স্কুলগুলো সচরাচর এসব ভ্যানের দায়িত্ব নেয় না।

শিক্ষার্থী পরিবহনের এই ব্যবসা ব্যক্তিমালিকানায় কোনো ধরনের তদারকি ছাড়াই চলছে। দুই সিটি করপোরেশনের কাছে এগুলোর মালিক বা চালকদের কোনো তথ্য নেই। স্কুল ভ্যানের সংখ্যাও করপোরেশন দুটি জানে না। তবে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় স্কুল ভ্যানের মালিকদের অন্তত পাঁচটি সংগঠন প্রথম আলোকে বলেছে, ঢাকার রাস্তায় এখন তিন হাজারের বেশি এমন ভ্যান চালু আছে। দূরত্ব অনুযায়ী স্কুল ভ্যানে শিক্ষার্থীপ্রতি মাসিক ভাড়া ৮০০ থেকে ৩৫০০ টাকা।
ঢাকায় অযান্ত্রিক যানবাহন (রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি) নিবন্ধন ও অনুমোদনের কর্তৃপক্ষ হচ্ছে নগরীর দুই সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর ধারা ৪১-এ বলা আছে, ‘কোন ব্যক্তি করপোরেশন কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স ব্যতীত নগরীতে মোটরগাড়ি ছাড়া অন্য কোন সাধারণ যানবাহন রাখিতে, ভাড়া দিতে বা চালাইতে পারিবেন না।’
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের প্রধান মো. মোস্তফা কামাল বলছেন, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী
১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরের পর নতুন কোনো অযান্ত্রিক বাহন নিবন্ধন করা হয়নি। ঢাকার যানজট কমাতে এ ব্যবস্থা। আপাতত পুরোনো বাহনগুলোর নিবন্ধন তিন বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে। তাঁর ভয়, স্কুল ভ্যানগুলোকে নিবন্ধনের সুযোগ দিলে এর সংখ্যা বেড়ে যানজট বাড়তে পারে।
মোস্তফা কামাল বলেন, যেহেতু ভ্যানগুলো নিবন্ধন ছাড়া চলছে, এগুলো অবৈধ। তবে বাচ্চাদের স্কুলে যাতায়াতের সঙ্গে জড়িত বলে কিছু বলা হচ্ছে না।
নিরাপত্তার ঝুঁকি কম নয়: স্কুল কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক বিভাগ বা অভিভাবকেরা কেউই এই বাহনগুলোকে শিশুদের জন্য নিরাপদ বলে মনে করছেন না। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে স্কুল ভ্যানে যাতায়াতের অনুমতি নেই। অধ্যক্ষ এম এম সালেহীন বলেন, স্কুল ভ্যানগুলোর নিরাপত্তাঝুঁকি অনেক। তিন চাকার এ গাড়িগুলোর ভারসাম্য রাখা কঠিন। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। চালকদের জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। তাই তাঁদের দায়িত্ববোধও নেই। এসবের ফল ভুগছে শিশুরা।
সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাহাব উদ্দিন মোল্লাও মনে করেন, কাঠামোগত কারণে এগুলো নিরাপদ বাহন নয়। তা ছাড়া তিনি চালকদের রাস্তার মাঝখানে বাচ্চাদের নামিয়ে দিতে দেখেছেন।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষার্থীর মা সাজেদা খাতুন বলেন, ‘প্রায়ই দেখি, জ্যামে পড়লে ভ্যানওয়ালারা বাচ্চাদের কালীমন্দিরের (সিদ্ধেশ্বরী) সামনে বা বেইলি রোডের মোড় থেকে একা ছেড়ে দেয়। ছোট ছোট বাচ্চারা একা হেঁটে আসে। কত কিছুই তো হতে পারে!’
ঢাকা মহানগর পুলিশ ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার সোমা হাপাং প্রথম আলোকে বলেন, যানজট থাকলে স্কুল ভ্যানগুলো উল্টোপথে চলে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে। তিনি বলেন, ‘আমরা বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়াটা প্রায়োরিটি দিই বলে এই ভ্যানগুলোর ব্যাপারে অতটা শক্ত হই না। বাচ্চারা যেন নিরাপদে যেতে পারে, সেই জন্য সাহায্য করি।’
এদিকে তিনজন অভিভাবক বলেছেন, তাঁরা ভ্যানচালকের হাতে তাঁদের পরিচিত মেয়েশিশুদের যৌন নিপীড়নের একাধিক ঘটনার কথা জানেন। বেসরকারি সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর মা নাঈমা ইসলাম। তিনি বললেন, একটি মেয়েশিশুর সঙ্গে এক ভ্যানচালককে অশোভন আচরণ করতে দেখেছেন।
শিশু অধিকার ফোরামের সভাপতি এমরানুল হক চৌধুরীর মতে, স্কুলে যাতায়াতের বাহন এবং বাহনের চালক শিশুর জন্য নিরাপদ কি না, তা যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার। তিনি বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে স্কুল কোচগুলোকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে তিন চাকার খাঁচার মধ্যে করে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া হয়।’ তিনি সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বলেন শিশুদের নিরাপদ পরিবহনব্যবস্থার দিকে নজর দিতে।
স্কুল কিছু জানে না!: দূরত্ব অনুযায়ী স্কুল ভ্যানে শিক্ষার্থীপ্রতি মাসিক ভাড়া ৮০০ থেকে ৩৫০০ টাকা। প্রায় সব স্কুল ভ্যানের গায়েই স্কুলের নাম লেখা থাকতে দেখা যায়। কোনো কোনো ভ্যানে স্কুলের লোগো আঁকা থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কুল ভ্যানের মালিক বা চালকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোর কোনো যোগাযোগ নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ভ্যানমালিক উভয় পক্ষই এ কথা বলেছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত আটটি স্কুলের কর্তৃপক্ষ ও ভ্যানমালিকদের সঙ্গে এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার স্কুলগুলো হচ্ছে কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও ডলফিন কিন্ডারগার্টেন। আর উত্তরের স্কুলগুলোর মধ্যে আছে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়, সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং লাইফ প্রিপারেটরি স্কুল।
এই স্কুলগুলোর মধ্যে শুধু সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্কুল ভ্যানগুলো নজরদারিতে রাখে। অধ্যক্ষ হামিদা আলী বলেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য ভ্যানমালিকদের স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধিত হতে হয়। অন্য স্কুলগুলোর কর্তৃপক্ষ বলেছে, অভিভাবকেরা নিজ দায়িত্বে ভ্যানে সন্তানকে দিচ্ছেন। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় স্কুলের নয়।
দক্ষিণে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং উত্তরে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ে স্কুল ভ্যানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তবে দুটি স্কুলের সঙ্গেই ভ্যানগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘স্কুল ভ্যানের সাথে প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অভিভাবকেরা নিজ দায়িত্বে বাচ্চাদের আনা-নেওয়া করেন। যেহেতু আমরা জড়িত না, স্কুলের বাইরে কিছু হলে দায়িত্বও আমাদের না।’
ডলফিন কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও লাইফ প্রিপারেটরি স্কুলের একসময় নিজস্ব স্কুল ভ্যান ছিল। কিন্তু স্কুল দুটির কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্বস্ত চালক পাওয়া যায় না। চালকদের সময়জ্ঞান নেই। তাই এ সেবা বন্ধ করা হয়েছে।
এদিকে সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহাব উদ্দিন মোল্লা বলছেন, তাঁদের স্কুলের নাম ভ্যানে না লেখার জন্য মালিকদের নোটিশ দিয়েছেন। আর লাইফ প্রিপারেটরি স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা মৌখিকভাবে ভ্যানচালকদের প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করতে নিষেধ করেছে।
কিন্তু অন্যান্য স্কুলের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, বিনা অনুমতিতে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম ও লোগো ব্যবহারের বিষয়টি বেআইনি হলেও তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি। এটা তাঁদের নজরদারিতেও নেই। কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওবায়দা বানু বলেন, এযাবৎ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
অভিভাবকেরা নিরুপায়: সরকার ২০১১ সালে ১৪টি বাস নিয়ে ‘স্কুল বাস সার্ভিস’ নামে একটি সেবা চালু করেছিল। মিরপুর ১২ থেকে আজিমপুর যাত্রাপথে এই সেবার আওতায় এখন মাত্র দুটি বাস টিকে আছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) পরিচালক শামসুল আলম (বদলি হওয়া) বলেন, যাত্রী কম হওয়ায় বাস কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর কথা, যানজটের কারণে বাস সময়মতো পৌঁছায় না বলে অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা এ সেবায় ভরসা করেন না।
এদিকে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. ফাইজ স্কুল ভ্যানে যাতায়াত করে। তার মা নাজমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, স্কুল ভ্যান তাঁর কাছে নিরাপদ মনে হয় না। আগে বড় দুই ছেলেমেয়েকে নিজেই স্কুলে আনা-নেওয়া করেছেন। এখন অসুস্থতার কারণে বাধ্য হয়ে ছোট ছেলেকে স্কুল ভ্যানে দিয়েছেন। বললেন, ‘আর তো কোনো উপায় নাই।’
মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা সুলতানা রাজিয়া স্কুল ভ্যানে ছেলেকে দিতে ভরসা পান না। কিন্তু তিনি অসুস্থ। প্রতিদিন ছেলেকে আনা-নেওয়া করতে খুব কষ্ট হয়। এই অভিভাবকেরা মনে করেন, ছাত্রদের আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা সরকার বা স্কুলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলে সেটাই সবচেয়ে নিরাপদ হবে।