সময়ের প্রয়োজনে কত হিসাবই উল্টে যায়। এক সময়ে যা ফেলনা, তা অন্য সময়ে মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক সময়ে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর কাজটি যে উপায়ে করতেন, প্রয়োজন ঠিক রেখে শুধু উপায়টি পাল্টে ফেলতে হয় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এমন অনেক হিসাব–নিকাশই পাল্টে দিয়েছে। তাই তো আট–দশ হাজার কোটি টাকার অনলাইন বাজারে বিক্রির তালিকায় শীর্ষে থাকা পণ্যগুলোর চাহিদা গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। আর মাঝারি সারিতে থাকা মুদি পণ্যের চাহিদা এখন তুঙ্গে।
করোনাভাইরাসের ঘরবন্দী সময়ে অনেকেই নিত্য প্রয়োজনীয় শুকনা পণ্যের পাশাপাশি কাঁচাবাজার কেনার জন্য নির্ভর করছেন এখন অনলাইন বাজারের ওপর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনলাইন কেনাকাটার চাহিদার প্রায় শতভাগই এখন মুদি পণ্য। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে ওষুধ। পোশাক বা বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদা প্রায় নেই বললেই চলে।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি ব্লকের বাসিন্দা ওয়াদিয়া হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, এখন তিনি মুদি পণ্যের শতভাগ বাজার করছেন অনলাইন থেকে। তাঁর বাসায় লোকজনের সংখ্যা মোট ১০ জন। এর মধ্যে গাড়ির চালক, বাড়ির নিরাপত্তা কর্মী, গৃহ সহকারী সহ ছয়জন কর্মী রয়েছেন। করোনাভাইরাস নিয়ে দেশে উদ্বেগ শুরু হওয়ার পর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ ইত্যাদি শুকনা পণ্য বাজার থেকে কিনে নেন। পরে লকডাউন শুরুর পর কাঁচাবাজারের জন্য তিনি পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন অনলাইনের ওপর। তিনি বলেন,' পঁচনশীল খাবার সংগ্রহ করা আমার জন্য এক রকম চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। আমি সাপ্তাহিক সবজি বাজার, মাছ, মাংস,দুধ, ফল এবং ওষুধ পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনলাইন থেকে কিনে নিচ্ছি। লকডউনের সময়ে আমার পুরো জীবন এখন অনলাইন বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। এখন আর এটা শখ বা সময় বাঁচানোর পন্থা নয়, পুরোপুরিভাবে প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে।'
মো, রাফিদ করিম নামে আরেকজন অনলাইন বাজারের ক্রেতাও একই কথা বললেন। তিনি 'মাই আউটসোর্সিং লিমিটেড' নামে একটি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। মা, স্ত্রী, ভাই–ভাবি সহ পরিবারে ছয়জন তাঁরা। তিনি বলেন, 'লকডাউন পরিস্থিতিতে আমরা সবাই বাসায়ই অবস্থান করছি। মার্চের শেষের দিকে আমাদের মাসের বাজার শেষ হয়ে যায়। এরপর আমি অনলাইনে একটি প্রতিষ্ঠানে শুকনা ও কাঁচাবাজারের একটি তালিকা পাঠিয়ে পণ্য মূল্য পরিশোধ করি। ওই প্রতিষ্ঠানের মাস্ক ও গ্লাভস পরিহিত একজন কর্মী বাসার নিচে এসে বাজার রেখে যান।'
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অনলাইন বাজারের প্রায় পুরোটাই এখন মুদি পণ্যের চাহিদা বলে জানালেন ই–কর্মাস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই–ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহেদ তমাল। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক হিসাব অনুসারে, আট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার অনলাইন বাজার রয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে অনলাইনে মোট কেনাকাটা ৮০ শতাংশ কমে এসেছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম মুদি বাজার। কেনাকাটার গতি দেখে বোঝা যাচ্ছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন মুদি পণ্য কেনা বেড়েছে কয়েক শ গুণ। তিনি বলেন, 'হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে ডিজিটাল বায়ার। এই সময়ে অনেকের কাছে কেনাকাটার একমাত্র উপায় অনলাইন। মূলত কেনাকাটা হচ্ছে মুদি পণ্য। এরপর ওষুধ। পরিস্থিতির কারণে অনেকে সংযমী হচ্ছেন, মিতব্যয়ী হচ্ছেন। ফলে পোশাক, ফ্যাশন পণ্য, শখের পণ্য ও বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদা অনেক কম। তবে ফ্রিজ, ওভেনের মতো কিছু ইলেকট্রনিকস পণ্যের চাহিদা রয়েছে।
আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, এখন পণ্য বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া বা ডেলিভারি ম্যানের সংকট রয়েছে। যেসব পেশাজীবীরা পরিস্থিতির কারণে সাময়িকভাবে এখন বেকার রয়েছেন, তাঁদের ডেলিভারি ম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সংকট দূর করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে ই–ক্যাব। জরুরি পণ্য পরিবহণের আওতায় অনলাইনের বিভিন্ন পণ্য পোঁছে দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছ থেকে ই–ক্যাব তার সদস্যদের জন্য অনুমতিপত্র যোগাড় করে দিয়েছে।
তিনি জানান, ই–ক্যাবে মোট সদস্য সংখ্যা এখন ১১০০ 'র ওপরে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সদস্য সংখ্যা এক শ বেড়েছে।
অনলাইনভিত্তিক মুদি পণ্যের বিক্রয় প্রতিষ্ঠান চালডাল ডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ওয়াসিম আলী প্রথম আলোকে বলেন, মার্চের শুরুতে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে দিনে আড়াইহাজার পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হতো। পরে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজারে। পণ্য ডেলিভারি নিয়ে তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। রাজধানী জুড়ে তাদের তিনশ ডেলিভারি ম্যান কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, 'করোনাভাইরাস পরিস্থিতির শুরুতে অনেক মানুষ আতঙ্কে পণ্য মজুত করা শুরু করেন। কেউ কেউ ২০০ কেজি চালও কেনেন। ওই রকম হঠাৎ চাহিদার সঙ্গে পরিচিত না হওয়ায় চাহিদা মেটাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছিলাম। সপ্তাহ খানিক ওই পরিস্থিতি ছিল। ২৫ মার্চের পর অনলাইনে অনেক বেশি অর্ডার পাওয়া শুরু করি আমরা। রমজান শুরুর পর কেনাকাটায় স্থিতিশীলতা এসেছে।'
অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য গুছিয়ে ক্রেতার কাছে বিভিন্ন বাহনের মাধ্যমে ডেলিভারি ম্যানকে দিয়ে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে 'শপআপ' নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের সহ প্রতিষ্ঠাতা সিফাত সরোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, লোকজন বাইরে বেরিয়ে কেনাকাটা করতে পারছেন না বলে অনলাইনে কেনাকাটা অনেক বেড়ে গেছে। আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যেসব অর্ডার পৌঁছে দিচ্ছি, সেগুলোর প্রায় সবই মুদি পণ্য। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে আমরাই পণ্যগুলো সোর্সিং করছি, প্যাকেট করছি এবং ডেলিভারি ম্যানকে দিয়ে বাই সাইকেল, মোটরসাইকেল, ভ্যান, কাভার্ডভ্যানে করে পৌঁছে দিচ্ছি বাড়ি বাড়ি।'