২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের অর্থায়নে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে গিয়েছিলাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কীভাবে দলীয় পদ্ধতিতে পাঠদান করে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ভালো ফলাফল করা যায় এ বিষয়ে ওরিয়েন্টেশন দেওয়ার জন্য। কীভাবে দল গঠন করবেন, কীভাবে দলীয়ভাবে বসবেন, কার দায়িত্ব কী হবে, কীভাবে শিক্ষকেরা ক্লাস নেবেন এবং গাইডের সাহায্য ছাড়াই কীভাবে ভালো ফলাফল করা যায়, এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। আটুলিয়া ইউনিয়নের হেঞ্চি বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টি (নতুন পদ্ধতিতে পাঠদান) গ্রহণ করেন। সম্প্রতি প্রকাশিত সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, এই বিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থী পাসসহ ৮৪.২১ শতাংশ শিক্ষার্থী এ গ্রেড পেয়েছে (এ প্লাস, এ ও এ মাইনাস)। কোনো শিক্ষার্থী সি বা ডি গ্রেড পায়নি। বিদ্যালয়টিতে দলীয় পদ্ধতিতে পাঠদানের ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
২০১৯ সালে দলীয় পদ্ধতিতে পাঠদান মনিটরিং করতে গেলাম। দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে পেলাম দলীয় পদ্ধতিতে পাঠদানের ফলে তার মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, সে ভালো ফল করছে। তার কাছে বিষয়টি বিস্তারিত জানতে চাইলে বলল, দলীয়ভাবে পাঠদানের পদ্ধতিতে যেহেতু সে দলনেতা, তাই তাকে অন্যদের পড়া বুঝিয়ে দিতে হয়। ফলে ক্লাসের পড়া অনেকটা ক্লাসেই হয়ে যায় এবং বাড়িতে গিয়ে তাকে আর বেশি পড়তে হয় না। কোনো বিষয়ে সে নিজে বা দলীয়ভাবে না বুঝতে পারলে শিক্ষকের সহযোগিতা নিয়ে বুঝে নেয়। ফলে তার আর প্রাইভেট পড়তে হয় না। আর যেহেতু বাড়িতে পড়ার চাপ কম থাকে, তাই সে নিজে নিজে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর লিখে নোট তৈরি করে। এভাবে সে গাইড বই ও প্রাইভেট শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই স্কুলে বিভিন্ন পরীক্ষায় ভালো ফল করতে থাকে। তার মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
মেয়েটির নাম শিমু আক্তার। সে শ্যামনগরের আটুলিয়া ইউনিয়নের যোগেন্দ্রনগর গ্রামের দিনমজুর মো. নূর ইসলাম ও মাহফুজা খাতুনের মেয়ে। ৪ বোনের মধ্যে শিমু তৃতীয়।
২০২০ সালে হেঞ্চি বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ হতে এসএসসি পরীক্ষায় সে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে (গোল্ডেন এ প্লাস)। যশোর বোর্ডের অধীনে তার এসএসসি পরীক্ষার রোল নম্বর ১৩৫৪৭৬। বাবার ইচ্ছা মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবেন। শিমু প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৫ এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিমু একজন ভালো বিতার্কিক এবং সুন্দর করে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে।
শিমুর এ ফলের পেছনে শিক্ষকদের পাশাপাশি তার বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভাব-বাংলাদেশের কথা অকপটে স্বীকার করে। ভাব বাংলাদেশ থেকে সে বিতর্ক ও ইংরেজি বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছে এবং বিভাগীয় পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। শিমু ভাব বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ। শিমু ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়। তবে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার দিনমজুর বাবার আর্থিক অসচ্ছলতা। উপকূলের মানুষকে জীবন ও জীবিকার জন্য প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়। এভাবে সংগ্রাম করে লেখাপড়া করে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া একেবারে সহজ কথা নয়। আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই উপকূলের অদম্য মেধাবী শিমু আক্তারকে। দোয়া করি, তার লেখাপড়ার পথ যেন মসৃণ হয় এবং ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে পারে।
*সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ভাব-বাংলাদেশ