অদম্য যাঁরা

কোনো বাধা তাঁদের দমাতে পারেনি। করোনা মহামারির সময় মানুষ যখন ঘরবন্দী, তখনো তাঁরা মাঠে। ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এজেন্ট–হকাররা বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন প্রথম আলো

লিটন আহমদ
লিটন আহমদ

প্রতিবন্ধী হলেও তিনি পরিশ্রমী

দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি কথা বলতে পারেন না। বাক–প্রতিবন্ধী মানুষটি খুব সকালে আড়মোড়া ভেঙে চলে আসেন পত্রিকার পরিবেশক কার্যালয়ে। পরিবেশকের কাছ থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে পত্রিকা বুঝে নিয়ে ছুটে চলেন গ্রাহকদের কাছে।

লিটন আহমদ ১২-১৩ বছর ধরে পাঠকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন প্রথম আলো পত্রিকা। সিলেট নগরের বন্দরবাজার থেকে প্রতিদিন পত্রিকা সংগ্রহ করে হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর মাজার, আম্বরখানা মোড়সহ ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে তিনি পত্রিকা বিক্রি করেন। পত্রিকা বিক্রির আয় দিয়েই চলে তাঁর সংসার। তিন মেয়ে ও স্ত্রীসহ পাঁচজনের সংসার তাঁর।

নগরের বন্দরবাজারের প্রথম আলোর পরিবেশক আলমগীর এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন ও সিলেট মহানগর হকার সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম বলেন, বাক্–প্রতিবন্ধী হলেও লিটন আহমদ অত্যন্ত পরিশ্রমী। প্রতিবন্ধী হলেও পরিশ্রম করেই সংসার চালান তিনি।

আবুল হোসেন

পত্রিকা বিক্রি আবুল হোসেনের নেশা

পেশায় পত্রিকা বিক্রেতা, বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পত্রিকা বিক্রি করে চলেছেন। অসুস্থ হলেও তাঁকে ঘরে আটকে রাখা যায় না। এটা পেশা হলেও কখন নেশায় পরিণত হয়েছে, বলতে পারেন না আবুল হোসেন। বয়সের ভারে আগের মতো ছুটতে না পারলেও খুব সকালে চলে আসেন বিতরণকেন্দ্রে।

বড় ছেলে মন্টু মিঞা পত্রিকা বিক্রি করেন চিরিরবন্দর উপজেলায়। দ্বিতীয় ছেলে মোস্তাকিম পত্রিকা বিক্রি করেন পার্বতীপুর উপজেলা শহরে। ছোট ছেলে মিজানুর রহমান প্রতিবন্ধী হলেও পত্রিকা বিক্রি করেন। নাতি নাজমুল হোসেন বিপ্লবও পত্রিকা বিক্রি করতেন। কিন্তু করোনাকালে আয় কমে যাওয়ায় পেশা বদল করে ফেলেছেন।

আবুল হোসেনের ব্যাপারে পত্রিকার এজেন্ট নূর হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি পত্রিকা বিক্রি করেন। বয়সের কারণে এখন কানে কম শুনতে পান, তাতে অবশ্য পত্রিকা বিক্রির সময় গ্রাহকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় কোনো সমস্যা হয় না।

আবদুল মান্নান

একজন দক্ষ সংগঠক আবদুল মান্নান

হকাররা পাঠকদের হাতে পত্রিকা পৌঁছে দেন হকারদের সংগঠন ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড ও সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের মাধ্যমে। এটি সংবাদপত্রের হকারদের সবচেয়ে বড় সংগঠন। গত জুনে ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতির দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। এর আগে ২০১৮ সালে তিনি সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে সমিতির মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে হকারদের অধিকার আদায় সুসংগঠিত করেন। করোনা পরিস্থিতিতে পাঠকসংখ্যা কমে গেলে ও হকারদের আয় কমে গেলে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে কঠিন সময় পার করেন এবং সংগঠনকে আবার ঘুরে দাঁড় করান।

ফেনীর ফুলগাজী থানার শ্রীচন্দ্রপুর গ্রামে ১৯৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন ৪৯ বছর বয়সী আবদুল মান্নান। বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোটবেলায় ঢাকায় চলে আসেন। বাবার পত্রিকার ব্যবসা ছিল এবং ১৯৮৮ সালে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনিও পত্রিকার ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

তিনি ঢাকা কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক।

আবু বক্কর সিদ্দিক

ব্যবসা তাঁর পেশা আর পত্রিকা পড়া নেশা

টানা ৪০ বছর ধরে পত্রিকা সরবরাহ করছেন আবু বক্কর সিদ্দিক। তিনি নেত্রকোনা জেলায় একমাত্র সংবাদপত্র পরিবেশক। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, কনকনে শীত বা যেকোনো দুর্যোগ সামলে তিনি হকারের সাহায্যে প্রতিদিন সকালে জেলার ১০টি উপজেলায় পাঠকের হাতে পত্রিকা পৌঁছে দেন সময়মতো।

আবু বক্কর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, পত্রিকা সরবরাহ করা যেমন তাঁর পেশা, তেমনি পত্রিকা পড়াটাও তাঁর নেশা। দেশের সব কটি জাতীয় দৈনিকের পাশাপাশি স্থানীয় পত্রিকাগুলোরও তিনি নিয়মিত পাঠক।

আবু বক্কর সিদ্দিকের পত্রিকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শহরের ছোটবাজার এলাকায়। ছয়তলা নিজস্ব ভবনের নিচে তাঁর পত্রিকার ব্যবসা। কথা বলে জানা গেছে, পত্রিকা সরবরাহের এই ব্যবসা তিনি পৈতৃকভাবে পেয়েছেন। ১৯৮১ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই তিনি এই ব্যবসায় মন দেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর থেকে তিনি পুরোদমে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায়ী হলেও তিনি প্রতিদিন সকাল আটটার মধ্যে হকারের কাছে সব পত্রিকা বিলি করে বসে পড়েন পত্রিকা পড়তে।

মো. আবুল কালাম

করোনাজয়ী মো. আবুল কালাম

১৯৫৭ সালে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে জন্ম নেওয়া আবুল কালাম হকারদের পাশে থেকে সংবাদপত্রশিল্পকে এগিয়ে নিতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। সদরঘাট এলাকায় পত্রিকা ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ দিয়ে সংবাদপত্রের সঙ্গে পথচলা শুরু হয়।

আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, সংবাদপত্রশিল্পকে এগিয়ে নিতে ঢাকা শহরের সব সেন্টার সুপারভাইজার, ডিস্ট্রিবিউটর ও হকারের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। এ ছাড়া হকারদের দুঃসময়ে পাশে থাকার পাশাপাশি পত্রিকার পাঠক বাড়াতে তিনি ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন।

আবুল কালাম গত বছরের ২০ আগস্ট করোনায় আক্রান্ত হন। তিনি করোনা জয় করে আমাদের মধ্যে ফিরে এসে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন এবং পত্রিকার বিক্রি বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। তিনি হকার সমিতির সার্কুলেশন ম্যানেজার। তাঁর তিন ছেলে প্রবাসে (অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে) সফলতার সঙ্গে পড়াশোনা ও চাকরি করছেন।

ইসমাইল হোসেন

ছয় ভাই মিলে ব্যবসা সামলাচ্ছেন

সিলেট জেলার প্রথম আলোর পরিবেশক প্রতিষ্ঠান আলমগীর এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মো. ইসমাইল হোসেন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ইসমাইল হোসেন। প্রতিষ্ঠানের নামটি তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের নামে দেওয়া হয়েছে। ছয় ভাইয়ের সবাই এ ব্যবসায় যুক্ত। পারিবারিকভাবে ছয় ভাই মিলেই পত্রিকার পরিবেশকের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ভাইদের মধ্যে হাফিজ উল্লা ও আহসান হাবিব ব্যবসার যাবতীয় হিসাব দেখভাল করেন। আহসান হাবিব আইন পেশায় জড়িত। নিয়মিত ভোরে পত্রিকার পরিবেশক প্রতিষ্ঠান থেকে দিন শুরু করে পত্রিকার বিতরণ শেষে আইনি সহায়তার জন্য কর্মস্থলে যান। ইসমাইল হোসেনের আরেক ভাই ইমরান হোসেন বর্তমানে প্রবাসে অবস্থান করছেন। এর আগে তিনিও ভাইদের সঙ্গে ব্যবসায় সময় দিয়েছেন। দেখভাল করেছেন পরিবেশক প্রতিষ্ঠানটির। এখনো তিনি নিয়মিত ব্যবসার খোঁজখবর নেন।

অন্য দুই ভাই জাহাঙ্গীর আলম ও আলমগীর হোসেন হকারদের পত্রিকা বিতরণের পাশাপাশি নতুন গ্রাহক তৈরি করেন। অভিযোগ জানতে কখনো নিজেরাই পত্রিকা হাতে ছুটে যান।

এম এ রাজ্জাক

হকারদের ছায়া দেন এম এ রাজ্জাক

স্বাধীনতার আগে অল্পসংখ্যক পত্রিকা ছিল। স্বাধীনতার পর সংবাদপত্রগুলো আলাদা আলাদা এজেন্টের মাধ্যমে পত্রিকা বিতরণ করত। কিন্তু তখন হকাররা তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। হকারদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের প্রধান উপদেষ্টা এম এ রাজ্জাক।

এম এ রাজ্জাক ১৯৬৬ সালে সংবাদপত্র পেশায় সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তিনি কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, হকাররা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত। সংবাদপত্রশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ও এগিয়ে নিতে হকারদের নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি। ঢাকায় হকারদের অধিকার আদায় ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হকারদের নিয়ে সমিতি গঠনে ভূমিকা রাখি।

হকারদের জন্য কল্যাণ ফান্ড গঠন এবং সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ফান্ডের সক্ষমতা বাড়াতে এম এ রাজ্জাক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। করোনাকালে হকারদের আয় কমে গেলে এবং আর্থিকভাবে সংকটে পড়লে তিনি হকারদের পাশে দাঁড়ান।

মোহাম্মদ হাশেম বিশ্বাস

সাগরতীরে আলোর সারথি হাশেম

সমুদ্রের নগর কক্সবাজারের লালদীঘি এলাকায় পত্রিকার এজেন্ট মোহাম্মদ হাশেমের দোকানটি যেন একটি খুদে গ্রন্থাগার। এখানে এসে পাঠকেরা পত্রিকা পড়েন। আগ্রহী পড়ুয়ারা যে যাঁর পছন্দমতো পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও অন্যান্য প্রকাশনা পড়তে পারেন বিনা বাধায়। পত্রিকা যাঁরা কিনে পড়তে পারেন না, তাঁদের মধ্যে আলো বিতরণের এই ব্যবস্থা মোহাম্মদ হাশেম স্বপ্রণোদিত হয়ে করেছেন।

কক্সবাজারের পাঠকবান্ধব এজেন্ট হাশেম ১৯৮৬ সাল থেকে পত্রিকার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিনি একজন পাঠকবান্ধব মানুষ। তিনি তাঁর ব্যবসায় মুনাফার দিকের চেয়ে বেশি খেয়াল করেন মানুষের কল্যাণের দিকটা।

এ জন্যই তাঁর দোকানে পাঠকেরা বিনা মূল্যে পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। অতিমারির সময় তিনি অসহায় ও দরিদ্র হকারদের পাশে এসে দাঁড়ান। জেলা প্রশাসক, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে গেছেন হকারদের জন্য সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে। তাঁরা সাড়াও দিয়েছেন। দুর্দিনে হকাররা পেয়েছেন বিভিন্ন রকমের সাহায্য।

নজরুল ইসলাম

স্ত্রী তাজকেরাতুল ইসলামের নামে এজেন্সি

১৯৭৩ সালে অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম সংবাদপত্র ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন। তিনি তাঁর স্ত্রী তাজকেরাতুল ইসলামের মালিকানায় ‘সঞ্চিতা’ নামে সংবাদপত্র এজেন্সি প্রতিষ্ঠান চালু করেন।

সম্ভবত কোনো নারীর নামে ও মালিকানায় বাংলাদেশে এটিই প্রথম সংবাদপত্র এজেন্সি হাউস। শুরু থেকেই জাতীয় ও স্থানীয় প্রায় সব পত্রিকার এজেন্ট হিসেবে রাজশাহী শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

নজরুল ইসলাম রাজশাহী শহরের নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় অবসরে যান ২০০১ সালে।

নজরুল ইসলাম

হকারদের পাশে থাকেন নজরুল

‘আমরা সবাই একসঙ্গে করোনা দুর্যোগের মোকাবিলা করতে চেষ্টা করেছি। একজন হকারের পক্ষে একা যে কাজটা করা সম্ভব হতো না কোনো দিন, সেটাই আমরা এক জোট আছি বলেই করতে পেরেছি,’ কথাগুলো বললেন চিটাগাং সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ওরফে লিটন।

নজরুল ইসলাম জানান, গত বছরের মার্চে করোনা বিধিনিষেধ শুরু হলে বেশির ভাগ হকার শহর ছেড়ে চলে যান। কয়েক দিন যেতে না যেতে সবাই আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে যান। সে সময় সমিতি সবাইকে শহরের কর্মস্থলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। এ সময় প্রথম আলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। ওই সময় হকারদের বাড়ি থেকে আনার জন্য যানবাহন দিয়ে সাহায্য করেছে প্রথম আলো।

হকাররা শহরে ফিরলেও পকেটে তো টাকাপয়সা নেই। তখন হকার্স সমিতির নেতারা গেলেন মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মেহেদী হাসানের কাছে। সমিতির পক্ষ থেকে সমিতির সদস্যদের জন্য সাহায্যের আবেদন জানানো হলে মেহেদী হাসান সহায়তা করেন।

রকিবুল ইসলাম

পত্রিকা বেচে লেখাপড়ার খরচ চালান রকিবুল

ইচ্ছা ও দৃঢ় মনোবল থাকলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। দারিদ্র্য কোনো বাধা নয়। ফেনীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র রকিবুল তা প্রমাণ করেছেন। রকিবুল ইসলাম তাঁর পড়ালেখার খরচ চালাতে ফেনী শহরে পত্রিকা বিলি করেন। কারও কাছে হাত না পেতে তিনি নিজের শ্রমের বিনিময়ে টাকা আয় করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন।

রকিবুল ইসলাম সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার একটি গ্রামের স্কুল থেকে ২০১৩ সালে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন ফেনী সরকারি কম্পিউটার ইনস্টিটিউটে। শহরে ছাত্র পড়িয়ে কম্পিউটার ইনস্টিটিউট থেকে চার বছর মেয়াদি ডেটা কমিউনিকেশন ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর ফেনী ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হন, এই কোর্স এখন শেষ হওয়ার পথে।

কম্পিউটার ইনস্টিটিউটে লেখাপড়ার সময় সরকারি বৃত্তি দিয়েই রকিবুলের খরচ চলত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তাঁকে আয়ের সন্ধান করতে হয়। কাজও পেয়ে যান। প্রায় তিন বছর ধরে প্রথম আলোসহ জাতীয় দৈনিক পত্রিকা বিতরণ শুরু করেন তিনি। সাইকেল চালিয়ে বাসায় বাসায় গিয়ে পত্রিকা পৌঁছে দেন। মাস শেষে বিল আদায় করেন।

রকিবুলের বাবা খলিলুর রহমান একজন প্রান্তিক চাষি। কৃষিকাজ ছাড়াও বর্ষায় মাছ শিকার করে বিক্রি করেন। আয়রোজগার খুবই সামান্য। মা–বাবা, দুই বোন, দুই ভাইসহ ছয়জনের টানাটানির সংসার। ইতিমধ্যে দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই গ্রামের বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে।

রাজু আহমেদ

ভালো কিছু করতে পারলেই আনন্দ পান তিনি

নিজের সামর্থ্য খুবই কম। তারপরও মানুষের মঙ্গলের জন্য ভালো কিছু করতে পারলেই আনন্দ পান তিনি। আগামী দিনেও সাধ্যমতো করার চেষ্টা করবেন বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন মো. রাজু আহমেদ।

করোনাকালে পত্রিকার বিক্রি অনেক কমে যায়। পত্রিকার মাধ্যমে করোনা ছড়ায় না বলে যতই প্রচার করা হোক, অফিস–আদালত, বাসাবাড়ি, দোকানপাট ও সাধারণ পাঠক পত্রিকা কেনা কমিয়ে দেন। তাই হঠাৎ বেকায়দায় পড়ে যান মাঠপর্যায়ের হকাররা। আয়রোজগার বন্ধ হয়ে অনেকে পরিবার–পরিজন নিয়ে পথে বসেন। অনেকে পেশা ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবতে শুরু করেন। এমনই দুর্দিনে হকারদের পাশে দাঁড়ান ফেনীর পত্রিকা পরিবেশক রাজু আহমেদ।

শুরুর দিকে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হকারদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন। বিষয়টি অনেকের চোখে পড়ে। বিশেষ করে ফেনী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাসরীন সুলতানা ও ফেনী পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম মিয়াজি তাঁর পাশে দাঁড়ান। রাজু আহমেদ এই দুজনের কাছে অভাবগ্রস্ত হকারদের নামের তালিকা পাঠান। সে অনুযায়ী তাঁরা দুই দফায় খাদ্যসহায়তা দেন।

ইজাহার আলী

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হকারের সংখ্যা ৭৩

ইজাহার আলী যশোর শহরের একজন সংবাদপত্র পরিবেশক। দীর্ঘ ৫৮ বছর নিরলস পরিশ্রমের ফলে আজ তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। সংবাদপত্রের ব্যবসায় তিনি যাত্রা শুরু করেন একজন হকার হিসেবে ১৯৫৮ সালে। ১৯৬৩ সালে চারটি পত্রিকার এজেন্ট হিসেবে সংবাদপত্র ব্যবসা শুরু করেন। মাত্র চারটি পত্রিকা ও চারজন হকার নিয়ে শুরু করা তাঁর এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমানে হকারের সংখ্যা ৭৩। প্রথম আলোসহ ৩৫টি পত্রিকার এই এজেন্টের ব্যবসায় বর্তমানে ১০ জন কর্মচারী নিযুক্ত আছেন। করোনায় হারিয়েছেন স্ত্রীসহ আরও প্রিয়জনকে। করোনা ইজাহার আলীর মানসিক, শারীরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে এক চরম বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেয়। তবু বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর স্বপ্নের পত্রিকা ব্যবসাকে। তিনি হলেন বর্তমান সমাজের একজন সফল জীবনযোদ্ধা।

খুরশিদ আনোয়ার

প্রথম আলোর সঙ্গে ২৩ বছর ধরে

বাবা এস এম ওয়াহেদ বক্সের হাত ধরে যশোরের একজন পত্রিকার পরিবেশক হিসেবে কাজ শুরু করেন খুরশিদ আনোয়ার। যশোর শহরে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। দেশের অন্যতম প্রাচীন যশোর শহরের মুজিব সড়ক সিভিল কোর্টের সামনে এ পত্রিকার ব্যবসার সূত্রপাত ব্রিটিশ আমল, অর্থাৎ ১৯৪৫-৪৬ সাল থেকে চলছে। তাঁর বাবার চাকরিসূত্রে এ ব্যবসার সূচনা। ১৯৬৩ সাল থেকে পত্রিকার পরিবেশক হিসেবে খুরশিদ আনোয়ার কাজ শুরু করেন। পাকিস্তান আমলে ছিল ‘বক্স ব্রাদার্স’, তারপর ‘আনোয়ার আলম ব্রাদার্স’ নামকরণ করা হয়।

১৯৯৮ সাল থেকে প্রথম আলো পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন খুরশিদ আনোয়ার। তিনি বলেন, ‘২৩টি বছর প্রথম আলো পত্রিকা সফলভাবে অতিক্রম করল। দেশসেরা এ পত্রিকার সঙ্গে আমি শুধু এজেন্ট হিসেবে নয়, আত্মিকভাবেও যুক্ত। সেরা এজেন্ট হিসেবে আমি প্রথম আলো–২০১৫ এজেন্ট সম্মাননা পেয়েছিলাম। আমি চাই, পত্রিকাটি আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাক।’

হেকমত উল্লাহ

রাজশাহী অঞ্চলের সেরা করদাতা

হেকমত উল্লাহ ১৯৭২ সালে রাজশাহীতে রেলওয়ে বুক স্টল নামে সংবাদপত্রের এজেন্সি ব্যবসা শুরু করেন। শতবর্ষ ছুঁতে যাওয়া বর্ণিল জীবনের অধিকারী হেকমত উল্লাহ বর্তমানে অবসর যাপন করছেন। ব্যবসায় সততার নিদর্শনের স্বীকৃতি হিসেবে রাজশাহী অঞ্চলের সেরা আয়করদাতা নির্বাচিত হয়েছেন একাধিক বছর। প্রথম আলোর একজন এজেন্ট হিসেবে তাঁর অনেক অর্জন আছে।

ষাটের দশক থেকেই পত্রিকার ব্যবসায় জড়িত ছিলেন হেকমত উল্লাহ। সেই সময় তিনি সৈয়দ মাসুদ আহমেদ নামের এক সংবাদপত্র এজেন্টের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তারপর নিজের ব্যবসায় নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রায় পাঁচ দশক নিজেই তদারকি করেছেন। বর্তমানে তাঁর ছেলে শহিদুল্লাহ ব্যবসার দেখভাল করছেন।

মোহাম্মদ আলী

৭ সাব-এজেন্ট এবং ৪০ জন হকার

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার এজেন্ট মোহাম্মদ আলী। তাঁর বাবা আবদুলরশিদ ১৯৫৫ সাল থেকে পত্রিকা ব্যবসা শুরু করেন ডাকযোগের মাধ্যমে। ১৯৭২ সাল থেকে ঢাকা হকার্স সমিতির মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করেন।

বাবার হাত ধরে ১৯৮৩ সাল থেকে নিজের নামে ব্যবসায় নামেন মোহাম্মদ আলী। তাঁর অধীনে ৭ সাব-এজেন্ট এবং ৪০ জন হকার কাজ করছেন নিয়মিত। পত্রিকা ব্যবসার পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবসাতেও সফল তিনি।

বাংলাদেশ সংবাদপত্র এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বের পাশাপাশি এই সংগঠনের আওতায় কুমিল্লা জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন।

এভাবে দীর্ঘ ৩৮ বছর পত্রিকা ব্যবসা করে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন অনেক। স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে তাঁর সুখের সংসার।