>করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগের সক্ষমতা, সমন্বয়হীনতা এবং ব্যর্থতার বিষয়গুলো নিয়ে নানা রকম আলোচনা হচ্ছে। ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী স্বাস্থ্য প্রশাসনে কাজ করেছেন, এখন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব। স্বাস্থ্য খাতের জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শরিফুজ্জামান।
প্রথম আলো: করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কতটা প্রস্তুত ছিল?
ইহতেশামুল হক: আমাদের এখানে কোভিড–১৯ ধরা পড়ে ৮ মার্চ, এর তিন মাস আগে ধরা পড়ে চীনের উহানে। ইতিমধ্যে আরও তিন মাস পার হয়েছে। আগের তিন মাস এবং পরের তিন মাসের প্রস্তুতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। হয় তাদের এই সংক্রমণের ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা ছিল না, অথবা তারা বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। এই ভাইরাস রোদে পুড়ে যাবে, বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে—এমন ধারণা কারও কারও ছিল। আর এসবের ফলটা হচ্ছে, করোনা এখন সামনে দৌড়াচ্ছে, পেছন থেকে ধাওয়া করে আমরা ধরার চেষ্টা করছি। কিন্তু সময়টা কাজে লাগালে আমাদের সুযোগ ছিল করোনাকে ধাওয়া করা।
প্রথম আলো: কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ তো বারবার বলছে, তারা প্রস্তুত। আপনি ঘাটতি দেখলেন কোথায়?
ইহতেশামুল হক: প্রথম তিন মাস আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ বিষয়টি তো পাত্তাই দেয়নি। এর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলল, টেস্ট টেস্ট এবং টেস্ট। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) দুই হাজার কিট নিয়ে বলল, ‘আমরা প্রস্তুত’। এই যে হিরোইজম দেখাল, তা কিসের ভিত্তিতে? ওই ইনস্টিটিউটের কাজ তো গবেষণা করা, তারা তো রিসার্চ ল্যাবরেটরি বা সার্ভিস ল্যাবরেটরি নয়। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) বা সেন্ট্রাল ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) কোথায়? এটা তো তাদেরই কাজ।
আমাদের কত হাসপাতাল আছে, কোন কোন জেলায় সংক্রমণ বেশি হতে পারে, কোভিড ও নন-কোভিড চিকিৎসার ধরন কী হবে, সেসব নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ ভাবতে শুরু করল এই কিছুদিন আগে। সেই ভাবনা এখনো শেষ হয়েছে বলা যাবে না। এখনো স্বাস্থ্য বিভাগের প্রকৃত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার অনেক গরমিল রয়েছে। আমরা শুধু আওয়াজ দিয়ে গেলাম, বিষয়টি দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক।
প্রথম আলো: স্বাস্থ্য বিভাগ তাহলে কী কী করতে পারত?
ইহতেশামুল হক: প্রথম কথা টেস্টের ব্যবস্থা করতে পারত। এখন ৫২টি ল্যাবে পরীক্ষা করছেন, এটা আগে করলেন না কেন? তিন মাস সময় পেলেন, ৬৪ জেলায় ৬৪টি ল্যাব বসালেন না কেন? দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার মেশিন ছিল, এগুলো কাজে লাগালেন না কেন? তারা তা জাতির এই ক্রান্তিকালে কাজ করতে প্রস্তুত ছিল। এখন একেকটি মেশিন (আরটিপিসিআর) তিন গুণ দামে কিনছেন। আবার ২০২০ সালে এসে ২০০৯ সালের মেশিন কিনছেন। এই পুরোনো মডেলের মেশিনে ভালো ফল পাচ্ছেন না। তখন যদি আধুনিক মেশিন কিনতেন, কম দামেই কিনতে পারতেন। আবার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় পেতেন।
একজন মানুষ আড়াই থেকে তিনজনকে সংক্রমণ করতে পারে। আমরা যদি এক্সকে আটকাতে পারতাম, তাহলে ওয়াই বা জেড আক্রান্ত হতো না। তাদের থেকে অন্যরাও আক্রান্ত হতো না। স্বাস্থ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং অংশীজনদের অনেকেই শুরু থেকে একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, এতে মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা গেছে। কখনো শ্রমিকদের ঢাকায় ডেকে আনলাম, আবার কখনো বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। বিদেশফেরতদের নিয়েও শুরু থেকে নাটকীয় সব ঘটনা ঘটেছে। যখন সরকারের শীর্ষ পর্যায় হস্তক্ষেপ করেছে, তখন পরিস্থিতি একটু বদলেছে। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
প্রথম আলো: কোভিড, নন–কোভিড হাসপাতাল বিতর্কের শেষ কোথায়? কী করা উচিত ছিল?
ইহতেশামুল হক: উহানের শিক্ষা হচ্ছে, ৪১ শতাংশ মানুষ হাসপাতাল থেকে কোভিডে আক্রান্ত হয়। বিদেশে কিছু হাসপাতালে কোভিড, নন–কোভিড রোগীদের ব্যবস্থা আছে, এটা সত্য। কিন্তু সেখানে তো হাসপাতাল বানানো হয় হাসপাতালের ডিজাইনে। সুতরাং তারা চাইলে কোভিড ও নন-কোভিড একই হাসপাতালে চিকিৎসা করতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে অনেক হাসপাতাল বানানো হয়েছে সাধারণ বা বাণিজ্যিক ভবনে, পরে সেটিকে হাসপাতালে রূপ দেওয়া হয়েছে। এসব বাস্তবতা মাথায় না রেখে স্বাস্থ্য বিভাগ যাকে–তাকে চিঠি দেওয়া শুরু করল। ওটা কোভিড হাসপাতাল করতে হবে, ওখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপন করতে হবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসব নির্দেশ পর্যালোচনা করে দেখা গেল, আসলে সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্য বিভাগ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দূরে থাক, কারও কারও আংশিক ধারণাও নেই। একটি হাসপাতাল কোভিড ডেডিকেটেড করলে সেখানে আইসিইউ লাগে, অক্সিজেন প্ল্যান্ট লাগে, তিন গুণ না হলেও দ্বিগুণ জনবল লাগে, তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে এবং এ রকম আরও নানা প্রস্তুতি নিতে হয়। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ মনে করল, চিঠি পাঠালেই বুঝি সবকিছু হয়ে যাবে। এখনো সেই অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়েছে, তা বলা যাবে না।
প্রথম আলো: এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের মনোভাব কী?
ইহতেশামুল হক: শুরু থেকে চিকিৎসকেরা খুবই বিরক্ত ছিলেন। তাঁদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর (পিপিই) নামে রেইনকোট পরানো হয়েছে। ওটা পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘামে ভিজে চিকিৎসকেরা দায়িত্ব পালন করেছেন। নকল এন–৯৫ মাস্ক দেওয়া হয়েছে। থাকার জায়গা নিয়ে নানা রকম জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব নিয়ে কথা বলায় কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একদিকে তাঁদের ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা বলছি, অন্যদিকে তাঁদের সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া নিয়ে টালবাহানা করেছি। এর ফলে যা হওয়ার তা–ই হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের প্রায় তিন হাজার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত, এদের এক হাজারই ডাক্তার।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার পর এখন পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। আসলে এসব বিষয় তো প্রধানমন্ত্রীর দেখার কথা নয়। তাহলে মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালক, পরিচালকসহ শত শত কর্মকর্তার কাজটা কী?
প্রথম আলো: স্বাস্থ্য ক্যাডারে জনবল, পদায়ন, পদোন্নতি—এগুলোর কী অবস্থা?
ইহতেশামুল হক: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কারা চাকরি করবে, তাদের যোগ্যতা কী হবে, তা পরিষ্কার বলা আছে। সেখানে দু-চারটি পদ ছাড়া বাকিদের অবশ্যই মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু ন্যূনতম প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা না থাকা অধ্যাপকদের স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগে এমন প্রায় ২২টি পরিচালকের পদ আছে, যেগুলোর মধ্যে ১৫-১৬ জনেরই এমন অবস্থা। এর ফলে ক্ষতিটা হচ্ছে দুই দিকে; তাঁরা প্রশাসনেও ভালো করতে পারছেন না, আবার তাঁদের পড়ানো থেকে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্রথম আলো: এসব কর্মকর্তা তো নিজের ইচ্ছায় আসেননি। কারা, কেন তাঁদের এনেছে?
ইহতেশামুল হক: এঁরা এসেছেন ‘মাই মেন’ (আমার লোক) হিসেবে কোটারি স্বার্থ সংরক্ষণ ও নিজেদের ব্যক্তিগত ‘ইগো’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে। কেউ মন্ত্রীর লোক, কেউ সচিবের, কেউবা মহাপরিচালকের। আমার বক্তব্য হচ্ছে, আপনার পছন্দের লোক প্রশাসনিক দায়িত্ব আসবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার সেই লোকটা যেন ওই কাজের যোগ্য হন। স্বাস্থ্যের কাজটি হয় সিঁড়ি বেয়ে। এই সিঁড়ি যিনি পার হননি, তাঁর পক্ষে মাঠে একটি চিঠি পাঠানো ছাড়া আরও কিছু বোঝা সম্ভব নয়।
প্রথম আলো: আপনি কি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবেন, প্রশাসনিক যোগ্যতায় কাদের ঘাটতি আছে?
ইহতেশামুল হক: এখনকার যিনি মহাপরিচালক, তিনি বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক। তাঁর মাঠের কাজ সম্পর্কে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। এরপর পরিচালক (হাসপাতাল) স্বাস্থ্য অর্থনীতি এবং পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এপিডেমিওলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় হাজার কোটি টাকার কাজ হয়। সেখানে প্রি-ক্লিনিক্যাল ও ক্লিনিক্যাল বিষয়ের অধ্যাপকেরা এসব কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একজন অধ্যাপক তো অধ্যাপনা করবেন, গবেষণা করবেন, রোগী দেখবেন, প্রয়োজনে মেডিকেল কলেজগুলোতে অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ হবেন, এটাই স্বাভাবিক এবং কাম্য ছিল।
প্রথম আলো: অধিদপ্তর তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে, মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা তাহলে কী?
ইহতেশামুল হক: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোন কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত, অনেক সময় তা বুঝতে পারি না। তবে এটা বুঝতে পারি যে সেখানকার কাজকর্মের গতি মন্থর। এখনকার সংকটময় পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় পেশাজীবীদের কাছ থেকে পরামর্শ নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ নেই, ফলে পেশাজীবীরা ধারেকাছেও যান না। অথচ প্রতিটি দেশেই জাতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কাজ সেই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে পরামর্শ দেওয়া, সহায়তা করা। কিন্তু এখানে সেই সুযোগ বা পরিবেশ নেই।
প্রথম আলো: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেনাকাটা মানেই অনিয়ম, দুর্নীতি—এমন একটি ধারণা হয়ে গেছে। আপনারা কী দেখেন?
ইহতেশামুল হক: দুর্নীতি তো আর দেখা যায় না। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়—এটা পারসেপশন। এই পারসেপশন এখন বাস্তবতার চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। স্বাস্থ্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও অসম্ভব টেকনিক্যাল খাত। গত কয়েক বছর শুধু কেনাকাটাই যেন ছিল মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ। সিভিল সার্জন অফিস কিংবা ছোট-বড় হাসপাতালগুলোতে কী কী কেনাকাটা হবে, কোথায় অবকাঠামো নির্মিত হবে—এগুলো নিয়েই মন্ত্রণালয় ব্যস্ত ছিল। সরকারি কেনাকাটার কিন্তু নিয়মনীতি আছে। মাঠ থেকে চাহিদা আসবে, অধিদপ্তর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ঠিক করবে। এরপর মন্ত্রণালয় আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী অনুমোদন দেবে। কিছু কেনাকাটা করবে প্রতিষ্ঠানে, বড় কেনাকাটা হবে সিএমএসডির মাধ্যমে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেশির ভাগ কেনাকাটা ওপর থেকে নিচে যায়। ঠিকাদার গিয়ে মেডিকেল কলেজকে বলে, অমুক যন্ত্রপাতি কিনতে হবে, অধিদপ্তরে তালিকা পাঠান, না পাঠালে মন্ত্রণালয় ফোন করে তালিকা চায়। মন্ত্রণালয় ও ঠিকাদারের কথা না শুনলে বদলি বা সাময়িক বরখাস্ত। কোনো কোনো কর্মকর্তা চাপ মেনে নেয়, কেউবা ওই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজে কিছু সুবিধা নেয়। এরপর কেনাকাটা ও ঠিকাদারের বিল নেওয়া শেষ। কোনো কোনো ঘটনায় তৎপর হয় দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদক। তখন কিন্তু মন্ত্রণালয়ের ফোন করা বা চাপ দেওয়া সেই ব্যক্তিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ঠিকাদারও দেখায় সে দরপত্র অনুযায়ী কাজ করেছে, যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে এবং বিল নিয়েছে। ফেঁসে যান হাসপাতালের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা। টেলিফোনে কাজ দেওয়ার পর এখন দুর্নীতি দমনের মামলায় জেলে কিংবা বিচারের অপেক্ষায় আছেন বেশ কয়েকজন। আর যাদের হুকুমে কাজটি হয়েছে, তারা যেন ধোয়া তুলসীপাতা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি কারা করেছে, এটা গণমাধ্যম, দুদক, মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দাসহ সবাই কমবেশি কিন্তু জানে। আফজাল নামের একজন কেরানি একা কীভাবে দুই হাজার কোটি টাকা লুটপাট করতে পারে? তার গডফাদার কে? সে কাকে, কাকে ভাগ দিয়েছে—এসব তো অজানা নয়। এত বড় ঘটনা ঘটেছে স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক, পরিচালক—এঁরা কি কিছুই জানতেন না? কীভাবে সে দেশের বাইরে পালিয়ে গেল? স্বাস্থ্যের শীর্ষ কয়েকজন ঠিকাদারের ধনসম্পদের খোঁজ নেন, আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নেন। এগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করেন, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করেন। অন্যথায় বলে দেন, কিছুই হয়নি। সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু এভাবে আর চলতে পারে না।
প্রথম আলো: দুর্নীতি ঠেকাতে মন্ত্রণালয়ের কি কোনো ভূমিকা নেই?
ইহতেশামুল হক: একটি উদাহরণ দিই, তাহলে বুঝবেন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা। নকল মাস্ক দেওয়া হলো। এ নিয়ে কত হইচই। মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করল একজন অতিরিক্ত সচিবকে দিয়ে। অভিযোগ কিন্তু তাঁর চেয়ে বড় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এরপর তিনি প্রতিবেদন দিলেন। একটা ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি করা হলো। কার দায়, কে দুর্নীতি করেছে—সেসব কিন্তু আর জানা গেল না। বালিশ–কাণ্ড, পর্দা–কাণ্ড, এখন মাস্ক–কাণ্ড—এসব ঘটনা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এই মন্ত্রণালয়ের অনেকে হয় হতাশ, না হয় দুর্নীতিবাজ।
প্রথম আলো: বলা হয়ে থাকে, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ—স্বাচিপ বা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন—বিএমএ এবং সরকারসমর্থক চিকিৎসক নেতারা বদলি, পদোন্নতি, কেনাকাটাসহ নানা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। এর সত্যতা কতটুকু?
ইহতেশামুল হক: আসলে স্বাচিপ বা বিএমএর নামে যত কথা বলা হয়, বিষয়টা তেমন নয়। এটা নিজেদের ব্যর্থতা অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা। আরও স্পষ্টভাবে বললে আমলাতন্ত্রের কৌশল। বাংলাদেশে তদবির জীবনের অংশ। বিচ্ছিন্নভাবে দু–একজন তদবির যে করে না, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। যদি কেউ তদবির করেও থাকে, আপনি তা শুনবেন কেন? আপনার দায়িত্ব তো নিয়মনীতির মধ্যে কাজ করা। কেউ নিজে যদি দুর্নীতিবাজ হয়, তাহলে সে অন্যের ওপর দায় চাপাবে, অন্যকে জড়ানোর চেষ্টা করবে। গত ১০-১৫ বছরে স্বাস্থ্য খাতে কত রকম দুর্নীতি হয়েছে, দুদক অনেকগুলো মামলাও করেছে। কিন্তু স্বাচিপের কোনো নেতার নাম তো আসেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বাইরে এবং মহাপরিচালকের কক্ষের বাইরে লেখা আছে, ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’। এই দেশে কেউ কি এটা বিশ্বাস করে, সেখানে দুর্নীতি হয় না?
প্রথম আলো: স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্টির কি কোনো জায়গা নেই?
ইহতেশামুল হক: অবশ্যই আছে। আসলে এখনকার এই পরিস্থিতির কারণে নেতিবাচক বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে। আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা আছে। প্রাইমারি হেলথ কেয়ার আর ইপিআই বিশ্বের নজরকাড়া সাফল্য পেয়েছে। পোলিও নির্মূল হয়েছে। ম্যালেরিয়া প্রায় নির্মূলের পথে। আমরা টিবি ও এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছি। ধনুষ্টংকার, হাম—এগুলো কদাচিৎ দেখা যায়। কমিউনিটি ক্লিনিক আজ বিশ্বের রোল মডেল। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু হ্রাসে এমডিজির সফল বাস্তবায়নের পর এসডিজির সঠিক লক্ষ্যমাত্রায় চলমান।
প্রথম আলো: সরকারের কাছে চিকিৎসক সমাজের নেতা হিসেবে আপনার প্রত্যাশা কী?
ইহতেশামুল হক: করোনা–পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কোনো দুর্নীতি দেখতে চাই না। দুর্নীতির পক্ষে না থাকার কারণে কোনো কর্মকর্তার শাস্তিমূলক বদলি বা ওএসডি দেখতে চাই না। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলার অবসান চাই। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়াতেই হবে। হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বিপুল পরিমাণে জনবল নিয়োগ করে জনগণের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে, এটাই মূল চাওয়া।
ইহতেশামুল হক চৌধুরী: মহাসচিব, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।