বিশ্ববাজারে এলএনজির দর চড়া। আর বাংলাদেশ এখন অনেকটাই এলএনজিনির্ভর হয়ে আছে। ফলে দেখা দিয়েছে নানা সংকট।
অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতাই দেশের বর্তমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকটের বড় কারণ। প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহে সমস্যা এবং এর মূল্য বৃদ্ধির কারণেই বিশ্বব্যাপী এখন জ্বালানিসংকট দেখা দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে বিশেষজ্ঞরা সত্তরের দশকের বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার সঙ্গে তুলনা করছেন। তবে সে সময়ে সংকটের মূল কারণ ছিল জ্বালানি তেলের কম সরবরাহ। আর এবারের সংকটের কারণ প্রাকৃতিক গ্যাসের অস্বাবাভিক মূল্য বৃদ্ধি।
তবে বাংলাদেশের তেল নেই, কিন্তু গ্যাস আছে। কিন্তু সেই গ্যাস উত্তোলনে মনোযোগ না দিয়ে সরকার দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমদানির ওপরই নির্ভরশীল থেকেছে। জ্বালানি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অনির্ভরযোগ্য পণ্য। এর দর একই রকম থাকবে, তা কখনোই দেখা যায়নি। কিন্তু সরকার থেকে গেছে ঝুঁকিপূর্ণ আমদানির ভরসাতেই। ফলে যখন বিশ্বব্যাপী গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে, তখন আর কম দামে এলএনজি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের অভিজ্ঞতা নিতে হচ্ছে সারা দেশের মানুষকে, ব্যাহত হচ্ছে শিল্প উৎপাদন। মূলত গত এক যুগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার যতটা মনোযোগ দিয়েছে, এর কাঁচামাল সরবরাহের দিকে তেমন নজরই দেয়নি।
২০১১ সালে ফরাসি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান স্ল্যামবার্জার এক সমীক্ষা চালিয়ে বলেছিল, বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে কিছু সংস্কার ও পরিবর্তন আনলে তিন বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ কোটি (৫০০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাসের উত্তোলন বাড়ানো সম্ভব। সরকার নিজ উদ্যোগে স্ল্যামবার্জারকে দিয়ে এই সমীক্ষা চালালেও সংস্কারের পথে আর যায়নি।
আবার বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিজয় করেছে ২০১২ সালে ও ভারতের সঙ্গে ২০১৪ সালে। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমারের কাছ থেকে বাংলাদেশ পায় ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার এবং ২০১৪ সালের ৮ জুলাই ভারতের কাছ থেকে পায় ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার। সেখানেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ। অথচ মিয়ানমার ঠিকই সেখানে গ্যাস পেয়েছে।
গ্যাস উত্তোলনের কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই হঠাৎ ২০১৫ সালে সরকারের পক্ষ থেকে বলা শুরু হয় যে গ্যাসের মজুত দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। যে গ্যাস আছে, তা দিয়ে আর ১৫ বছর চলবে। ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর এক সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীও বলেছিলেন, সামনে কঠিন দিন আসছে। ১৫ বছর পর দেশের গ্যাস একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে।
এভাবে আতঙ্ক ছড়ানোর মধ্যেই সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির কথা জোরেশোরে বলতে শুরু করেছিল। তখনই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, গ্যাস দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার তথ্য প্রচার করার কারণ হচ্ছে উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা। শেষ পর্যন্ত তা–ই করা হয়েছে। এভাবেই জ্বালানি খাতকে প্রায় পুরোপুরি আমদানিনির্ভর করা হয়, যা ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তখন এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও সরকার কর্ণপাত করেনি।
দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সব পরিকল্পনাই এখন এলএনজির ওপর। এই এলএনজি পুরোটাই আমদানি করতে হয়। এ জন্য টার্মিনাল নির্মাণ ও পাইপলাইন তৈরিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সরকার নিচ্ছে বড় বড় প্রকল্প।
এলএনজি উৎপাদনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ কাতার। বাংলাদেশ মূলত কাতার ও ওমান থেকেই এলএনজি কিনে থাকে। এক বছর আগেও খোলা বাজারে (স্পট মার্কেট) প্রতি মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজির মূল্য ছিল ৩ থেকে ৪ ডলার। সেটি এখন ৩৮ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ফলে সরকার এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্রগুলো জানায়, দেশে এখন দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুট। সাধারণত গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করা হয়। কিন্তু কয়েক দিন ধরে ক্রমান্বয়ে এর সরবরাহ কমানো হচ্ছে। দেশে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। শিল্পকারখানায়ও বিপুল পরিমাণ গ্যাস লাগে। এলএনজি কেনা বাড়াতে না পারলে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোরও কোনো সুযোগ আপাতত নেই। কেননা বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আপাতত গ্যাস আমদানি আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
গ্যাস হচ্ছে এখন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত পণ্য। বিশ্বব্যাপী যে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে, তার মূল কারণ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। গত এক বছরে কেবল ইউরোপের বাজারেই গ্যাসের দর বেড়েছে ৭০০ শতাংশ, যা বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একসময় বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি নির্ধারণ করে দিত জ্বালানি তেল, সেই জায়গা এবার দখল করল গ্যাস।
কোভিড–১৯–এর কারণে এমনিতেই পণ্যমূল্য বাড়ছিল। কিন্তু গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর থেকে সেই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। বিশেষ করে গ্যাসের জন্য ইউরোপের প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর। তবে যে পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করে, তা সংরক্ষণের কথা বলে বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। রাশিয়া বলেছে নর্ড স্ট্রিম নামের এই পাইপলাইন ১১ জুলাই থেকে ১০ দিনের জন্য বন্ধ থাকবে। তবে ইউরোপের আশঙ্কা, চাপ বাড়াতে এই পাইপলাইন সহজে আর খোলা হচ্ছে না। যদি তা–ই হয়ে থাকে, তাহলে গ্যাসের দর বাড়বে আরেক দফা।
রাশিয়া থেকে গ্যাস না পেলে ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি কিনতে হবে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও কাতার এলএনজি রপ্তানি বাড়াতে বিপুল পরিমাণ নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলো এলএনজি আনতে টার্মিনাল তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে। এখন ইউরোপের ধনী দেশগুলো এলএনজি কেনা বাড়ালে এর দর আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সুতরাং বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশের পক্ষে সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
গ্যাস–সংকট কেবল ইউরোপে আর সীমাবদ্ধ নেই। গত এক সপ্তাহে এশিয়ায় গ্যাসের দর বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ফলে এলএনজির দাম বাড়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিদ্যুৎ নিয়ে সংকটে পড়ে গেছে। মিয়ানমার এলএনজি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। পাকিস্তান বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের রেশনিংয়ের দিকে গেছে। চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড এলএনজি কেনা কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশকেও যেতে হয়েছে একই পথে।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সাল ছিল গ্যাস উৎপাদনের সর্বোচ্চ সময়। এরপর কমতে শুরু করে। ২৭০ কোটি ঘনফুট থেকে ২৩০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। ২০৩০ সালে ১৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে আসবে এটা।
মূলত সরকারের ভ্রান্ত নীতির ফলে বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। তিনি বলেন, সরকার তিনটি ভুল করেছে গ্যাস খাতে। গ্যাসের উৎপাদন কমার প্রক্ষেপণ ছিল পেট্রোবাংলার, কিন্তু গ্যাস অনুসন্ধান করা হয়নি। অথচ সারা বিশ্ব এটাই করে, এটাই নিয়ম। এখন তড়িঘড়ি করছে। উৎপাদন না বাড়িয়ে ২০১৮ থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার। এখন ৪০ ডলার দাম এলএনজির। দেশীয় গ্যাসের খরচ এক ডলারের কম। আর দীর্ঘমেয়াদি আমদানিতে এলএনজি ১০ ডলার। রাশিয়া গ্যাস দেবে না, তাই ইউরোপ এলএনজি আমদানি বাড়াবে, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ কিনতে পারবে না। সামনে আরও সংকট হবে।
বদরূল ইমাম আরও বলেন, দেশের ৫০ শতাংশ গ্যাস শেভরনের ওপর নির্ভর করে আছে। কয়েক বছরের মধ্যে তাদের পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় ধস নামতে পারে। এ নির্ভরশীলতা ভালো নয়। এখন জোড়াতালি দিয়ে সমস্যা সমাধান হবে না। আর সাগরে মিয়ানমার গ্যাস তুলছে। একই সীমানায় বাংলাদেশ একটা অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারেনি। সব মিলিয়েও বিশ্বের সবচেয়ে কম গ্যাস অনুসন্ধান হয়েছে বাংলাদেশে। গ্যাস অনুসন্ধান করে না পেলে আমদানিতে যাওয়া উচিত ছিল। এখন সংকট গভীরে চলে গেছে। উত্তরণের রাস্তা একটাই, তা হলো গ্যাস অনুসন্ধান করে দেশীয় গ্যাস আবিষ্কার করা।