অডিট আপত্তির নিষ্পত্তি হয়নি। ভবিষ্যতে যাতে আপত্তি তোলার সুযোগ না থাকে, সে জন্য হচ্ছে নতুন নীতিমালা।
নির্বাচনী প্রশিক্ষণে বক্তৃতা ভাতা নেওয়া নিয়ে অডিট আপত্তি ওঠার পর এখন প্রশিক্ষণসংক্রান্ত নীতিমালা করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসি সূত্র জানায়, ভবিষ্যতে যাতে আপত্তি তোলার সুযোগ না থাকে, সে জন্যই মূলত নীতিমালা হচ্ছে। তাতে নির্বাচন কমিশনারদের জন্য বক্তৃতা ভাতা নির্ধারিত হয়েছে প্রতি দেড় ঘণ্টায় সাড়ে সাত হাজার টাকা।
ইতিমধ্যে নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। যেসব পদে সম্মানী দেওয়া নিয়ে অডিট আপত্তি উঠেছে, সেসব পদও খসড়া নীতিমালায় রাখা হয়েছে। ইসির আগামী বৈঠকে তা অনুমোদনের জন্য তোলা হতে পারে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয় ইসি। তখন প্রশিক্ষক হিসেবে বিশেষ বক্তা, কোর্স উপদেষ্টাসহ কয়েকটি পদ তৈরি করে সম্মানী ভাতা দিয়েছিল ইসি। বিশেষ বক্তার তালিকায় ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির তৎকালীন সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবেরা। স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নিরীক্ষায় বলেছে, সব মিলে প্রশিক্ষকদের পেছনে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রশিক্ষণের জন্য ইসির তৈরি কয়েকটি পদ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত নয়। ফলে ভাতা দেওয়ায় রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
‘সুপারভাইজিং প্রশিক্ষক’ পদে ছিলেন তৎকালীন ইসির উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, সব জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং সংশ্লিষ্ট নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এ ছাড়া কোর্স মনিটরিং অফিসার, সহকারী কোর্স সমন্বয়ক, আঞ্চলিক কোর্স সমন্বয়ক, অতিরিক্ত আঞ্চলিক কোর্স সমন্বয়ক, জেলা কোর্স সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত জেলা কোর্স সমন্বয়ক নামেও পদ ছিল।
তবে এসব পদ নিয়ে নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের কোনো নীতিমালা ছিল না। কমিশন সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে ওই সব পদ তৈরি করে সম্মানী দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে অডিট আপত্তি ওঠে। সে আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
সূত্র জানায়, খসড়া নীতিমালায় প্রশিক্ষক পদের বাইরে রিসোর্স পারসন ও বক্তার যেসব পদ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে আছে বিশেষ বক্তা, সম্প্রসারিত বক্তা, অতিথি বক্তা ও সুপারভাইজিং প্রশিক্ষক। নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণে সম্প্রসারণ বক্তা হবেন সাবেক-বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) অন্য কমিশনারেরা। মাঠপর্যায়ের প্রশিক্ষণে বিশেষ বক্তা হবেন সিইসি ও কমিশনারেরা। আর অতিথি বক্তা হবেন অতিরিক্ত সচিব থেকে জ্যেষ্ঠ সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। সম্প্রসারণ বক্তা, বিশেষ বক্তার সম্মানী ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি দেড় ঘণ্টার জন্য সাড়ে সাত হাজার টাকা।
এ ছাড়া প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনায় আটটি পদ রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো কোর্স উপদেষ্টা, কোর্স পরিচালক, সুপারভাইজিং প্রশিক্ষক, কোর্স সমন্বয়ক, সহকারী কোর্স সমন্বয়ক, মনিটরিং কর্মকর্তা, মূল্যায়ন কর্মকর্তা ও সাপোর্ট স্টাফ। ইসি এবং নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এসব পদে দায়িত্ব পালন করবেন। ইসির কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে সুপারভাইজিং প্রশিক্ষক হবেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররা।
ইসি সূত্র জানায়, সাধারণত বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে যেসব প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হয়, সেখানে এ ধরনের অনেক পদ নেই। ইসি নীতিমালাটি অনুমোদন করলে পরে তা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও অনুমোদন নেওয়া হবে। এটি হলে ভবিষ্যতে আর অডিট আপত্তি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
নির্বাচন কমিশনাররা প্রশিক্ষক নন। তাঁরা বক্তৃতা দেন। এর জন্য অতিরিক্ত সম্মানী নেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইসি স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেরা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে।বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন
ইসি সচিবালয়ের চারজন কর্মকর্তা এই নীতিমালা তৈরির সঙ্গে যুক্ত আছেন। গত জানুয়ারিতে ইসির বৈঠকে এই নীতিমালার একটি প্রাথমিক খসড়া তোলা হয়েছিল। তবে তা আরও যাচাই-বাছাই করে পরে উপস্থাপন করতে বলা হয়। এই নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ইসি সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা খসড়া চূড়ান্ত করেছেন। সামনে কমিশনের অনুমোদনের জন্য তা কমিশন সভায় উপস্থাপন করা হবে।
গতকাল বুধবার নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কোনো নীতিমালার খসড়া এখনো কমিশনে উপস্থাপন করা হয়নি।
ইসি সূত্র জানায়, এর আগে ইসির একটি বৈঠকে এই নীতিমালা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তখন কমিশনের একজন সদস্য এবং একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিছু পদে বিশেষত কমিশনার এবং সচিবের জন্য সম্মানী দেওয়া নিয়ে দ্বিমত জানিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত কমিশনাররা প্রশিক্ষণের সময় যেসব পদে থাকবেন, সেসব পদে সম্মানী প্রস্তাব করা হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনাররা প্রশিক্ষক নন। তাঁরা বক্তৃতা দেন। এর জন্য অতিরিক্ত সম্মানী নেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইসি স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেরা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে।