অটিস্টিক সন্তানের অভিভাবকদের স্বপ্নের ঠিকানা

নিজের মতো করে খেলায় ব্যস্ত সে। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
নিজের মতো করে খেলায় ব্যস্ত সে। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

কেরানীগঞ্জ মডেল থানার শ্যামলাপুর, মধ্যের চরের চার তলা অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ভবনটি অটিস্টিক সন্তানের অভিভাবকদের স্বপ্নের ঠিকানায় পরিণত হয়েছে। অটিস্টিক সন্তানদের জন্য আবাসিক হোস্টেল, ব্যায়ামের জন্য সুইমিং পুল তৈরিসহ কিছু স্বপ্ন এখনো দেখছেন অভিভাবকেরা। এই ভবনে সন্তানকে পাঠিয়ে দিনের একটি বড় অংশ নিশ্চিন্তে থাকেন তাঁরা।

বিজয় দিবসকে সামনে রেখে হাতের ছাপ দিয়ে লাল-সবুজ পতাকা গড়েছে ওরা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

বৃহস্পতিবার এ ভবনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সী অটিস্টিক শিশু ও ব্যক্তিরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। নিজস্ব রান্না ঘরেই রান্না হচ্ছে। সেখান থেকে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে সকালের নাশতা বা দুপুরের খাবার খাওয়ার মধ্য দিয়ে কখনো একা বা কখনো অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বসে খাওয়ার বিষয়টি তারা রপ্ত করছে। বয়স বা শারীরিক গঠন নয়, মানসিক বিকাশ অনুযায়ী তাদের জন্য আছে ব্যায়াম, খেলা বা পড়া, কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। নাচ, গানে মেতে আছে তারা। অভিভাবকদের কেউ কেউ এ ভবনেই সময় কাটাতে পারেন, না হয় তাঁর নিজস্ব কাজ গুছিয়ে নিতে পারেন এ সময়। ফাউন্ডেশনের দুটি স্কুল বাসে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানেই স্কুলে পাঠানোরও সুযোগ পান অভিভাবকেরা। লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব, মাল্টিপারপাস হলের কাজসহ কিছু কাজ প্রায় শেষের পথে। এগুলো হয়ে গেলে অভিভাবকেরা আরেকটু নিশ্চিন্ত হতে পারবেন।

অ্যাসেম্বলিতে একসঙ্গে ওরা সবাই। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ক্যাফেটেরিয়ার ক্যাশ কাউন্টারে বসে পশলা হিসাব মেলাচ্ছিল। তার হিসাবে কোনো গরমিল হয় না। একইভাবে অটিস্টিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অফিসের কাজ করছেন, কেউ কেউ কম্পিউটারে লেখার কাজ করছেন বা ফটোকপি ও ল্যামিনেট করার দায়িত্ব পালন করছেন। একজন কেক বানিয়ে প্রতিষ্ঠানেই বিক্রি করছেন। এভাবে অনেকেই আয় করা শুরু করেছেন। আর যে শিক্ষার্থীরা বাইরের অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্বাভাবিক কারিকুলামে পড়াশোনা করছে তাদের জন্যও আছে বিশেষ ব্যবস্থা।

বর্তমানে এ ফাউন্ডেশনে দুই শিফটে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫০। শিক্ষক আছেন ৬২ জন। অভিভাবকদের মধ্য থেকে চারজন মা এ প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতা করছেন। তবে ভবনটিতে সারা দিন থাকার পরও বোঝা গেল না, এই চার মায়ের সন্তান কারা। কেননা এই মা এবং শিক্ষকদের কাছে সব সন্তান সমান।

নিজের আঁকা ছবি হাতে পশলা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

এই ভবনটি গড়ার পেছনেও আছে একজন মায়ের কষ্ট এবং সন্তানের জন্য কিছু করার তাগিদ। পরে এই মায়ের সঙ্গে যোগ দেন অন্যান্য অভিভাবকেরা। অটিস্টিক সন্তানের একেক জনের বৈশিষ্ট্য একেক রকম, একজনের সঙ্গে আরেকজনকে মেলানোর কোনো উপায় নেই। কিন্তু অভিভাবকদের কষ্ট, আনন্দে কোনো ফারাক নেই। ৩০ বছর বয়সী সন্তান যদি নিজ হাতে তুলে ভাত খেতে পারেন, একা একা টয়লেটে যেতে পারেন তাহলেই অভিভাবকদের মুখে ফোটে রাজ্য জয়ের হাসি। যে মেয়ের বয়স প্রায় ৩০ হতে চলল, অথচ মাসিকের কথা বলতে পারেন না, মাকেই মাসিকের প্যাড পরিয়ে দিতে সেই মা বা মায়েরাই শুধু বুঝতে পারেন এর কষ্ট। তাই যেদিন থেকে চিকিৎসক জানান, তাঁদের আদরের সন্তানটি অটিস্টিক, সেদিন থেকেই শুরু হয় চিন্তা-বাবা-মা না থাকলে এই সন্তানকে কে দেখবে?

পড়ায় মগ্ন সে। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের জন্ম ২০০৪ সালে। আর কেরানীগঞ্জের নতুন ভবনটির বয়স এখনো এক বছর হয়নি। এর আগে মোহাম্মদপুর, শেখেরটেকে এক ভাড়া বাড়িতে চলেছে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসন রওনাক হাফিজের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠানটি ডালপালা মেলতে শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে বড় হতে থাকে তাঁর মেয়ে মিতিও। এই মিতির জন্ম না হলে হয়তো এ প্রতিষ্ঠানটিরও জন্ম হতো না। এ প্রতিষ্ঠানেই মিতি সারা দিন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন।

শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে নাম-ডাক শুরু হয়েছিল রওনাক হাফিজের। ১৯৮৮ সালে মেয়ে মিতির জন্মের পর থেকে তিন বছরের মাথায় সব পাল্টাতে থাকে। দেশের বাইরে নিলে চিকিৎসকেরা জানান তাঁর মেয়েও অটিস্টিক শিশু। তারপর নিজের চিকিৎসা পেশা বাদ দিয়ে শুরু করেন অটিজম নিয়ে পড়াশোনা। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেন। তারপর দেশে ফিরে মেয়ের কথা চিন্তা করেই কয়েকজন অভিভাবককে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে সোয়াক নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, তারপর গড়ে তোলেন অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন।

নির্মাণাধীন সুইমিং পুল। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

শুরুতে শুধু অভিভাবকেরা এগিয়ে এলেও আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠানটির সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। কেরানীগঞ্জের ২৩ কাঠা জমিতে বর্তমানে ফাউন্ডেশন ভবনটি যাত্রা শুরু করেছে। এই ২৩ কাঠা জমি দান করেছেন রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান। প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম কেনা, ক্লাসরুম তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে এবি ব্যাংক লিমিটেড, বিএসআরএম কোম্পানিসহ অনেক নাম যুক্ত হচ্ছে। তবে সুইমিং পুলের কাঠামো তৈরি আছে, তা শেষ করতে ৩০ লাখের বেশি টাকা লাগবে। এ ছাড়া বড় আরেকটি কাজ হলো অটিস্টিক ছেলে এবং মেয়েদের জন্য আলাদা আবাসিক থাকার জন্য হোস্টেল তৈরি করা। এটিও সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি।

রওনাক হাফিজ এসব অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এসব কাজে সহায়তা করবেন তাঁদের নামেই হবে এসব স্থাপনা।
রওনাক হাফিজ বলেন,‘বাবা-মা মারা গেলে এই সন্তানদের কে দেখবে তা আমরা কেউ জানি না। হয়তো সব অটিস্টিক সন্তানের জন্য আমরা কিছু করতে পারব না, তবে কিছু সন্তানের জন্যও যদি আবাসিকের ব্যবস্থা করা যায় তাই বা কম কীসে। তবে আবাসিকের হোস্টেল তৈরি হয়ে গেলেই দায়িত্ব শেষ হবে না। কমিউনিটিকে সচেতন হতে হবে। কমিউনিটিকে পাশে দাঁড়াতে হবে। কেননা এই সন্তানেরা যত দিন বেঁচে থাকবেন তাঁদের কোনো না কোনো কাজে অন্যের সহায়তা লাগবেই।’