অগ্রগতির যাত্রায় যুক্ত করতে হবে তরুণদের

প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল ‘ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আমাদের আশা–প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল ‘ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আমাদের আশা–প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l ছবি: প্রথম আলো

আগামী ১০ বছরের মধ্যে সব ক্ষেত্রে দেশকে এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী দেশের তরুণ সমাজ। দেশে ও বিশ্বমঞ্চে তারা বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। ‘ভবিষ্যতের বাংলাদেশ: আমাদের আশা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় দেশের প্রতিনিধিস্থানীয় কয়েকজন তরুণ এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

প্রথম আলো ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) যৌথ উদ্যোগে গতকাল শনিবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে আয়োজিত এই আলোচনায় তরুণেরা বলেন, তাঁরা সব সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর নির্ভরশীল হতে কিংবা সবকিছুর দায় সরকারের ওপর চাপাতে চান না। তবে তাঁরা আশা করেন, সরকার তাঁদের অগ্রযাত্রার পথকে নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনীয় কাজগুলো করবে। তাঁরা চান সরকার তরুণদের কাজকর্মের ইতিবাচক মূল্যায়ন করবে, রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে, দেশের তরুণদের বিশ্বমঞ্চে অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করবে।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম ও বিআইপিএসএসের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামানের স্বাগত ও সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়। তাঁরা দুজন পালন করেন সঞ্চালনার দায়িত্বও। আলোচনায় রাজনীতি, প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর অন্তর্ভুক্তি ও ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সম্পর্কে তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পায়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শানান বলেন, তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ অপরিহার্য। কারণ দেশের উন্নয়ন, নীতিনির্ধারণ, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতির নির্ধারক রাজনীতি। কোন ধরনের শাসনব্যবস্থায় আছি তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু শাসনব্যবস্থাকে সঠিক জায়গায় আনার জন্য রাজনীতির বিকল্প নেই। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি অনেক হয়েছে। অনেক কিছুই অর্জন আছে। আরও অনেক কিছু অর্জনের বাকি আছে। সেই সব অর্জনে ভূমিকা রাখতে হবে তরুণদেরই।

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনের রাজনীতি, দর্শন ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ইরিনা মাহমুদ বলেন, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বিশ্বমানের না হলে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বমঞ্চে স্থান পাওয়া যাবে না। শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, বাজেট বরাদ্দ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে পাঠ্যসূচির উন্নয়নসহ অনেক কিছু
করার আছে। অগ্রগতি মানে কাউকে পেছনে ফেলে যাওয়া নয়। সবাইকে নিয়ে এগোতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

ফাহমিদা ফাইজা ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশনের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ইউথ অ্যাডভাইজার। নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের তরুণদের আরও ইতিবাচক মূল্যায়ন দরকার। আন্তর্জাতিক অনেক কর্মসূচিতে তরুণদের অংশগ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তরুণদের বিষয়টি আরও নিবিড়ভাবে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী এ কে এম তওসীফ তানজিম আহমেদ বলেন, তরুণেরা কীভাবে দেশের কাজে লাগতে পারেন, সেটা বোঝাই কঠিন। কারণ তরুণেরা সুস্থ রাজনীতি চর্চার জায়গা পাচ্ছেন না। রাজনীতিতে যুক্ত হতে চাইলেও পারেন না। সিভিল সার্ভিস একটা ভগ্ন অবস্থায় আছে। তরুণদের মেধার যথাযথ মূল্যায়নের সুযোগ কম। এই অবস্থায় অনেক তরুণই অলস সময় কাটান।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাকিয়া হক নারী স্বাস্থ্যের অগ্রগতি উল্লেখ করে বলেন, মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমেছে। কিন্তু এ-সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে অগ্রগতি দেখানোর জন্য ২০১৭ সালের সঙ্গে তুলনা করা হয় ১৯৯০ সালকে। ফলে অগ্রগতি অনেক বড় হিসেবে প্রতিভাত হয়। আসলে ২০১৭ সালের তুলনা হওয়া উচিত ২০১৫ সালের সঙ্গে। তাহলে প্রকৃত অগ্রগতি বোঝা যায়।

আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আবু সাঈদ জুবায়ের বলেন, তরুণদের মধ্যে যে বিভাজনগুলো বিদ্যমান, সেগুলো ঘুচিয়ে ফেলতে হবে। শহর-গ্রাম, ইংলিশ মিডিয়াম-মাদ্রাসা প্রভৃতি বিভাজনের অবসান ঘটিয়ে সারা দেশের তরুণদের ভাবনাকে একীভূত করতে হবে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সুর খুঁজে নিতে হবে। তাহলেই দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে তরুণদের পূর্ণ উদ্যোগ কাজে লাগানো যাবে।

আরিফ আনজুম দীপ একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার ও উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, তরুণেরা যাতে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন, সে জন্য সরকারের কিছু সহায়ক পরিকল্পনা থাকতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি তৌহিদুর রহমান বলেন, দেশের তরুণ সমাজের অগ্রযাত্রার ধারায় শুধু নগরকেন্দ্রিক কিছু তরুণই অংশগ্রহণকারী। এরা সমাজের অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ। এর বাইরে যে তরুণেরা রয়েছেন, তাঁরাই সংখ্যায় বেশি। তাঁদের সমস্যা, চিন্তাভাবনা জানা না গেলে দেশের তরুণ সমাজের প্রকৃত চিন্তাভাবনা বোঝা সম্ভব হবে না। কাজেই তরুণদের এ দুই অংশের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করতে হবে।

লাইট হাউস এম্পোরিয়াম মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা এস আই এম শাদমান শেখ বলেন, পৃথিবীর সর্বত্র বাংলাদেশের তরুণদের অবস্থান বাড়ছে। দেশের তৃণমূলের তরুণদের সামনে চ্যালেঞ্জ আরও বড়। তাঁদের জন্যও সুযোগ তৈরি করতে হবে। তাহলেই ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে।

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদক শাদমা মালিক বলেন, দেশ থেকে তরুণদের মেধা পাচার হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত তরুণ বিদেশে অভিবাসী হচ্ছেন। কারণ দেশে তাঁদের মূল্যায়ন হচ্ছে না।

প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আশরাফুল ইসলাম বলেন, দেশে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কর্মসংস্থান হচ্ছে না। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি তরুণদের জন্য একটা বড় সমস্যা। তা ছাড়া ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কারণে যে হারে প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা, তার চেয়ে কম হচ্ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতিও আশানুরূপ নয়। আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমার, এমনকি নেপালসহ ১৮০টি দেশে ফোর-জি প্রযুক্তি চালু হলেও এখানে এখনো সবাই থ্রি-জি প্রযুক্তি সেবাই পাচ্ছে না।

গোলটেবিল আালোচনায় এ ছাড়া পিস এম্পায়ারের প্রতিষ্ঠাতা রকিবুল হাসান, টিচ ফর পিস প্রিনিউর ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা সজল কুমার দাশ, ফাতিমা আলি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ফাতিমা তুজ জোহরা, হ্যালো গভর্নেন্সের পরিচালক এস আই এম ফারহান শেখ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী সিলভিয়া রোজারিও, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাউসান সুহা, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের লামিয়া মোহসীন, আইন বিভাগের শাহরিমা তানজিনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শারমিন আক্তার শাকিলা, গ্লোবাল শেপারস কমিউনিটির কিউরেটর সোহারা মেহরোজ শাচী, বিআইপিএসএসের গবেষণা সহযোগী সাব্বির আহমেদ জুবাইর, ডেইলি স্টার-এর মুনতাকীম ইবনে সালেহীন এবং প্রথম আলোর মুশফেকা ইসলাম বক্তব্য দেন।

অনুষ্ঠানে মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান বলেন, তরুণদের দৃষ্টি আরও অনেক প্রশস্ত করতে হবে। বিশ্বের সর্বশেষ উদ্ভাবন ও পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মতো নতুন ভাবনা তরুণদের মধ্যে আসতে হবে। শুধু নগরের তরুণদের নয়, এই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে তৃণমূলের তরুণদেরও।

আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আজকের আলোচনায় স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ অনেক বদলাবে। তরুণ সমাজ তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। আজকের তরুণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও দায়িত্ব নিতে শিখেছেন। তরুণদের এই দৃঢ়তাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।