আটটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অক্সিজেন সরবরাহ যন্ত্র হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার যে তথ্য দিচ্ছে, বাস্তবে ততগুলো নেই।
বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে বৃহস্পতিবার রাত আটটা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল নয়টা পর্যন্ত ১৩ ঘণ্টায় সাতজন করোনা রোগী মারা গেছেন। এসব রোগী তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তাঁদের স্বজনদের অভিযোগ, অক্সিজেন সরবরাহ যন্ত্র হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা–সংকটে এসব রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা–সংকটের কথা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এ টি এম নুরুজ্জামানও স্বীকার করেছেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার সংকটে রোগীর মৃত্যু হয়েছে, এমন অভিযোগ কেউ করলে করতে পারেন। একসঙ্গে দুজনের বেশি রোগীকে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলায় অক্সিজেন সরবরাহের সক্ষমতা এখানে নেই। রাতে বগুড়া জেলা প্রশাসক জিয়াউল হকও এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার স্বল্পতার কারণে সংকটাপন্ন রোগীদের ব্যবস্থাপনায় অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে।
বগুড়ায় করোনা রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ধরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের ফারাক রয়েছে। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে করোনা রোগীদের জন্য হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা রয়েছে ১ হাজার ৬৭০টি। তবে গতকাল দেশের আটটি জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালভিত্তিক হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, বাস্তবে ততগুলো ক্যানুলা নেই।
শুধু হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা নয়, কোনো কোনো হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহের সংকটও দেখা দিচ্ছে। গত বুধবার সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পেয়ে পাঁচজন রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
পদে পদে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেখতে পাচ্ছি। অক্সিজেন সরবরাহ সংকটের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, নাকি স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, নাকি পিডব্লিউডি দায়ী, তা চিহ্নিত করতে হবে।অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ, সাবেক পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা
শ্বাসতন্ত্রের রোগ করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাঁরা স্বাভাবিকভাবে অক্সিজেন নিতে পারেন না। এসব রোগীর একটি বড় অংশের কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন হয়। উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহে প্রয়োজন হয় হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা। এটি দিয়ে প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ৭০ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। আর নন-রিব্রিদার (সাধারণ অক্সিজেন) মাস্ক দিয়ে একজন রোগীকে প্রতি মিনিটে সর্বোচ্চ ১৫ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব।
বগুড়ায় যে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের একজন নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার বাদশাইল গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মতিন চৌধুরী। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন বগুড়ার করোনা বিশেষায়িত সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে তিনি তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তাঁর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা (লেভেল) ৭০-এ নেমে আসে। উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন থাকলেও তা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
গতকাল সকাল সাড়ে আটটায় মারা যান বাদশাইল উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মতিন চৌধুরী। তাঁর ছেলে মোস্তাক হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাবাকে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাসপাতালজুড়ে ছোটাছুটি করেছেন। কিন্তু হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থা করতে পারেননি।
হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছি গ্রামের লিলি তালুকদার। তাঁর ছেলে এনামুল হক অভিযোগ করেন, তাঁর মায়ের অক্সিজেন লেভেল ৬৮-তে নেমে এসেছিল। কিন্তু হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থা করতে পারেননি।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে গতকাল ভর্তি ছিলেন ২৩০ জন রোগী। এর মধ্যে শ্বাসকষ্টে সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন প্রায় ২৫ জন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের মার্চে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালকে কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ভরসা ছিল সিলিন্ডারের অক্সিজেন। পরে হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ চালু করা হয়। গত ২৭ জুন শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি করে ২০০-তে উন্নীত করা হয়। রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় শুক্রবার সকালে হাসপাতাল প্রশাসন আরও ২৫টি শয্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে নাজাল ক্যানুলার সংখ্যা ৪। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখানে দুটি ক্যানুলা সচল আছে। বাকি দুটি ক্যানুলা চালু করা যায়নি।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এ টি এম নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দুটি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা বরাদ্দ পাওয়ার পর চালু করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকেও জানানো হয়েছে। এ ছাড়া আরও হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার চাহিদা পাঠানো হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনিক করোনাসংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হাসপাতালভিত্তিক হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার সংখ্যা দেওয়া হয়। অধিদপ্তরের হিসাবে, নড়াইল জেলা সদর হাসপাতাল ও করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে ২০০টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা রয়েছে। বাস্তবে হাসপাতালে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা রয়েছে মাত্র দুটি। সেই দুটি যন্ত্রও সচল নয়। ফলে নড়াইল জেলায় জটিল করোনা রোগীদের উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ করা যায় না।
নড়াইলে ২০০টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা থাকার তথ্য শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শফিক তমাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই সপ্তাহে দুটি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা পাওয়া গেছে। ক্যানুলা দুটি জেলা সদর হাসপাতালে দেওয়া হয়েছে। আর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবদুস শুকুর প্রথম আলোকে বলেন, গত রোববার দুটি ক্যানুলা পাওয়া গেছে। এখনো তা চালু হয়নি।
নওগাঁ সদর হাসপাতালে সক্রিয় কোনো হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সেখানে তিনটি আছে। নাটোর সদর হাসপাতাল এবং সিরাজগঞ্জের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে কোনো নাজাল ক্যানুলা নেই। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে এই দুই হাসপাতালেই একটি করে আছে।
জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে দুটি নাজাল ক্যানুলার কথা বলা হলেও বাস্তবে একটিও নেই। এসব জেলার গুরুতর রোগীরা রাজশাহী বা বগুড়ায় চলে যান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানুলা আছে ২৪টি। তবে গতকাল সন্ধ্যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১৬টি ক্যানুলা থাকার কথা জানিয়েছে।
গত বুধবার সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পেয়ে পাঁচজন রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। ওই হাসপাতালের নাজাল ক্যানুলার তথ্যেও গরমিল আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সেখানে ৩৮টি ক্যানুলা সক্রিয় আছে। অন্যদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সেখানে সক্রিয় হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা আছে ৩০টি।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার সংখ্যার তারতম্যের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। নড়াইলের বিষয়টি টাইপিংয়ের ভুলও হতে পারে। আবার কোথাও হয়তো হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা দেওয়া হয়েছে, তা অকেজো হয়ে পড়ে আছে, যা অধিদপ্তরকে জানানো হয়নি।
করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত অনেক হাসপাতালেই জটিল করোনা রোগীদের সেবায় অতিপ্রয়োজনীয় হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা নেই। অধিদপ্তরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতাল, গাইবান্ধা সদর হাসপাতাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল, নেত্রকোনা সদর হাসপাতাল, শরীয়তপুর জেলা সদর হাসপাতাল ও মাদারীপুর সদর হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য কোনো হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদে পদে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেখতে পাচ্ছি। অক্সিজেন সরবরাহ সংকটের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, নাকি স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, নাকি পিডব্লিউডি দায়ী, তা চিহ্নিত করতে হবে। পদ্ধতি, ব্যক্তি না আইনকানুনের সমস্যা, তা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা না গেলে এ সমস্যা দূর হবে না।’ এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, শহরের মানুষ এক হাসপাতালে অক্সিজেন না পেলে অন্য হাসপাতেলে যেতে পারেন। গ্রামের মানুষের সেই সুযোগ নেই।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]