বাংলাদেশের জনমানুষের মধ্যে একটি নতুন স্বপ্ন জাগ্রত হয়েছে জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর গণজাগরণের মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ আজ এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বিনির্মাণের ঐতিহাসিক অভিপ্রায়ে একতাবদ্ধ। এই অভিপ্রায়ের প্রায়োগিক প্রয়াসে মানুষ এখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করার সাহস পাচ্ছে। জনপ্রশাসন সংস্কার এই জন-অভিপ্রায় বাস্তবায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্ষেত্র। এই পরিবর্তনের গতিমুখ তাই বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোর বৈষম্যমূলক দিকগুলো পরিবর্তন করে একটি অধিকতর স্বচ্ছ, নাগরিক-বান্ধব, জবাবদিহিমূলক ও নিরপেক্ষ পেশাদার জনপ্রশাসন গড়ে তোলার দাবিকে জোরালো করে তুলেছে।
জনপ্রশাসন যেকোনো আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, তাই এর কার্যকর সংস্কার ছাড়া রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন অসম্ভব। কিন্তু এ দেশে যুগের পর যুগ ধরে চলা রাজনৈতিক দলীয়করণ, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং প্রশাসনিক দুর্নীতি পুরো ব্যবস্থাকে অকার্যকর ও জনবিমুখ করে তুলেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ম্যাক্স ভেবার যেমন আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন, তেমনি বাংলাদেশেও কার্যকর প্রশাসন ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যেসব প্রশাসনিক সংকট বিদ্যমান, তা শুধু কয়েকটি ওপরভাসা পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না, প্রয়োজন কাঠামোগত রূপান্তরের।
বাংলাদেশে প্রশাসনিক সংস্কারপ্রচেষ্টার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে বিভিন্ন সরকার প্রশাসনকে জনমুখী ও দক্ষ করার লক্ষ্যে ১২টি কমিশন ও কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রশাসনিক সার্ভিস পুনর্গঠন কমিটি (১৯৭২); পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন (১৯৭৭); প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি (১৯৮২); স্থানীয় সরকার কমিশন (১৯৯৭) এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন (২০০০)। এসব কমিশন ও কমিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনিক কাঠামোকে আধুনিক করা এবং সরকারি সেবার মান উন্নয়ন করা। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংস্কারের এই উদ্যোগগুলো সামান্যই সফলতা অর্জন করতে পেরেছে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠিত প্রথম কমিশন একটি একীভূত শ্রেণিহীন সিভিল সার্ভিস গঠন এবং বেতনকাঠামো সংস্কারের সুপারিশ করে। কিন্তু তৎকালীন মুজিব–সরকার বেশির ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি। পরবর্তী সময়ে জিয়া সরকারের আমলে ১৯৭৭ সালে গঠিত হয় পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন। এই কমিশনও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে আসে, যেমন সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠন। অল্প কিছুদিন টিকে থাকার পর প্রশাসনিক প্রতিরোধের মুখে এ ব্যবস্থা বাতিল হয়।
জনপ্রশাসনের অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে এর অত্যধিক কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, প্রশাসনকে জনমুখী করতে হলে উন্নয়ন কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য।
শেষ পর্যন্ত এই কমিশনের প্রভাব মূলত সামরিক কর্মকর্তাদের বেসামরিক প্রশাসনে অন্তর্ভুক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৮২ সালে এরশাদের শাসনকালে কিছু উল্লেখযোগ্য সাংগঠনিক পরিবর্তন আনা হয়, বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিসের পুনর্গঠন এবং উপজেলা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে সেখানে জনসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর কার্যাবলিকে বিকেন্দ্রীকরণ করা। এরশাদ সরকার তৎকালীন সরকারি চাকরিজীবী ও পেশাজীবীদের প্রবল বাধার মুখেও এই পরিবর্তনগুলো আনতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এরশাদ সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে গৃহীত সংস্কার পদক্ষেপগুলো নব্বই-পরবর্তী বিএনপি সরকার বাতিল করে দেয়। জনপ্রশাসনে আবার পুরোদস্তুর ঔপনিবেশিক ক্ষমতাসম্পর্ক ফিরে আসে। এরপরও একাধিক কমিটি ও কমিশন কাজ করেছে, তবে প্রকৃত অর্থে কোনো দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই পরিবর্তন সম্ভব হয়নি।
এর মূল কারণ প্রশাসনিক সংস্কারের প্রস্তাবগুলো প্রায়ই প্রশাসনের ভেতর থেকে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। সিভিল সার্ভিস, বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা তাঁদের ক্ষমতা ও প্রভাব হারানোর ভয়ে পরিবর্তনের প্রতি অনাগ্রহ দেখিয়েছেন। এ ছাড়া প্রশাসনিক সংস্কারের পক্ষে সরকারের মধ্যে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ছিল। বাস্তবায়নের জন্য অধিকাংশ কমিশনের সুপারিশ কোনো সরকারই যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। কেবল কিছু কসমেটিক পরিবর্তন হয়েছে।
মোটাদাগে, বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে বেশ কিছু কাঠামোগত সংকট বেশ স্পষ্টই চোখে পড়ে। প্রথমত, প্রশাসন এবং জনগণের মধ্যে প্রায় অনতিক্রম্য দূরত্ব বিরাজ করে, যা একধরনের ‘দাস-প্রভু’ সম্পর্ক বজায় রাখছে। জনগণের জন্য প্রশাসনের কাজ করার মনোভাবের বদলে একধরনের ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। এই মনোভাবকে সম্পূর্ণরূপে জনবান্ধব করতে হবে, যেখানে প্রশাসন জনগণের প্রকৃত সেবক হিসেবে কাজ করবে।
দ্বিতীয়ত, প্রশাসনের জবাবদিহির অভাব প্রকট। এই কাঠামো পরিবর্তন করে প্রশাসনকে নাগরিকদের কাছে সরাসরি জবাবদিহিমূলক করতে হবে, যাতে প্রশাসন তার কার্যকলাপের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে।
তৃতীয়ত, জনপ্রশাসনের রাজনৈতিক দলীয়করণ। অতীতের সরকারগুলো প্রায়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়েছে, যা প্রশাসনের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা হ্রাস করেছে। এই দলীয়করণ ও পক্ষপাতমূলক নীতির পুরোপুরি বিলুপ্তি দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষাপদ্ধতির আমূল পরিবর্তন এবং যাতে চাকরিপ্রার্থীদের মেধার মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয়, সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া। তা ছাড়া সরকারি চাকরিতে প্রচলিত অপআইনগুলো খুঁজে সেগুলো বাতিলের সুপারিশ করা। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনার বদলে পদোন্নতি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার সঙ্গে সঙ্গে মেধা, দক্ষতা ও প্রশাসনিক জ্ঞানের মূল্যায়নের বিজ্ঞানসম্মত নিরপেক্ষ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
চতুর্থত, বর্তমান জনপ্রশাসনে আন্তক্যাডার বৈষম্য প্রকট। জনপ্রশাসনে সবচেয়ে প্রভাবশালী সার্ভিস প্রশাসন ক্যাডার। প্রশাসন ক্যাডারে যে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে জনপ্রশাসনের সামগ্রিক দক্ষতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কর্মসন্তুষ্টি অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্য সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই বৈষম্য নিরসন করা জরুরি এবং প্রশাসনের পদোন্নতি, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ ও সমতাভিত্তিক নীতি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
এ ছাড়া রয়েছে ক্যাডার বনাম নন-ক্যাডার বৈষম্য। যথেচ্ছভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, সিভিল প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বিভিন্ন ভাতার নামে বিশেষ কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধাসহ নানাবিধ বৈষম্যপূর্ণ চর্চা ও বিধি প্রচলিত আছে।
জনপ্রশাসনের অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে এর অত্যধিক কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, প্রশাসনকে জনমুখী করতে হলে উন্নয়ন কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণে জোর দেওয়া উচিত, যাতে স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের চাহিদা ও সমস্যা সরাসরি প্রতিফলিত হয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায়ন করে সরকারি কর্মকর্তাদের তাঁদের নিয়ন্ত্রণের আওতায় ন্যস্ত করা উচিত, যাতে স্থানীয় জনগণের কাছে জবাবদিহির পরিবেশ তৈরি হয়। বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ভেঙে স্থানীয় বাস্তবতা এবং চাহিদা অনুযায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
এই সংকটগুলো মোকাবিলা করে জনপ্রশাসনে বৈষম্যমূলক প্রথা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি পেশাদার কাঠামো গঠন করা এখন সময়ের দাবি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন নতুন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। এই কমিশনকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে প্রশাসন সর্বদাই পরিবর্তনবিরোধী। তারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায়। তাই প্রতিরোধ আসবে। এ জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ এবং বিস্তৃত মতবিনিময় করে তাঁদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এই কমিশনকে বর্তমান সমাজ-অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে বিবেচনায় নিয়ে পূর্ববর্তী কমিশনের প্রতিবেদন ও উন্নয়ন সহযোগীদের বিভিন্ন সময় করা গবেষণা পর্যালোচনা করে এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষার্থী-জনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ তৈরি করতে হবে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য বিবেচনায় নিয়ে প্রণয়ন করতে হবে।
সংস্কারের পথে বাধা আসা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ মোকাবিলায় শক্তিশালী কৌশল গ্রহণ করতে হবে। অংশীজনদের, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া তৈরি করে প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে একটি শক্তিশালী সমর্থকগোষ্ঠী গড়ে তোলা জরুরি। জনমত গঠন, অংশীজনের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে সংস্কারের পক্ষে যথেষ্ট প্রণোদনার ব্যবস্থাও করতে হবে। অতীতের সংস্কারপ্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশজুড়ে শিক্ষার্থী-জনতার শক্তি এবং পরিবর্তনের আহ্বানকে কাজে লাগিয়ে গতানুগতিক প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
* কাজী মারুফুল ইসলাম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক