তখন খারাপ ঘটনার পর আরও খারাপ ঘটনা হুড়মুড়িয়ে ঘটে চলার দিনগুলো শুরু হয়ে গেছে।
১৯ জুলাই শুক্রবার রাত ১২টা থেকে দেশজুড়ে কারফিউ জারি হয়েছে, সেনা নেমেছে। ২০ জুলাই দুপুরের দিকে ‘সাংবাদিক’ পরিচয়ের ভরসায় শহর দেখতে বেরোই। তরুণ সহকর্মী অনিন্দ্য সাইমুম সঙ্গী হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টিএসসির সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একদল পুলিশ ও আনসার সদস্য বসে ছিলেন। ‘এমনি গল্প করব’ বলে বন্ধ টংদোকানগুলোর সামনে তাঁদের দায়িত্বশীল দুজনের সঙ্গে বসি। ক্রমে পুলিশ সদস্যটি ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতির কিছু কথা বলেন, তবে ক্ষোভ ঝাড়েন বেশি।
আনসার ভদ্রলোক আশির দশকে এরশাদের আমল থেকে কাজে আছেন। নিচু গলায় বলেন, যা ঘটছে, এমন তিনি কখনো দেখেননি। আলাপ পাড়তে আমি বলেছিলাম, সব মিটে যাক, সবাই ভালো থাকুক। বিদায়কালে তিনি বললেন, ‘আপনি যেটা বলছেন, সেটা কঠিন হবে।’
ওই আনসার সদস্য বললেন, সহজে মিটবে না, ‘এতগুলি মানুষ মরে গেছে!’ তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা রোজই বাড়ছে।
ওদিকে সেদিন আন্দোলনের প্রধান একজন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের মা-বাবা মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দপ্তরের সামনে সারা দিন বসা। বাবা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ছেলেকে ডিবি ধরে এনেছে।’
পরদিন ২১ জুলাই দুপুরের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন মুঠোফোনের খুদে বার্তায় আমাকে লিখলেন, নাহিদ ইসলাম ঢাকায় গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতাল সূত্রে বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।
কী করি? নাহিদের স্ত্রী সম্পাদনা ও প্রকাশনাসংক্রান্ত একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। সেটার কর্ণধার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগীয় ছোট ভাই। তাঁকে ফোন করলে তিনি বললেন, নাহিদ গণস্বাস্থ্যের পুরুষ ওয়ার্ডে আছেন। ১৮ জুলাই রাত নয়টা থেকে ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ। এমনি ফোনে খবর চালাচালি করতে আমরা সতর্ক থাকতাম।
সে যাহোক, প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়লকে অফিস থেকে আসতে বলে আমি গণস্বাস্থ্যে গেলাম। বেলা তখন তিনটা। থমথমে ফাঁকা পথ। হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে উটকো ভাবভঙ্গির কয়েকজন মানুষ চোখে পড়ল, তবে অন্য জনমানব বিশেষ নেই।
পুরুষ ওয়ার্ড তিনতলায়। সেখানে নাহিদের হদিস পেলাম না। উল্টো দিকে কাচের ঘরে ভাগ করা একটা বিভাগ (এখন সেখানে আইসিইউ)। একটিমাত্র ঘরে কয়েকজনের ভিড়। এক পাশের শয্যায় চাদরে পা-ঢাকা ধূসর-সবজেটে টি-শার্ট পরা এক তরুণ।
জানলাম, তিনিই নাহিদ ইসলাম। ততক্ষণে শিশিরও হাজির। আমরা আগে নাহিদের আঘাতগুলোর ছবি তুললাম, তারপর তাঁর সঙ্গে কথা বললাম। কথা রেকর্ড এবং ছবি প্রকাশ করার অনুমতি নিলাম।
সেখানে ফাতেমা তাসনীম নামের ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক কর্মীর সঙ্গেও কথা বললাম। নাহিদের মা মমতাজ নাহার, বাবা বদরুল ইসলাম ও স্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে চাইলেন না।
নাহিদকে ফিরে পেয়েছেন, তাঁকে নিরাপদে সুস্থ করে ঘরে নিয়ে যেতে পারাটাই তখন স্বজনদের কাছে বড় ব্যাপার। এক বন্ধুর বাসা থেকে তাঁকে সাদাপোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন ১৯ জুলাই শুক্রবার গভীর রাতে।
ওদিকে পুরুষ ওয়ার্ডেও আহত দুজন আন্দোলনকর্মী ছিলেন। আমরা তাঁদের সঙ্গেও কথা বললাম। নাহিদসহ সবার নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে আমরা ভয় পাচ্ছিলাম।
বেরোনোর মুখে দ্য ডেইলি স্টারের দুজন সাংবাদিককে দেখলাম। পরে জানলাম আলোকচিত্রী শহিদুল আলমও গিয়েছিলেন। তাঁরা প্রতিবেদন করেছেন, লিখেছেন। এমন সব খবর কি আর ধামাচাপা দেওয়া যায় কখনো?
তো অফিসে ফিরে শিশির ঝটপট প্রতিবেদন লিখে ফেললেন। আমি প্রাথমিক সম্পাদনা করলাম। রিপোর্টিং বিভাগের প্রধান টিপু সুলতান, বার্তা সম্পাদক রাজীব হাসানসহ আরও কয়েকজন খুঁটিয়ে পড়লেন। কিছু তথ্য জোগাড় করে যোগ-বিয়োগ করলাম।
রাতে আন্দোলনের আরও তিন সমন্বয়ক নাহিদকে দেখতে যান, সবাই মিলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সেই অংশটুকু প্রথম প্রতিবেদনের শেষে যুক্ত হয়। পালা-দৌড়ের মতো কিছু প্রতিবেদনের কাজ অনেকজনকে এগিয়ে নিতে হয়।
ইন্টারনেট ছিনতাই-হওয়া সেই সময়ে আমাদের ওয়েবসাইট বন্ধ ছিল। ২২ জুলাই পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন: সমন্বয়ক নাহিদকে তুলে নিয়ে নির্যাতন’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলো।
প্রতিবেদনের শুরুটা ছিল এমন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলামের বাঁ ঊরু, দুই বাহু আর কাঁধে বড় জায়গাজুড়ে রক্ত জমে তামাটে হয়ে আছে। শরীরে মারের চিহ্ন নিয়ে রাজধানীর একটি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছিলেন তিনি।’
নাহিদ আমাদের বলেছিলেন, তাঁকে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে ৩০-৩৫ মিনিট দূরে একটা ঘরে নিয়ে ঢোকানো হয়েছিল। কয়েকজন লোক তাঁকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ ও মানসিক নির্যাতন করেন। তবে সেসব কথাবার্তা নাহিদ সে মুহূর্তে বলতে চাননি।
একটা সময় খুব সম্ভব লোহার রড দিয়ে তাঁকে পেটানো হয়। তিনি জ্ঞান হারান। এ এমন পেশাদার মার, যা তীব্র যন্ত্রণা রেখে যায়, কিন্তু হাড় ভাঙে না, পোশাকের আড়ালে থাকে।
নাহিদ বলেছিলেন, জ্ঞান ফিরলে দেখেন, বড় রাস্তার পাশে পড়ে আছেন। সাইনবোর্ড দেখে বোঝেন, তিনি পূর্বাচলে। তারপর অটোরিকশায় বনশ্রী এলাকার বাসায় যান, দুপুরে হাসপাতালে আসেন।
অন্য সমন্বয়কদের সঙ্গে তখনো আলোচনা হয়নি, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্রথম আলোকে আন্দোলন বিষয়ে নিজের অনুধাবনের কথা বলেছিলেন নাহিদ। তখনকার ভয়ের পরিস্থিতিতে প্রতিবেদনটি খুব সতর্কভাবে দাঁড় করাতে হয়েছিল। কিন্তু আজ তাঁর সাক্ষাৎকারটি শুনে দেখছি, মূল কথাগুলো বাদ পড়েনি।
সেদিনও লক্ষ করেছিলাম, আজও শুনতে পাচ্ছি, নাহিদ ওই অবস্থাতেও ধীর, পরিমিত ও যুক্তিসংগতভাবে কথা বলেছিলেন। তাঁর গলায় কোনো অস্থিরতা বা ভয় ছিল না।
পরদিন খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, তিনি নিরাপদ জায়গায় সরে গেছেন। সেই জায়গাটি যে আসলে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালেই ছিল, তা বুঝতে পেরেছি ২৬ জুলাই শুক্রবার যখন নাহিদ ও আরও দুজন সমন্বয়ককে সেখান থেকে ডিবির হেফাজতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেদিন আবারও সেখানে গিয়ে অনেকক্ষণ ছিলাম। নাহিদের স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন; সঙ্গী ফাতেমা ভয় করছিলেন, তাঁদেরও তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। পরে নাহিদের মা ও ফুফু এলেন।
ঘরে ফিরলাম ছন্নছাড়া এক বিষাদ, অনিশ্চয়তা ও ভয় লেপটে যাওয়া মন নিয়ে। যখন যেমন সময় তিনি দেখেন, সাংবাদিকের মনে সেটার স্বাদ তো লেগে থাকেই।
কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা: পরামর্শক, বার্তা, প্রথম আলো