একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে জেনারেল-প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি, সংক্ষেপে বিএনপি। তাঁর মৃত্যুর পর দলটি ঘূর্ণাবর্তে পড়ে। একদিকে দলীয় কোন্দলে ভাঙন, অন্যদিকে নতুন শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তিনি বিএনপির রাজনীতির লিগ্যাসি বয়ে বেড়ালেও বিএনপিকে দুর্বল করে নিজেই দল বানিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। এরশাদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটা রফা করে তাদের ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এরশাদের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগ ছিল ‘মন্দের ভালো’। আওয়ামী লীগের কাছেও প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল বিএনপি, এরশাদ নন।
১৯৮০–এর দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি একটি সত্যিকার রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপসহীন ভাবমূর্তি তৈরি হয়। তার সুফল বিএনপি পায় ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। নির্বাচনটি হয়েছিল একটি অন্তর্বর্তী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। তখন থেকে দেখা গেছে দ্বিদলীয় রাজনীতি। আরও দেখা গেছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে নাগরিকেরা ভোট দিয়ে সরকার বদলাতে পারেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত চলেছে এই অবস্থা।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে প্রশাসন ক্ষমতাসীনদের পক্ষে থাকে। এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। সংকটের শুরু তখন থেকে। পরপর দুটি নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতার বৃত্তের বাইরেই থেকে যায়। আওয়ামী লীগ যে আরও অনেক দিন ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্য নানা কৌশল নেবে, এটা বোঝা যায়।
বিএনপি বুঝতে পেরেছে, ক্ষমতায় যেতে হলে নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই। মনে হচ্ছে, এবার তারা মরিয়া। সে জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে তারা এখনো অনড়। তাদের ধারণা, নাগরিকেরা যদি অবাধে ভোট দিতে পারেন এবং সেই ভোট যদি ঠিকঠাকমতো গোনা হয়, তাহলে তাদের জয়ের সম্ভাবনা আছে। আওয়ামী লীগও সম্ভবত এটা বোঝে। এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি শেষ পর্যন্ত তাদের দাবিতে অটল থাকবে কি না। মানুষ তাদের পক্ষে দাঁড়াবে কি না। অর্থাৎ এমন একটা গণজোয়ার কি তৈরি করতে পারবে, যাতে সরকার তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে।
দলীয় চরিত্র আর সরকার পরিচালনার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে পার্থক্য হলো উনিশ-বিশ। দুটো দলই পরিবারতন্ত্র লালন করে, কর্তৃত্ববাদী, ভুল করলে সেটি স্বীকার করে না এবং ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণু। বিএনপিকে বুঝতে হবে, ভোট হলে মানুষ তাদের কেন ভোট দেবে। মানুষ সরকার বদল চাইলেও তার ফসল বিএনপির ঘরে না-ও যেতে পারে। মানুষ কেন বিএনপিকে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বেছে নেবে, তার কারণগুলো বিএনপিকে স্পষ্ট করতে হবে।
একটা সাধারণ ধারণা আছে, ১৯৯১-৯৬ সালের বিএনপি সরকারের চেয়ে ২০০১-০৬ সালের সরকার অনেক অনুজ্জ্বল। বিএনপি কি এটা স্বীকার করে? ভেতরে ভেতরে স্বীকার করলেও তাদের ভেবে দেখা দরকার, কোথায় তাদের ব্যত্যয় হয়েছিল।
বিএনপি অতীতে অনেক খারাপ কাজ করেছে। যেমন উপজেলার নাম মুছে ফেলা, ঢাকায় সাতটি ফ্লাইওভার তৈরির চুক্তি বাতিল করা, নিখরচায় সাবমেরিন কেব্লে যুক্ত না হওয়া ইত্যাদি; যা পরে অনেক বেশি টাকা খরচ করে করতে হয়েছে। বিএনপির এই সিদ্ধান্তগুলো ছিল জনস্বার্থবিরোধী। তাদের বলতে হবে তারা জনস্বার্থে ভবিষ্যতে কী কী করবে।
আমরা ক্ষমতায় গেলে এই করব সেই করব, এ রকম বাগাড়ম্বর নয়। সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে, আমরা এই কাজ অত তারিখের মধ্যে শেষ করব। বর্তমান সরকার অনেক অবকাঠামো তৈরি করছে। কিন্তু প্রচুর কালক্ষেপণ হচ্ছে এবং খরচ বাড়ছে। ঠিকাদার ও ব্রোকারবান্ধব এই উন্নয়ন থেকে তারা সরে আসবে, এই ঘোষণা তাদের দিতে হবে।
সংবিধানের অনেক অনুচ্ছেদ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক আছে। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কোন কোন অনুচ্ছেদে কী কী পরিবর্তন আনবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে। ভাসা–ভাসাভাবে বললে হবে না।
দ্রব্যমূল্যের বাড়াবাড়ি রকম ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ জেরবার। বিএনপি এ নিয়ে সোচ্চার। নিত্যপণ্যের মূল্য ব্যবস্থাপনার নীতি ও কৌশল কী হবে, তা বলতে হবে।
সরকারগুলো ধারাবাহিকভাবে জনস্বার্থকে উপেক্ষা করেছে। বিএনপিকে বলতে হবে, তারা অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে। এ ক্ষেত্রে তাদের করণীয় কী? যেমন সর্বজনীন শিক্ষা, সুলভে স্বাস্থ্যসেবা এবং গণপরিবহন খাতে তারা কী কী পদক্ষেপ নেবে?
আরও কয়েকটি বিষয় বিএনপির পরিষ্কার করতে হবে, যেসব নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। যেমন ব্যাংকগুলোর পারিবারিক সম্পদ হওয়া, দলীয় মার্কায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন, দুদকের প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, প্রশাসনে দলবাজি, শিক্ষাঙ্গনে দলবাজি, রাস্তা আটকে মিছিল বা জনসভা, জ্বালানি নীতি, নদী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। ভাসা–ভাসা কথা নয়, নাগরিকেরা জানতে চান, সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও বাস্তবায়নের কৌশল।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় ছিল মন্ত্রীদের বেতন হবে মাসিক এক হাজার টাকা। আপনারা বলুন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য—কার বেতন কত হবে। আপনাদের বুঝতে হবে, মানুষ খুব কষ্টে আছে।
শেষ যে কথাটি বলতে চাই, দল করুন, ভালো কথা। কিন্তু নির্বাচিত হলে আপনারা দলের নন, দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধি হবেন। সবার দেখভাল করার দায়িত্ব তখন আপনাদের। যে এলাকায় বিরোধী দলের প্রার্থী জয় পেয়েছেন, সেখানে বরাদ্দ বন্ধ করে বা কমিয়ে দিয়ে সংকীর্ণতার পরিচয় দেবেন না। ভিন্নমতের লোকদের বিরুদ্ধে কটূক্তি করবেন না। আগের সরকারের খারাপ কাজগুলো অনুকরণ করবেন না, ভালো কাজগুলো অব্যাহত রাখবেন। তাহলে মানুষ ভাবতে শিখবে, আপনারা ভালো বিকল্প।
লেখক: গবেষক