গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ রাষ্ট্রীয় জবরদস্তি ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশে আবারও কোনো স্বৈরাচারের উত্থান ঘটুক, এটা তারা চায় না। তাদের চাওয়া, বাক্স্বাধীনতা এবং জীবনের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য মৌলিক নাগরিক অধিকার কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকাতে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করছে। সংবিধান, আইন বিভাগ, জনপ্রশাসনসহ নানা ক্ষেত্রে কাজ করছে বিভিন্ন কমিশন। এসব সংস্কারের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থার কিছু বদল ঘটতে পারে, কিন্তু দেশের ইতিবাচক রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন।
সমাজ সংগঠনের একটি বড় উপাদান ধর্ম, সে কারণে গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশে ধর্ম প্রশ্নটির মীমাংসা কী হবে, তা নিয়ে নানা রকম আলোচনা চলছে। অভ্যুত্থানকালীন স্লোগান, গ্রাফিতি ও দেয়াললিখনে দাবি উঠেছে, ‘ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ চাই।’ এ ছাড়া বাংলাদেশে মিছিলে আছে নানা রকম পতাকা, ধর্ম প্রশ্নের মীমাংসায় তাদেরও আছে বিভিন্ন রকম চাওয়া।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় ‘সেক্যুলার বাংলাদেশ চাই’ লেখা একটি দেয়াললিখনে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি কেটে পাশে লেখা হয়েছিল ‘ইনক্লুসিভ’। অর্থাৎ সেক্যুলার নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ চাই। দেয়াললিখনের এই নতুন দাবিটি দেখে যে প্রশ্ন প্রথমেই মনে আসে, সেটা হলো ধর্ম প্রশ্নে সেক্যুলার হওয়া কি অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার বাইনারি? আরও কিছু জিজ্ঞাসা এর সঙ্গে যুক্ত, যেমন অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার বাস্তব প্রেক্ষিতটি ঠিক কেমন হবে? ধর্ম প্রশ্নটির মীমাংসা সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই–বা কী রকম হবে?
আমাদের দেশে সেক্যুলার কাজ এবং সেক্যুলার হয়ে ওঠার একাধিক অর্থ প্রচলিত আছে। একইভাবে ধর্ম কথাটার তাৎপর্য এবং ধর্মীয় কাজের পরিসীমা নিয়েও আছে নানা মত। পারিভাষিক ও ব্যবহারিক অর্থের এসব ভিন্নতা ধর্ম প্রশ্নটির সঙ্গে সমাজ-রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ণয়কে প্রায়ই জটিল করে তোলে। কিছু দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। সাধারণভাবে ‘সেক্যুলার’ কথাটি দিয়ে মানুষের কাজের একটা শ্রেণিকে বোঝানো হয়, যেমন ফুটবল খেলা, পরিবেশ আন্দোলনে যোগ দেওয়া, বাড়ি বানানো—এগুলো সেক্যুলার কাজ। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যেসব কাজ করি, তার বেশির ভাগই এই শ্রেণির। অন্যদিকে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, তীর্থযাত্রায় যাওয়া, কনফেশন বক্সের ভেতর দাঁড়িয়ে পাদরির সামনে পাপ স্বীকার করা—এগুলো ধর্মীয় কাজ।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় ‘সেক্যুলার বাংলাদেশ চাই’ লেখা একটি দেয়াললিখনে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি কেটে পাশে লেখা হয়েছিল ‘ইনক্লুসিভ’। অর্থাৎ সেক্যুলার নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ চাই।
আমরা ধর্মীয় বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে গিয়ে যা করি, সেটা অধর্ম, যেমন খ্রিষ্টীয় দশ নিষেধাজ্ঞার বরখেলাপ করা। একই ব্যক্তি নামাজ পড়েন, আবার বাড়িও বানান। এই অর্থে সেক্যুলার কাজের সঙ্গে ধর্মীয় কাজের বিরোধ নেই। কিন্তু কেউ যদি বাড়ি বানাতে গিয়ে বলেন, অন্য ধর্মের কারও সঙ্গে যৌথভাবে বাড়ি বানাবেন না। তাহলে আমরা তার এই মনোভাবে সাম্প্রদায়িকতা আছে বলে ভাবতে পারি। আবার কেউ যদি বলেন, অন্য ধর্মের কারও সঙ্গে বাড়ি বানাতে তার কোনো সমস্যা নেই। তাহলে তিনি নিশ্চয়ই অন্তর্ভুক্তিমূলক। মনে রাখা দরকার, উভয় ক্ষেত্রেই কাজটা ছিল সেক্যুলার।
এ দেশে সেক্যুলার কথাটির আরেকটা অর্থ বেশ প্রচলিত। এই অর্থটা দাঁড়িয়েছে কট্টরপন্থী সেক্যুলারদের মাধ্যমে, যাঁরা সেক্যুলার কাজগুলোকেই একমাত্র যুক্তিসংগত কাজ মনে করেন। তাঁরা ধর্ম বলতেই বোঝেন সাম্প্রদায়িকতা। তাঁদের কাছে সেক্যুলার হওয়া মানে বিজ্ঞানমনস্ক কিংবা জড়বাদী হওয়া। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁরা এমন একটা একপেশে বয়ান খাড়া করেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ধর্মীয় শক্তিকে পরাজিত করে। এই কট্টরপন্থী সেক্যুলারদের মধ্যে ধর্মীয় কাজ নিয়ে বিদ্বেষভাব আছে। একই সঙ্গে আছে অসহিষ্ণুতা ও আক্রমণাত্মক মনোভাব। ধর্ম নিয়ে তাঁদের এই অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষভাব এ দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ বিস্তারে এবং ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোকে সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আজকে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া সেক্যুলার হওয়ার বাইনারি হয়ে উঠেছে, সেটা ঘটেছে এই কট্টরপন্থী সেক্যুলারদের কারণে এবং গণ-অভ্যুত্থানের আগে থেকেই এসব সেক্যুলারের ব্যাপারে একটা নেতিবাচক মনোভাব প্রবল হয়েছে। কিন্তু সেক্যুলার ধারণার উদারপন্থী অর্থের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার কোনো বিরোধ নেই।
রাষ্ট্রধারণার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক ঠিক কোথায়? রাষ্ট্রের প্রধান কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এ ছাড়া জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি সরকারকে দেশের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হয়, পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষা করতে হয়—এগুলোর কোনোটাই ধর্মীয় কাজ নয়, কিংবা এগুলোর সঙ্গে ধর্মীয় কাজের কোনো বিরোধ নেই। উপরন্তু ধর্ম কথাটা এমন ব্যাপক অর্থে একসময় ব্যবহৃত হয়েছে, যেমনটা দেখা যাবে ব্রিটিশ উপনিবেশপূর্ব বাংলার ইতিহাসে মানুষের সেক্যুলার কাজগুলোকেও ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেত। ধর্মের এই অর্থটি কর্তব্যবোধের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। এই অর্থে কোনো রাজা যদি রাজকার্যে কর্তব্যপরায়ণ থাকেন, তাহলে তিনি রাজধর্ম পালন করছেন। একইভাবে কোনো লোক যখন সাংসারিক কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেন, তখন তিনি সংসারধর্ম পালন করছেন।
কিন্তু ধর্ম নিয়ে সংকট ঘনীভূত হয় যখন কোনো ধর্মভিত্তিক দল বা গোষ্ঠী সেক্যুলার কাজগুলোকে তাদের নিজের সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিধিবিধানের ভেতর দিয়ে দেখতে চান। ধর্মের যেহেতু একটা সামাজিক ক্ষমতা আছে এবং আছে একটা সাংস্কৃতিক পরিচয়, ফলে তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রবাসনা তৈরি হয়। রাষ্ট্রের কাজ, যদিও সবই সেক্যুলার এবং জনপরিসরের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু ধর্মীয় কর্তৃত্ব এগুলোকে ধর্মীয় বিধিবিধানের ভেতর দিয়ে দেখতে চায় এবং রাষ্ট্রের কাজকে ব্যক্তিগত পরিসর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়, যা নিশ্চিতভাবেই নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং ধর্মীয় ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব নানা দেশের ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে। ইউরোপের ইতিহাস থেকে কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে, যেমন প্যাগানদের সময়ে ধর্মগুরুরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি আনুগত্যে ধর্মীয় বিধানের কোনো বরখেলাপ দেখতে পেতেন না। কিন্তু খ্রিষ্টধর্মের সামাজিক ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় একসময় দাবি ওঠে, শাসকদের থাকতে হবে গির্জার কর্তৃত্বের অধীনে। বারো ও তেরো শতকজুড়ে এই নাটকীয় দ্বন্দ্ব চলেছে পোপ এবং রাজাদের মধ্যে। তেরো শতকে পোপদের ক্ষমতা বাড়লেও চৌদ্দ শতকে গিয়ে সিভিল কর্তৃত্ব ক্রমে মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান, আইনি ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং তাত্ত্বিক বিতর্কের ভেতর দিয়ে একসময় পোপদের ক্ষমতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ যেমন কেবল বাঙালির বাসভূমি নয়, তেমনই এ দেশ এককভাবে কেবল মুসলমানের দেশও নয়, এ দেশে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের মধ্যে নানা বৈচিত্র্য আছে। কাজেই বাংলাদেশকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে দেখার মধ্যে জবরদস্তি আছে। একইভাবে কোনো ধর্মীয় বিধিবিধান দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতাকে দেখলেও জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হবে এবং ফলাফল হিসেবে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটবে। রাষ্ট্রের কাজগুলোকে হতে হবে সেক্যুলার এবং এর ব্যবস্থা হবে গণতান্ত্রিক। জনগণের সাধারণ স্বার্থগুলো রক্ষা করাই হবে রাষ্ট্রের প্রধান কাজ এবং এর ভিত্তি হবে জনগণের সাধারণ অভিপ্রায়। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ যাতে তাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কোনো বাধা ছাড়াই করতে পারে, রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে।
অন্যদিকে আমরা যদি সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং ধর্মের নামে সৃষ্টি হওয়া বিভেদ-বঞ্চনা দূর করতে চাই, তাহলে আমাদের প্রতিদিনের চর্চা থেকে প্রতিদিনের ভাষা ও আচরণ থেকে, আমাদের শিক্ষণ থেকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বীজগুলোকে উপড়ে ফেলতে হবে। কারণ, এটা স্পষ্ট যে জনগণের প্রতিদিনকার চর্চার ভেতর দিয়েই সাম্প্রদায়িকতার জমিন প্রস্তুত হয়। এই চাষাবাদ বন্ধ করা না গেলে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর পক্ষে সাম্প্রদায়িক বিভেদকে তাদের রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলে ব্যবহার করা খুব সহজ।
সর্বোপরি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক চর্চার ভেতর সহিষ্ণুতা, দয়া ও সম্প্রীতির পরিসর সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সমাজের মানুষ ভিন্নমত এবং বিশ্বাস নিয়ে সহাবস্থান করতে পারে—এটাই অনেকান্তবাদ। আমাদের সমাজকে অনেকান্তবাদী হয়ে উঠতেই হবে, কারণ, যেকোনো একান্তবাদই কর্তৃত্বপরায়ণ এবং জবরদস্তিমূলক।
* রায়হান রাইন : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক