গত দুই দশকে বেশ কয়েকটি বড় যোগাযোগ অবকাঠামো ও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু সমন্বিত পরিকল্পনা ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার অভাবে চলাচলে গতিশীলতার সুবিধা পাওয়া গেলেও অর্থনৈতিকভাবে তেমন কোনো সুবিধা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক ধারণার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আংশিক পরিকল্পনা মেগা প্রকল্পগুলোর পূর্ণ সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে ব্যাহত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কর্ণফুলী টানেলে প্রতিদিন যে পরিমান যানবাহন চলাচল করার কথা ছিল, বর্তমানে চলাচল করছে তার এক-চতুর্থাংশ। এতে সরকারকে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
১৯৯৮ সালে চালু হওয়া চার লেনের যমুনা সেতুর দুই প্রান্তে ২৫ বছর পরে এসে দুই লেনের সড়ককে চার লেনে রূপান্তরিত করাকেও সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলিটি স্টাডি) অসম্পূর্ণতা ও স্বল্পদৃষ্টি পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়। কেননা, সেতুর দুই প্রান্তে চার লেনের সড়ক আগে বাস্তবায়ন করা গেলে যমুনা সেতু উত্তরাঞ্চাল, তথা পুরো দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বেশি অবদান রাখতে পারত। আবার নির্মাণপদ্ধতি পরিবর্তিত জলবায়ুসহিষ্ণু না হওয়ায় এবং নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান ঠিক না থাকায় ব্যয়বহুল মহাসড়কও দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ার নজির রয়েছে।
অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রকল্প নেওয়া, যথাসময়ে প্রকল্প শেষ না করা এবং সড়ক নির্মাণে বরাদ্দ থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণে আলাদা কোনো বরাদ্দ না থাকার অভিযোগও আছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব, ঠিকাদারের সক্ষমতার ঘাটতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ না থাকায় সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে তুলনামূলকভাবে বেশি খরচ হয় এবং সময়ও বেশি লাগে। যানজট নিরসনে শুধু উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হয়, কিন্তু গ্রেড-সেপারেটেড ইন্টারচেঞ্জ তৈরি করা হয় না। এতে উড়ালসড়কগুলোয় ওঠানামার পথেই ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।
যোগাযোগ খাতের সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়োজন পরিকল্পনা কমিশনের সক্ষমতা তৈরি, যেখানে অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাদার পরিকল্পনাবিদেরা থাকবেন; থাকবে যেকোনো প্রকল্পের চুলচেরা বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করার পূর্বাভিজ্ঞতা। একই সঙ্গে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাল বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত। অবকাঠামোর কর্মক্ষমতা সর্বাধিক করার জন্য পরিচালনক্ষমতা বাড়াতে হবে। মাল্টিমোডাল ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন সিস্টেম, স্ট্রাকচারাল হেলথ মনিটরিং, ওভারলোড নিয়ন্ত্রণ, অনুমোদনহীন যানবাহনের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি উন্নত প্রযুক্তি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকল্পে সংযুক্ত করতে হবে। অবকাঠামোর গুণমান ক্রমাগত বাড়াতে হবে। অবকাঠামো এমন হতে হবে, যেখানে নিরাপত্তা, টেকসই সমাধান ও স্বপ্রবর্তিত নিয়ন্ত্রণের মেলবন্ধন ঘটে। যানজটের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য সেন্ট্রাল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এক্সপ্রেসওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরির ক্ষেত্রে বর্তমানে অবস্থিত চলমান সড়ক নেটওয়ার্কে হস্তক্ষেপ না করে নতুন সম্পূর্ণ প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত ও বাধাহীন ইন্টারচেঞ্জ–সংলিত টেকসই উচ্চগতির আর্টেরিয়াল কনফিগারেশনের এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের গোল্ডেন কোয়াড্রিল্যাটারাল নেটওয়ার্ক একটি উত্তম উদাহরণ।
জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাল বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত। অবকাঠামোর কর্মক্ষমতা সর্বাধিক করার জন্য পরিচালনক্ষমতা বাড়াতে হবে।
আমরা যখন উড়ালসড়ক, সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামো নির্মাণ করি তখন প্রায়ই ভূমি ব্যবহারের বিষয়কে অবহেলা করি। ভূমি ব্যবহারের বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বেশ ভালো সড়কও চার থেকে পাঁচ বছর পর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শক্ত কোনো নীতি না থাকা এর অন্যতম কারণ। কিছুদিন পরেই সড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনা বা হাটবাজার গড়ে ওঠে। তাতে ভালো সড়কও অল্প সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। শুধু সড়ক নির্মাণ করলে হবে না, ভূমি ব্যবহারের সঙ্গে বৃষ্টির পানি নির্গমণের সমন্বয় করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূমি ব্যবহারের বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মহাসড়কে অবৈধ ও অননুমোদিত যান, হালকা যান চলাচল সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে অধিগ্রহণকৃত অতিরিক্ত জায়গা রাস্তার মাঝখানে রেখে দুই পাশের সীমানা ঘেঁষে সড়ক তৈরি করা ফলপ্রসূ। সে ক্ষেত্রে ভেতরের অব্যবহৃত জায়গা প্রশস্ত সড়ক বিভাজক হিসেবে কাজ করায় মুখোমুখি দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে দেয় এবং প্রাকৃতিক ড্রেনেজ হিসেবে কাজ করার কারণে সড়কের ওপর পানি জমাট বেঁধে সড়কের কাঠামোগত ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও থাকে না।
রাস্তার পাশাপাশি সম্ভাবনাময় রেল ও নৌপথকেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সব যাতায়াতব্যবস্থাকে একটি একক জাতীয় মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এখানে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় একটা বড় বিষয়। সমন্বয়ের বিষয়টি জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। আমাদের সড়ক-মহাসড়ক বিভাগ সড়ক তৈরি করছে যানবাহনের গতি বাড়ানোর জন্য। সেখানে ভারী যানবাহন চলবে। আবার শিল্প মন্ত্রণালয় মোটরসাইকেল দিয়ে শিল্প বিকাশের কথা বলছে, যেখানে দুর্ঘটনার দায় কেউ নিতে চাইছে না। যদি সামষ্টিকভাবে চিন্তা করি, তাহলে কিন্তু মহাসড়কে উচ্চগতির মোটরসাইকেল চালাতে আমরা প্রস্তুত নই। উচ্চগতির মোটরসাইকেলগুলো কারা চালাবেন, কোথায় চলবে, এই নীতি ও পরিকল্পনায় যে দুর্বলতা রয়েছে, সেটাই আমাদের দুর্ঘটনার নাজুক পরিসংখ্যানের কারণ। তাই বিভিন্ন সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় খুবই জরুরি।
প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট সংস্থা করলেও দেশের যোগাযোগব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নৌপথ, স্থলপথ ও রেলপথ নিয়ে একটি সমন্বিত পরিবহন মাস্টারপ্ল্যান এখন সময়ের দাবি। আবার এই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। ঢাকা শহরের মানুষের কাছে মেট্রোরেলই প্রথম সত্যিকারের গণপরিবহন। সমন্বিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ব্যবস্থা না থাকায় আশপাশের যেকোনো দেশের মেট্রোরেলের তুলনায় আমাদের দেশের মেট্রোরেলের ভাড়া তুলনামূলক বেশি এবং গণপরিবহন নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনায় ত্রুটি বিদ্যমান। রেলভিত্তিক মেট্রোরেলকে কেবল সময়সাশ্রয়ী গণপরিবহনব্যবস্থা হিসেবে নয়, তার সঙ্গে অন্য সড়কভিত্তিক গণপরিবহনের মেলবন্ধন প্রয়োজন। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি মেট্রোলাইন করার পাশাপাশি ভালো মানের ফিডার কানেকটিভিটি করতে পারলে নেটওয়ার্ক থেকে যানজট নিরসনে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে। অন্যদিকে ক্রমাগত রেল দুর্ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে রেলকে অবহেলা করার ফসল। দক্ষ জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকটের পাশাপাশি সিগন্যালিং সিস্টেমের অসামঞ্জস্য অবস্থা মূলত এর জন্য দায়ী। রেললাইন বাড়ালেও অনেক ট্রেনের ইঞ্জিন-বগি এখনো পুরোনো। বেশ কিছু লোকোমোটিভ আছে, যেগুলোর আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে। রেল নেটওয়ার্কের একেক জায়গায় একেক রকম সিগন্যালিং সিস্টেম বিদ্যমান। কোথাও কম্পিউটারভিত্তিক ইন্টারলকিং সিস্টেম, কোথাও ম্যানুয়াল ইন্টারলকিং সিস্টেম এবং কোথাও ব্রিটিশ আমলের ইন্টারলকিং সিস্টেম কার্যকর। এগুলো রেলওয়ে পরিচালনাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। এ কারণে কখনো কখনো দুই ট্রেন একই লাইনে এসে পড়েছে।
নৌপথে চলাচলকৃত অনেক লঞ্চ বা ফেরির নেই কোনো ফিটনেস। একদিকে নৌপথগুলোয় নেই পর্যাপ্ত নাব্যতা, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণহীন বালু উত্তোলনের অসাধু প্রতিযোগিতা, তার সঙ্গে আছে অপরিকল্পিত ড্রেজিং সমস্যা। শক্ত তদারকির অভাবে প্রায়ই সম্মুখীন হতে হচ্ছে অনাকঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার। তাই সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থার পাশাপাশি রেল ও নৌপরিবহন পরিচালনা ব্যবস্থাপনায়ও প্রয়োজন ব্যাপক সংস্কার।
টেকসই যোগযোগব্যবস্থা ও স্বল্প ব্যয়ে রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে প্রয়োজন প্রচুর গবেষণার। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীন সড়ক গবেষণা ল্যাবরেটরি থাকলেও সেখানে রয়েছে নিয়মিত ও যোগ্য গবেষকের অভাব। তাই টেকসই সড়ক অবকাঠামোর জন্য সক্ষম গবেষক নিয়োগ ও নিয়মিত গবেষণার লক্ষ্যে সব প্রকল্প থেকে ১–২ শতাংশ অর্থ অন্যান্য উন্নত দেশের মতো এ খাতে বরাদ্দ রাখতে হবে। অন্যদিকে রেলে অভিন্ন ও আধুনিক সিগন্যাল সিস্টেম চালুর পাশাপাশি রেল পরিচালনায় দক্ষতা বাড়ানোর জন্য রেল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দক্ষ ও স্মাট জনবল তৈরি ও রেলের অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে গবেষণা সচল রাখতে হবে।
নগরকেন্দ্রিক মেট্রোরেলের মতো ভারী ও ব্যয়বহুল অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি স্বল্প ব্যয়ে ও সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য রেলভিত্তিক অন্যান্য গণপরিবহন, যেমন মনোরেল ও লাইট রেল ট্রানজিট–ব্যবস্থা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।
* মো. হাদিউজ্জামান : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক