রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা

সুফিয়া কামাল: অবরোধবাসিনী থেকে আলোকবর্তিকা

জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।

সুফিয়া কামাল (২০ জুন ১৯১১—২০ নভেম্বর ১৯৯৯)
সুফিয়া কামাল 
(২০ জুন ১৯১১—২০ নভেম্বর ১৯৯৯)

সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) অধ্যয়ন করলে শত বছরের নারী আন্দোলনের ইতিহাস উন্মোচিত হয়। নারীর অধিকার অর্জনের আন্দোলন সামগ্রিকভাবে পরিচালিত হয় পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের নানাবিধ বৈষম্য-অসাম্যের বিরুদ্ধে। তুলনামূলকভাবে নারীর ওপর এই বৈষম্য-অসাম্য চলে আসছে বেশি হারে। যুগ যুগ ধরে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় নারীকে অধস্তন করে রাখা হয়েছে, ইতিহাসে নারীর অবদান উপেক্ষিত হয়েছে, নারীর মানবাধিকার স্বীকৃতি পায়নি।

নারী সংগঠন, আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে, নেতৃত্ব দিয়ে ৭২ বছর সুফিয়া কামাল উল্লিখিত দর্শন-চেতনা ও আদর্শ বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করেছেন। অবরোধবাসিনী থেকে নারীর আলোকবর্তিকা হয়েছেন তিনি। নিজের লেখালেখি দিয়েও হয়েছেন নারীদের প্রেরণাস্থল। নারীসমাজকে লেখালেখিতে উৎসাহিত করার মাধ্যমে নারীর লেখালেখির পরিসর তৈরিতেও এই মহীয়সীর রয়েছে বিস্তর অবদান।

সংস্কৃতির অধিকারচর্চার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পতাকা হাতে ব্রিটিশ যুগে—পশ্চিম ও পূর্ব বাংলায়—পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশে কত পথ তিনি হেঁটেছেন, লিখেছেন গল্প ও কবিতা, দিয়েছেন শতসহস্র ভাষণ। অনেক শিশু, নারী, তরুণ-তরুণীর খাতায় দিয়েছেন স্বাক্ষর-শুভাশিস। সেসব স্বাক্ষরের ধারাক্রমে সুফিয়া খাতুন, সুফিয়া এন হোসেন, সুফিয়া কামালের সূচনা ঘটেছে। সব মিলিয়েই জীবনের নানা উত্থান-ঘটনা-দুর্ঘটনা-শোক-আনন্দের ধারায় ‘কবি সুফিয়া’ নিজের স্থায়ী পরিচয়ে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন।

সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে শহীদ মিনার থেকে নারীদের মিছিল

বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের অবরোধবাসিনী হয়েও তিনি দেশের ও পরিবারের স্বদেশি পরিমণ্ডলের অনুপ্রেরণায় প্রভাবিত হয়েছেন, সে সময়ের নারী আন্দোলনের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সাপ্তাহিক বেগম প্রকাশ করেন সুফিয়া কামালকে প্রধান সম্পাদিকা ও নূরজাহান বেগমকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকার দায়িত্ব দিয়ে। সে বছরেরই আগস্ট মাসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত স্বাধীন দেশ পাওয়ার আনন্দ পরিণত হলো নিরানন্দে। দেশ ভাগ হয়ে গেল হিন্দু-মুসলিম ধর্ম ভিত্তিতে। কলকাতার কর্মস্থল, নারী আন্দোলনের কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে সুফিয়া কামালকে ঢাকায় চলে আসতে হলো সপরিবার।

তারপর ঢাকায় স্থায়ীভাবে বাস করতে এসে তিনি একেবারেই নতুন রাজনৈতিক ও বিপ্লবী ধারার নারী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল-ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী বিপ্লবী ধারার নারীনেত্রী ও সংগঠকেরা তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের নারী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আকুল আহ্বান জানাতে থাকেন।

পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দমননীতির প্রতিবাদে জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো গুটিকয় নারীনেত্রীর মধ্যে সুফিয়া কামাল ছিলেন সর্বজন-সমর্থিত। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের শ্রেণি-শোষণহীন সমাজব্যবস্থার প্রতি কুণ্ঠাহীন একাত্মতাবোধ তাঁকে দ্ব্যর্থহীনভাবে যুক্ত করেছে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের উদ্যোগে পরিচালিত মহিলা সমিতির সভানেত্রীর দায়িত্ব পালনে। নিবেদিতা নাগ, যুঁইফুল রায় ও অন্যান্য কমিউনিস্ট নারীর আহ্বানে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’র সভানেত্রী হন ১৯৪৮ সালে।

১৯৫৪ সালে লীলা নাগের প্রচেষ্টায় সুফিয়া কামালকে সভানেত্রী ও লায়লা সামাদকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়ারী মহিলা সমিতি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে জাতীয় সব সংকটে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক বিবেকের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন সুফিয়া কামাল। সামরিক শাসনের গণবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে, রবীন্দ্রশতবর্ষ উদ্‌যাপনের দাবিতে, দাঙ্গা প্রতিরোধে সুফিয়া কামাল একাধারে ছায়ানট, কচি-কাঁচার মেলা, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংসদ প্রতিষ্ঠা ও নারী আন্দোলনের মহিলা সংগ্রাম পরিষদ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।

জাতীয় স্বাধিকার আন্দোলনের মূলধারায় নারী আন্দোলনের সম্পৃক্ততার বিষয়েও নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জরুরি আইন প্রত্যাহার, দমননীতি বন্ধ, রাজবন্দীর মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে দেশব্যাপী চলতে থাকা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি নারীসমাজের বৃহত্তর আন্দোলন অব্যাহত ধারায় সক্রিয় ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকাসহ সব জেলা শহরে নারীসমাজ সভা-সমিতিতে সংগঠিত হয়ে, মিছিল-স্লোগানে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সোচ্চার হয়ে আন্দোলন সংঘটিত করতে থাকে।

১৯৬৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নারীসমাজের বিরাট মিছিল ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে ছাত্রনেতা আসাদ হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই নারী আন্দোলন দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কার্যকর প্রভাব রেখেছিল। এ সময়ের নারী আন্দোলন রাজনৈতিক গণতন্ত্রের দাবিতে, স্বাধীনতার দাবিতে যেমন সোচ্চার ছিল, তেমনি নারী স্বাধীনতা ও নারী অধিকার অর্জনে ছিল বদ্ধপরিকর।

‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে সুফিয়া কামাল সারা দেশে সর্বস্তরের নারীসমাজকে মানবতার মুক্তিতে একযোগে জাতি গঠনের কাজে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান। বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ছাত্রসংগঠনের সচেতন নারীরা তাঁর নেতৃত্বে সম্মিলিতভাবে ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল গঠন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’। স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্বে এই সংগঠনের কার্যক্রম ছিল উল্লেখ করার মতো।

বাংলাদেশের সমাজে নারীর বিরুদ্ধে রক্ষণশীলতা, যৌতুক, নির্যাতন, বহুবিবাহ, যথেচ্ছ তালাক, ফতোয়া, নির্যাতন, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, পারিবারিক নির্যাতনের নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও অন্যান্য নারী সংগঠন সম্মিলিতভাবে এসব সামাজিক-পারিবারিক-রাজনৈতিক-আইনি শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য ও নির্যাতন থেকে নারীসমাজের মুক্তির আন্দোলন করতে থাকে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে।

বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদের জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ নির্বাচনে নারীসমাজকে সক্রিয় হওয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সুফিয়া কামাল। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার যখন নারীর সম-অধিকার আন্দোলনের দাবি উপেক্ষা করতে থাকে, তখনো নারী আন্দোলনের সোচ্চার মিছিলে সুফিয়া কামাল অতন্দ্রপ্রহরীর মতো নেতৃত্ব দিয়েছেন।

১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ইহজীবন অবসানের আগপর্যন্ত সচেতনভাবে নারীর মানবাধিকার অর্জনের দাবি জানিয়ে নারী আন্দোলনকে আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-বৈষম্য-অসাম্য-নির্যাতনের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে সোচ্চার থাকা এবং অসহায়, দরিদ্র, নির্যাতিত নারীর শিক্ষা-কর্মসংস্থান-ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করার পথনির্দেশ দিয়ে গেছেন তিনি।

আগেই বলা হয়েছে, সুফিয়া কামাল যে শুধু নারী আন্দোলনে রাজপথেই সক্রিয় ছিলেন, এমন নয়, বরং কলম হাতেও ছিলেন সমান সক্রিয়। মুসলমান পরিবারের মেয়েসন্তান হিসেবে যখন তিনি লেখালেখি শুরু করেছেন, গত শতকের সেই বিশ দশকের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েদের জন্য লেখালেখি করা তখন সহজ ছিল না, সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তিনি অবরোধ ভেঙেছিলেন।

আমরা তাঁকে ডাকতাম খালাম্মা বলে। সুফিয়া খালাম্মা রান্না করছেন এক হাতে খুন্তি নেড়ে; অন্য হাতে কলম ধরেছেন, কবিতা লিখছেন—সেসব নিত্যদিনের দৃশ্য কি ভোলা যায়? রান্নাঘরে ফেলে রাখা কবিতার কাগজগুলো তাঁর জীবনসঙ্গী কামাল উদ্দীন খান সাহেব সযত্নে তুলে এনে টেবিলে বসেছেন। তখন ফটোকপির যুগ তো ছিল না। তাই নিজ হাতে কপি করে ফাইলে রেখেছেন। সেসব স্মৃতিও ভোলা যাবে না।

সুফিয়া কামালের লেখালেখির দিকে তাকালে দেখা যাবে, নারী অধিকার তথা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যে আজীবন লড়াই করেছেন, তাঁর লেখালেখিতেও এর প্রভাব স্পষ্ট। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা তাঁর ‘আপন ভাষা’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত করি, ‘বাংলাদেশের গানে গানে/ রইল বেঁচে তারা।/ তাদের তরে কান্নাত নয়/ কণ্ঠে জাগাও সুর,/ শহীদ বীরের বন্দনাতে/ পরাণ ভরপুর।’

এই কবিতায় ভাষাশহীদদের স্মরণ করে মানুষের অধিকারের সপক্ষেই ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কণ্ঠ। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সব প্রগতিশীল লড়াই-সংগ্রামে তাঁর কবিতা আমাদের প্রেরণা ও পাথেয় হয়ে আছে। ১৯৬৯ সালে ‘ঊনসত্তরের এই দিনে’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘মুক্তিকামী সংগ্রামী যাহারা।/ তাহাদের সাথে রব চিরদিন।’

সুফিয়া কামালের জীবনকর্ম ও লেখালেখি শুধু নারী নয়, মুক্তিগামী মানুষের পাশে দিশা হয়ে আছে সব সময়।

মালেকা বেগম: সুফিয়া কামালের জীবনীলেখক; অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা