উন্নতির শিখরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প

মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্পদে অপ্রতুল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে। কিন্তু নিন্দুকদের আশঙ্কা অসত্য প্রমাণ করে একের পর এক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এই এগিয়ে যাওয়ার পথ রচিত হয়েছিল কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা, অভিনব ভাবনা, ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগে। আমরা ফিরে দেখছি বাংলাদেশের উজ্জ্বল সেসব মুহূর্ত।

সাহিদুর রহমান

অকল্পনীয় সব বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে। দেশের এই রূপান্তর ও উন্নতির পেছনে অন্যতম প্রধান অবদান আছে তৈরি পোশাকশিল্পের। আশির দশকের শুরুতেও তৈরি পোশাকশিল্প ছিল এক মিলিয়ন ডলারের কম মূল্যমানের শিল্প, এখন যার মূল্যমান প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার। একসময়ের দরিদ্র্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপীড়িত হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ, বৈশ্বিক বাজারে যার শেয়ার ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ।

শুরুর দিকে তৈরি পোশাকশিল্পের প্রসারের পেছনে মাল্টিফাইবার অ্যাগ্রিমেন্ট নামে একটি বিশ্ব বাণিজ্য চুক্তি অন্যতম ভূমিকা পালন করে, যা বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যকে কোটামুক্ত করে। পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত শুল্কমুক্ত পলিসির কারণে একটি উল্লেখযোগ্য রপ্তানি আয় অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

তবে বাংলাদেশের তৎকালীন অভ্যন্তরীণ নীতির পরিবর্তন ছাড়া এসব বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতির সুবিধা লাভ করা সম্ভব হতো না। সরকার অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য প্রচুর উদারীকরণ এবং সংস্কার নীতি গ্রহণ করেছিল। এসব নীতির মধ্যে একটি ছিল ব্যাক টু ব্যাক লেটার অব ক্রেডিট (এলসি), যা আন্তর্জাতিক কাঁচামাল সরবরাহকারীদের ব্যাংকের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের নিশ্চয়তা দিত। বন্ডেড ওয়্যারহাউসের সুবিধার কারণে তৈরি পোশাক–সম্পর্কিত আনুষঙ্গিক দ্রব্য শুল্কমুক্ত হিসেবে আমদানি করা যায়। এসব নীতি প্রবর্তনের আগে তৈরি পোশাক–সম্পর্কিত দ্রব্যের আমদানি শুল্ক অনেক বেশি ছিল, যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিত। আমদানি নীতি উৎপাদনের খরচ অনেক কমিয়ে দিয়ে তৈরি পোশাকের ভোক্তাদের প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য সরবরাহ করার সুযোগ করে দিয়েছে। এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিয়েছে, যা তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশে রেখেছে বিশেষ ভূমিকা। সহজলভ্য ব্যাংকিং সেবা ও স্বল্প সুদে ঋণের কারণে বৈশ্বিক বাজারে তুলনামূলক ব্যবসায়িক সুবিধাও পেয়েছে। নিটওয়্যারের কাঁচামাল এখন দেশেই উৎপাদিত হয়। তাই এর রপ্তানিও অধিক হারে হচ্ছে। রপ্তানিভিত্তিক নীতিগুলোর কারণে তৈরি পোশাকশিল্প কারখানা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর বড় অবদান আছে। এ দেশের জিডিপিতে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ৮০ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় আসে এই খাত থেকে। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তর ও উন্নতির পেছনে অন্যতম অবদান তৈরি পোশাকশিল্পের

পোশাকশিল্পে সবচেয়ে বড় অবদান লক্ষ করা যায় নারীসমাজের ওপর, যা নীরব বিপ্লব নামে পরিচিত। তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশের ফলে বাংলাদেশে ঘরের বাইরে নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এবং এর মাধ্যমে এসেছে একটি সামাজিক পরিবর্তন। ফলে নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বেড়েছে। বর্তমানে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের একটি সাধারণ দৃশ্য হলো হাজার হাজার নারী পোশাক কারখানায় যাচ্ছেন, যা তিন দশক আগেও কল্পনা করা যেত না। অর্থাৎ তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশ বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিয়েছে।

এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উন্নতির পেছনে আছে অনেক ত্যাগ। এই খাত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছে। ১৯৯০–এর দশকের মাঝামাঝি শিশুশ্রমের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। সরকার এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরা এগিয়ে আসেন, তারা শিশুশ্রম বন্ধ করেন। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা কর্মপরিবেশ উন্নতির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ড অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করে এবং নিয়মিত অডিটের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করে। বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ সালে কার্যকর হয়। একই সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের ৩৬টি কনভেনশন অনুমোদন করা হয়, যার মধ্যে ৮টি মৌলিক। এসব পরিবর্তন করার পরও শ্রম আইন ২০০৬ প্রবর্তনের আগপর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে শ্রমিকদের মজুরির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ২০০৬ সালে এই খাতে শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ছিল ১ হাজার ৬৬২ টাকা। ট্রেড ইউনিয়নের চাপ সৃষ্টির ফলে ২০১৮ সালে তা দাঁড়ায় ৮ হাজার টাকায়। 

তৈরি পোশাকশিল্পের সাফল্যের গল্প ধূলিসাৎ হয়ে যায় ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশে বিশ্বের নিকৃষ্টতম শিল্প দুর্ঘটনা ঘটার পর। সেদিন ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা। ১ হাজার ১৩৪ জন শ্রমিক নিহত হন এবং আহত হন আরও অনেকে। এ দুর্ঘটনা পুরো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ সরকার, পোশাকমালিক এবং ক্রেতারা গভীর সমালোচনার মুখে পড়েন। প্রথমে বাংলাদেশকে বর্জন করার কথা উঠলেও তৎকালীন সরকার অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত ট্রান্সন্যাশনাল গভর্ন্যান্স গঠন করে এবং এদের স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দেয়। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স তার সদস্য কারখানাগুলো পরিদর্শন করে এর অবকাঠামো, অগ্নিনির্বাপণ ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে সরকার একই রকম কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে অন্যান্য কারখানায়। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কার্যক্রমের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এদের স্থলাভিষিক্ত হয় বিজিএমইএ প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমিতির প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত ‘আরএমজি সাসটেইনিবিলিটি কাউন্সিল’। এর পাশাপাশি অন্য উল্লেখযোগ্য সংস্কারগুলো হলো বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ সংশোধন, পেশাগত ও স্বার্থ নিরাপত্তা নীতি ২০১৩ এবং শ্রমিকনীতি ২০১৫। এর সঙ্গে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ক্ষমতাও বাড়ানো হয়।

যে মুহূর্তে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্প আবার আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় এবং উচ্চ হারে উন্নতি করতে শুরু করে, ঠিক সে মুহূর্তে করোনা মহামারি এই শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ২০১৯ সালের মে মাসের প্রথম ২৯ দিনের তুলনায় ২০২০ সালের মে মাসের প্রথম ২৯ দিনে ৬২ শতাংশ কমে যায়। করোনাকালের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাবের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য ৫৯০ মিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা ঘোষণা করে। এই প্রণোদনার মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিকদের বেতন–ভাতা প্রদান করা। আশার কথা হলো, মহামারির দুই বছর পর আবারও তৈরি পোশাকশিল্প কারখানাগুলো কর্মমুখর হয়ে ওঠে।

বর্তমানে রপ্তানিভিত্তিক বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্পের সমস্যা হলো স্থায়িত্ব। অতীতে বিভিন্ন সময়ে এই শিল্প স্থায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে না। তবে জিএসপি প্লাস নামে অন্য একটি বিশেষায়িত বাণিজ্য সুবিধার জন্য আবেদন করতে পারবে, যা ভঙ্গুর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তৈরি করা হয়েছে। ২০২৪ থেকে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হলে ‘হিউম্যান রাইটস ডিউ ডিলিজেন্স’ বিবেচনায় আনা বাধ্যতামূলক। এর জন্য প্রস্তুতির পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় পণ্য এবং বাজারে বহুমুখী তুলনামূলক সুবিধা অর্জন করা দরকার, যার জন্য শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোতে মনোযোগ দিতে হবে।

আমরা আশাবাদী। এই শিল্প বাংলাদেশের স্বপ্ন ও গর্ব। কারণ, বিশ্বের সর্বোচ্চসংখ্যক পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা এখন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তহবিল গঠন এর একটি। প্রধান ক্রেতাদের সহযোগিতায় কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ক্রেতারা ক্রমাগতভাবে আগের তুলনায় কম মূল্য প্রস্তাব করছে, যা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক দিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্য দিকে ক্রেতারা কম মূল্য দিচ্ছে। ফলে স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। অতএব এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত সব মহলের দায়িত্বশীল হতে হবে। তবে এ প্রক্রিয়ায় শ্রমিকের কল্যাণকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে সব সময়। 


সাহিদুর রহমান: অধ্যাপক, সমাজবিদ্যা, অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়