আপনি কেমন স্বাস্থ্য চান? উত্তরটা অতি সহজ আর প্রত্যাশিত—সুস্বাস্থ্য। আমরা সবাই চাই সুস্বাস্থ্য। কিন্তু প্রশ্নটায় যদি একটা শব্দ যোগ করি, আপনি কেমন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চান? বোধ করি এই প্রশ্নের উত্তর আর সহজ ঠেকছে না। আমরা এমন এক স্বাস্থ্যব্যবস্থা চাই, যা প্রত্যেক মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে ও জীবনের যথাযথ মর্যাদা দেয়। আমরা এমন এক স্বাস্থ্যব্যবস্থা চাই, যেখানে মানুষের আর্থিক অবস্থা, সামাজিক পরিচয় বা তাঁর ভৌগোলিক অবস্থান স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আমরা এমন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চাই, যা শুধু চিকিৎসার ওপরে নয়, বরং সুস্থ থাকার ওপর গুরুত্ব দেয়।
১৯৪৯ সালে একটি জার্নাল প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন, ‘হেলথ ইজ এভরিবডিস বিজনেস’ অর্থাৎ একটি প্রতিষ্ঠান যদি তার কর্মীদের সুস্বাস্থ্যের পেছনে ব্যয় করে, কর্মীরা তা কাজের মাধ্যমে ফেরত দেবেন।
সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার সেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমরা কীভাবে অর্জন করব? এ প্রশ্নের উত্তরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা সাম্প্রতিক স্লোগান আমার কাছে বেশ জুতসই মনে হয়েছে, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য আর স্বাস্থ্যের জন্য সবাই।’ স্লোগানটির প্রথম অংশ স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাছে আমাদের প্রত্যাশা তুলে ধরে। তবে এই স্লোগানের আসল শক্তি লুকিয়ে আছে দ্বিতীয় অংশে—স্বাস্থ্যের জন্য সবাই। সবার জন্য স্বাস্থ্য আমরা তখনই নিশ্চিত করতে পারব, যখন সরকার ও সমাজের সর্বস্তরের সবাই স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেবে—রাজনৈতিক অবস্থান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং জনগণ ব্যক্তিগতভাবে এর মানোন্নয়নে অংশ নেবে। এই স্লোগানটি তাই কেবল একটি প্রতিশ্রুতি নয়; এটি একটি আহ্বানও বটে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই স্লোগানের মাহাত্ম্য আরও গভীর। স্বাস্থ্য খাতকে আমরা প্রাধান্য দিই না, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিই না। এর প্রমাণ, স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অপ্রতুল বরাদ্দ। জনপ্রতি মোট দেশজ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৫২তম দেশ। অথচ স্বাস্থ্যের জন্য জনপ্রতি খরচের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ১৬৫তম। স্বাস্থ্যের জন্য এ খরচের বেশির ভাগটা আবার জনগণকে জোগাড় করতে হয় নিজেদের পকেট থেকে। এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও পেছনে, বিশ্বে ১৮২তম। যদি আসলেই আমরা স্বাস্থ্য খাতকে প্রাধান্য দিতাম, তাহলে স্বাস্থ্যের জন্য জনপ্রতি খরচের দিক থেকে বিশ্বে আমাদের অবস্থান আর যা–ই হোক জিডিপিতে অবস্থানের চেয়ে পেছনে থাকত না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান বলেছিলেন, ‘একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সরাসরি তার নাগরিকদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে; ঠিক তেমনি একটি দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য সরাসরি তার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।’ স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে, প্রগতির পালে হাওয়া তোলে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্য খাতে প্রতি এক ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে একটি দেশের ২৮০ ডলার মুনাফা হয়। বাংলাদেশের মতো একটা উদীয়মান অর্থনীতির দেশে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ তাই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং জরুরি। প্রশ্ন হলো যখন প্রমাণগুলো এতই সুস্পষ্ট এবং এগিয়ে আসার আহ্বান এতটা শক্তিশালী, তখন কেন আমরা স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিতে এতটা অনীহা বোধ করি? কেন স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে আমরা সবাই এগিয়ে আসি না?
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আমাদের আলোচনা আর স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আমাদের পর্যালোচনা সব সময় একটা গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। বাড়ির কাছে হাসপাতাল নেই, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি নষ্ট, ওষুধস্বল্পতা, চিকিৎসক হাসপাতালে ঠিকমতো আসেন না, সময় দিয়ে কথা বলেন না, নার্সের সেবার মান ভালো না, চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি—স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আমাদের অভিযোগগুলো ঘুরেফিরে একই। এর প্রতিটি অভিযোগের মধ্যে হয়তো সত্যতা আছে। কিন্তু এর কোনোটাই আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার করুণ দশার মূল কারণ নয়। তাই এসব সমস্যা সমাধান করে হয়তো স্বল্পকালীন কিছু উপকার হবে, কিছু স্থানের স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়বে, কিন্তু তাতে গোড়ার গলদটা ঠিক হবে না, স্বাস্থ্য খাতের অগ্রাধিকার প্রশ্নের সমাধান হবে না। স্বাস্থ্য খাত তখনই তার প্রাপ্য পাবে, যখন স্বাস্থ্য আমাদের জাতীয় এবং স্থানীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা তখনই মাথা তুলে দাঁড়াবে, যখন সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান, সব স্তরের জনগণ স্বাস্থ্য উন্নয়নে এগিয়ে আসবে, অংশগ্রহণ করবে।
স্বাস্থ্য নিয়ে রাজনীতি এবং স্বাস্থ্যের জন্য রাজনীতি এক নয়। স্বাস্থ্য নিয়ে রাজনীতি ব্যক্তিগত স্বার্থে পরিচালিত হয়, যেখানে ব্যক্তিগত ক্ষমতা, প্রভাব ও অর্থনৈতিক লাভই মুখ্য। এটি জনগণের প্রকৃত স্বাস্থ্য চাহিদা এবং কল্যাণের ওপর প্রভাব ফেলে না। অন্যদিকে স্বাস্থ্যের জন্য রাজনীতি জনগণের ও সমাজের কল্যাণে পরিচালিত হয়। এটি স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যশিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করে। স্বাস্থ্যের জন্য রাজনীতি জনগণের প্রকৃত স্বাস্থ্য চাহিদা পূরণে এবং স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে সহায়ক হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য নিয়ে রাজনীতির কমতি নেই, কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য রাজনীতি কদাচিৎ দেখা যায়। কে কোথায় বদলি হবেন, কার কখন পদোন্নতি হবে, নীতিনির্ধারণী জায়গায় কারা বসবেন—বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত হয় ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে। সে আমাদের দলের লোক কি না—এটাই মুখ্য; ব্যক্তির মেধা, দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা এখানে গৌণ; জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজন এখানে অগ্রাহ্য। শুধু চিকিৎসক নন, প্রতিটি স্তরের স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের জন্য এটা সত্য। রাজনৈতিক পরিচয় যেখানে টিকে থাকার বা এগিয়ে যাওয়ার প্রধান হাতিয়ার, পেশাগত উৎকর্ষ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা সেখানে সর্বদাই উপেক্ষিত। এ কারণেই স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা আজ নিজেদের মধ্যে বিভক্ত, পেশাগত দায়িত্ব পালনে কুণ্ঠিত আর নীতি–নৈতিকতার প্রসঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ। স্বাস্থ্য নিয়ে রাজনীতির কুপ্রভাব স্বাস্থ্য খাতের সর্বস্তরে আজ স্পষ্ট। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন। রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় যদি স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো, স্বাস্থ্যের জন্য যদি জাতীয়, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বপ্ন ও অঙ্গীকারগুলো তুলে ধরতেন, তবে স্বাস্থ্য খাতের অগ্রাধিকার প্রশ্নের সমাধান অনেকটাই হয়ে যেত।
অথচ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বরাবরের মতো উপেক্ষিত থেকে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের জন্য একটা বড় সুবিধা হলো, জনগণ স্বাস্থ্যের মতো আপাতনিরীহ বিষয়কে ধর্তব্যের মধ্যে রাখে না। যদি রাখত, তবে তাদেরকে প্রশ্ন করত, ‘আপনি যদি নির্বাচিত হন, আপনি আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে কী করবেন? কীভাবে করবেন?’ রাজনীতিবিদদের জন্য সেটি হতো একটি লিটমাস পরীক্ষা। এ দেশে রাজনৈতিক নেতা–কর্মীরা শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নের অঙ্গীকারে সীমাবদ্ধ। জেলায় জেলায় হাসপাতাল তৈরির অঙ্গীকার আর বিনা মূল্যে চিকিৎসার স্বপ্ন দেখানো—এতটুকুতেই তাদের স্বপ্ন সীমাবদ্ধ। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন নির্বাচনে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী ম্যান্ডেটের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ ‘স্বাস্থ্য’। ওষুধের ‘আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার’ কমিয়ে গ্রাহকের খরচ সীমিত করা, নিম্ন আয়ের এবং লাখ লাখ স্বাস্থ্যবিমাহীন মানুষের জন্য গৃহীত ‘অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’, যা ‘ওবামাকেয়ার’ নামে বিখ্যাত, তা নিয়ে তর্ক হচ্ছে, কীভাবে স্বল্পমেয়াদি স্বাস্থ্যবিমা, স্বাস্থ্য সঞ্চয়ী হিসাবের মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যগত উন্নতি আনা যায়, কীভাবে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ আরও বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আর এসব আলোচনা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ভোটপ্রার্থীদের জনগণকে নিশ্চয়তা দিতে হচ্ছে যে তিনি নির্বাচিত হলে অবশ্যই এই অঙ্গীকার রক্ষা করবেন। কীভাবে, সেই রূপরেখাও জানাচ্ছেন।
২০১৬ সালের আলোচিত ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার বড় কারণ ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজেটে যে বিপুল অর্থ ব্রিটিশরা প্রদান করে, তা তাদের সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস তহবিলে দিতে বেশি ইচ্ছুক। যুক্তরাজ্যের ২০১৯ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টি তাদের ইশতেহারে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কতজন স্বাস্থ্যসেবাকর্মীর ঘাটতি আছে; দেশে ভর্তি রোগীর জন্য কতগুলো শয্যার ঘাটতি আছে; প্রতিবছর তাদের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য কত শতাংশ বরাদ্দ বাড়ানো হবে; বেসরকারীকরণের বিপরীতে কীভাবে তারা তাদের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবাকে আরও শক্তিশালী করবে, তার সূক্ষ্ম বর্ণনা; মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানোন্নয়নের জন্য কোন কোন স্তরে পরিবর্তন আনতে হবে এবং কোন স্তরে কত খরচ করা হবে—সব উল্লেখ করা আছে এই ইশতেহারে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে কিছুদিন আগে নির্বাচন হয়ে গেল। সে নির্বাচনে কংগ্রেসের ইতিহাসে স্বাস্থ্য নিয়ে প্রায় ২০টি অঙ্গীকার রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ৭৫ শতাংশ মেডিকেল, প্যারামেডিকেল ও শিক্ষকের পদ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো মেডিকেল কলেজ খোলার অনুমতি না দেওয়া, অপুষ্টির কারণে বয়স এবং ওজনের সঙ্গে উচ্চতার বৃদ্ধি যাতে রহিত না হয়, সে জন্য দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মিড-ডে মিল চালু করা, চিকিৎসক ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর কোনো রকম আঘাতের বিরুদ্ধে আইন করা ইত্যাদি। অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক দল, নেতারা যদি জনগণের কাছে স্বাস্থ্য নিয়ে দায়বদ্ধ থাকে, তবে আমাদের দেশে কেন নয়?
রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বেরিয়ে যদি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে আসি, এখানেও দেখা যায় বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জনস্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগের ঘাটতি প্রকট। ফেসবুক, গুগল কিংবা অ্যাপলের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য খাতে নতুনত্ব নিয়ে এসেছে। গুগলের ‘ভেরিলি’ স্বাস্থ্যবিমার জন্য বিশেষায়িত পণ্য নিয়ে এসেছে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ বাড়ানোর জন্য। ‘অ্যালায়েন্স ফর অ্যাডভান্সিং হেলথ অনলাইন’-এর মাধ্যমে ফেসবুক ভ্যাকসিন কাভারেজ বাড়ানোর কাজ করছে। ভারতে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিমা সেবা প্রদান করছে। অ্যামাজন টেলিহেলথের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার বাড়াচ্ছে। অ্যাপল স্বাস্থ্য ডেটা নিয়ে কাজ করছে এবং স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানিগুলোকে ওই স্বাস্থ্যবিমা পরিকল্পনায় সাহায্য করছে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এসব কোম্পানি জনস্বাস্থ্য নিয়ে এত সচেতন? এর সরল উত্তর হতে পারে ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’। স্বাস্থ্য হচ্ছে এমন একটি খাত, যেটি সব স্তরের, সব শ্রেণি–পেশার মানুষকে যুক্ত করে। মেয়হিউ ডেরিবেরিকে বলা হয় আমেরিকার স্বাস্থ্য শিক্ষার অগ্রদূত। ১৯৪৯ সালে একটি জার্নাল প্রতিবেদনে তিনি বলেছিলেন, ‘হেলথ ইজ এভরিবডি’স বিজনেস’ অর্থাৎ একটি প্রতিষ্ঠান যদি তার কর্মীদের সুস্বাস্থ্যের পেছনে ব্যয় করে, কর্মীরা তা কাজের মাধ্যমে ফেরত দেবেন। আমাদের দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ ধরনের উদ্যোগ শূন্যের কোঠায়। অথচ এ দেশেও যথেষ্ট বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শুধু ইচ্ছাশক্তির বিকাশ হলেই আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও এভাবে জনমানুষের স্বাস্থ্যগত উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব রাখতে পারবে আমরা বিশ্বাস করি।
রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণই কি শেষকথা? সবার জন্য স্বাস্থ্য আর স্বাস্থ্যের জন্য সবাই—এই উক্তির আলোকে ব্যক্তিপর্যায় থেকেও স্বাস্থ্যোন্নয়নে এগিয়ে আসা জরুরি। সেটি কীভাবে হতে পারে, সে উদাহরণও আমাদের সামনে আছে। বিল গেটস ও তাঁর সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ তাঁদের ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বৈশ্বিক টিকাদান প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করা, সংক্রামক রোগ মোকাবিলা এবং বিশেষ করে বৈশ্বিক পোলিও নির্মূল করতে বিলিয়ন ডলার উৎসর্গ করেছেন। বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের সিইও ওয়ারেন বাফেট এই ফাউন্ডেশনে তার সম্পদের একটি বড় অংশ দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মাইকেল ব্লুমবার্গ, ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রোপিজের মাধ্যমে সারা বিশ্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ, স্থূলতা প্রতিরোধ, অসংক্রামক রোগ ও সড়ক নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কাজে নিয়োজিত রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় সামাজিক ন্যায়ের গুরুত্ব, স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে পার্টনারস ইন হেলথের সহপ্রতিষ্ঠাতা, ড. পল ফার্মার তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার প্রচেষ্টার ফলে হাইতি, রুয়ান্ডা ও সিয়েরা লিওনের মতো দেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। এই শতাব্দীর শেষে যাতে সব রোগের নিরাময়, প্রতিরোধ এবং ব্যবস্থাপনার আবিষ্কার হতে পারে—এ উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে মার্ক জাকারবার্গ ও তাঁর স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান। রোগ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য গবেষণায় অর্থায়ন, বিজ্ঞানীদের ব্যবহারের জন্য নতুন সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি তৈরি করা এবং প্রত্যেকের জন্য স্বাস্থ্যসেবার সমান প্রবেশগম্যতার প্রচারসহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে মার্ক ও চ্যান মনোনিবেশ করেছেন।
এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে ব্যক্তিগত অবস্থান থেকেও জনগণের স্বাস্থ্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সম্ভব। তবে কেউ কেউ হয়তো এরই মধ্যে কিছুটা ভ্রু কুঞ্চিত করে ভাবছেন, তবে কি স্বাস্থ্যে ভূমিকা রাখার জন্য ধনকুবের হওয়া ছাড়া উপায় নেই? অবশ্যই আছে। আমাদের দেশের মতো পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনের তুলনায় স্বাস্থ্যকর্মীর অপ্রতুলতা রয়েছে। সেসব দেশে ছাত্র থেকে শুরু করে চাকরিজীবী—অনেকেই নিজেদের শুভ ইচ্ছা থেকে সপ্তাহে কিংবা মাসে কয়েকটা দিন তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে থাকেন। তরুণ-তরুণীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় তাদের এই স্বেচ্ছাসেবার কাজকে প্রাধান্য দিয়ে অগ্রাধিকার পান। চাকরিক্ষেত্রে জীবনবৃত্তান্তে এসব স্বেচ্ছাশ্রমকে প্রাধান্য দেয় তারা। কারণ, এই যে স্বেচ্ছায় মানুষের তরে কাজ করার মনোভাব জাগ্রত হওয়া, এটি একটি অভ্যাসের ব্যাপার, একজন সুনাগরিকের বৈশিষ্ট্য। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে টিকার প্রচারণায় আমরা এগিয়ে যেতে পারি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ, চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো এই ব্যাপারটিকে নজরে রাখতে পারেন। আদতে মঙ্গল হবে দেশের মানুষেরই।
স্বাস্থ্যসেবা শুধু চিকিৎসা নয়, জনগণের সুস্থ থাকাকে প্রাধান্য দেয়। যে মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে স্বাস্থ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠবে, দেশের মানুষের কাছে স্বাস্থ্য নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে উঠবে, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান ও দল-মত-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে জনগণ নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্বাস্থ্য উন্নয়নে সচেতন এবং মানবিক হয়ে উঠবে, নিজেদের মধ্যে থাকা হাজারো দ্বন্দ্বের থেকে স্বাস্থ্যের জন্য তর্কবিতর্ক প্রধান হয়ে উঠবে, তখন আমরা আমাদের স্বপ্নের স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব—যেটি প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠবে সবার জন্য স্বাস্থ্য আর স্বাস্থ্যের জন্য সবাই।
আহমদ এহসানুর রহমান: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষক; আইডিডিআরবির মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী