রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা

জাফরুল্লাহ চৌধুরী: স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে বাঁক ফেরানো মানুষ 

জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী (২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১—১১ এপ্রিল ২০২৩)
জাফরুল্লাহ চৌধুরী
(২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১—১১ এপ্রিল ২০২৩)

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সেই বিরলপ্রজ মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম, যিনি পেশাগত, রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক, সর্বোপরি ব্যক্তিজীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও দর্শনকে ধারণ করে গেছেন আজীবন। 

চট্টগ্রামের রাউজানে জন্ম নেওয়া জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন ১০ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। ঢাকা মেডিকেলে পড়ার সময় জাফরুল্লাহ ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন ঘরানার। পরে এফআরসিএস করতে চলে যান বিলেতে। কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে আগে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। হাইড পার্কে পাকিস্তানবিরোধী প্রতিবাদ সভায় ডাক্তার মবিনের সঙ্গে প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের সামনে পাকিস্তানি পাসপোর্ট পুড়িয়ে দিয়ে জানিয়ে দেন, নিজেদের তাঁরা আর পাকিস্তানি মনে করেন না।

এ সময়েই ব্রিটেনে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ ইউকে)’ তৈরি করেন তাঁরা। এটি ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের সপক্ষের প্রথম কোনো সংস্থা। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য প্রত্যেকে মাসে ১০ পাউন্ড করে চাঁদা দেবেন। ব্রিটেনে তখন চার শর মতো বাংলাদেশি ডাক্তার ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে মাসে চার হাজার পাউন্ড সাহায্য তোলার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। পরে মবিন ও জাফরুল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রাষ্ট্রহীন নাগরিকের সনদ বের করে লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাস থেকে দিল্লি যাওয়ার ভিসা নেন। দামেস্ক হয়ে দিল্লির টিকিট কাটেন। দামেস্কে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাঁদের আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এত সব ঘটনায় ভারতীয় কর্মকর্তারা তাঁদের দিল্লি থেকে যুক্তরাজ্যে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তবে ভারতীয় গোয়েন্দাদের চক্ষু এড়িয়ে তাঁরা চলে যান আগরতলা।

জাফরুল্লাহ জানতেন, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হলে অচিরেই ভেঙে পড়বে সৈনিকদের মনোবল। তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা ও অর্থায়ন নিশ্চিত করেন। বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালের জন্য পাঁচ হাজার রুপির প্রাক্কলন নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ। তবে অনুমোদন হয়েছিল ৫০ হাজার রুপি, যার নেপথ্য কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ; এবং তারও নেপথ্যে ছিল বিএমএ ইউকের অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি। 

বাংলাদেশ হাসপাতালে চিকিৎসার পেছনে খুব একটা বেশি সময় দিতে পারতেন না জাফরুল্লাহ। তাঁকে হাসপাতালটির জনবল, অর্থায়ন, সরঞ্জামের সরবরাহবিষয়ক কাজই করতে হয়েছে বেশি। এ সময় বাংলাদেশ হাসপাতালে নার্স ছিল না। সুলতানা কামালসহ ঢাকা থেকে আসা একঝাঁক তরুণীকে অল্প কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে নার্স হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে সেই সমস্যারও সমাধান করা হয়। আর এর মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্য খাতে শুরু হয় নারীর ক্ষমতায়ন।

স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে জাফরুল্লাহ যখন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র শুরু করেন, সে সময়ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন তিনি, ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মদক্ষতা আর অভিজ্ঞতাই ছিল এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যের মূল শক্তি।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্নেল ওসমানী ও তাজউদ্দীনের পরামর্শে দুবার বিলেত এবং একবার ঢাকায়ও যান জাফরুল্লাহ। তার মধ্যে জুলাইয়ের ঢাকা সফর ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। যুক্তরাজ্যে তাঁর সফরের মূল কারণ ছিল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির (আইআরএ) সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। আইআরএ অস্ত্র দিতে পারেনি, তবে প্রতিশ্রুতি দেয় মুক্তিযুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে তারা স্থানীয় রসদ নিয়ে কী করে যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করতে হয়, সে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেবে। দুবারই ব্রিটেন থেকে বিএমএইউকের সহায়তায় বাংলাদেশ হাসপাতালের জন্য দরকারি মেডিকেল যন্ত্রপাতির সঙ্গে ওয়াকিটকি, ডুবুরিদের ব্যবহার্য যন্ত্রপাতিসহ যুদ্ধের নানা যন্ত্রপাতি পাঠিয়েছে তারা। বাংলাদেশ হাসপাতালের আর সবাই বেতন নিলেও ডাক্তার মবিন ও জাফরুল্লাহ নিতেন না।

বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর অসমাপ্ত এফআরসিএস করার জন্য বিলেতে আর ফিরে যাননি জাফরুল্লাহ। তিনি তখন নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর। গণস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠায় তাঁকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব; এগিয়ে আসছেন বন্ধু ডা. মাহমুদুর রহমানের মা, কর্নেল এম এম হক এবং আরও অনেক তরুণ। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ হাসপাতালের অভিজ্ঞতায় গড়ে তুলেছেন প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার নারী কর্মী বাহিনী, কর্মএলাকার গ্রামের তরুণীরা যার সদস্য। গড়ে তুলেছেন হাসপাতাল; মানুষের জন্য চালু করেছেন স্বাস্থ্যবিমা, যার প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয় আর্থিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। গণস্বাস্থ্যই প্রথম প্রতিষ্ঠান, যারা এ দেশে স্বাস্থ্যবিমা চালু করে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যবিমার উল্লেখ আছে, কিন্তু সেটা প্রথম করে দেখিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ।

সাশ্রয়ী সেবামূল্য ও বিমার জন্য খ্যাতি পেয়েছে তাঁর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। সাম্প্রতিক অতীতে এখানেই গড়ে উঠেছে ডায়ালাইসিস করার বিশাল ইউনিট। আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী এর সেবামূল্য তিন শ থেকে তিন হাজার টাকা; দিনে তিন শ কিডনি রোগীকে সেবা দেওয়ার সামর্থ্য ও উদাহরণ পৃথিবীর আর কোনো হাসপাতালে আছে বলে আমাদের জানা নেই। গণবিশ্ববিদ্যালয় ও গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের এক সেমিস্টার গ্রামে থাকা, গ্রামে গিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নেওয়া বাধ্যতামূলক। তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কীভাবে আনতে হবে, তা তিনি করে দেখাতেন।

বাংলাদেশের ওষুধশিল্প গড়ে ওঠার পেছনেও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান সবচেয়ে বেশি। ১৯৮২ সালে যখন ওষুধনীতি প্রণীত হয়, তখন বাংলাদেশের ওষুধের বাজারের ৭০ শতাংশই ছিল ৮টি বহুজাতিক কোম্পানির দখলে, অপ্রয়োজনীয় ওষুধে বাজার ছিল পরিপূর্ণ। আর ৮৫ শতাংশ ওষুধই আমদানি করতে হতো। ওষুধনীতির কারণে সব অপ্রয়োজনীয় ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়; আর দেশি কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করা হয় উৎপাদনের জন্য, নানা প্রকার নীতিসহায়তা দিয়ে। ওষুধশিল্প মালিক, ডাক্তারদের সংগঠন এবং অনেক ডাক্তার তখন এই নীতির বিরোধিতা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও নীতিটির কারণে আশির দশক থেকে ওষুধ নিয়ে স্বস্তিতে আছে বাংলাদেশ। দেড় শতাধিক দেশে আজ ওষুধ রপ্তানি করে বাংলাদেশ; ওষুধশিল্প আজ প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার (সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার) শিল্প! বহুজাতিক কোম্পানির দাপট নেই বললেই চলে। কিন্তু বাংলাদেশের ওষুধশিল্প মালিকদের সংগঠন বা স্বাস্থ্য খাতের কোনো সংগঠন আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা জানায়নি।

১৯৯০ সালের স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নেও জাফরুল্লাহ অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। কিন্তু এটির প্রচার এবং সর্বমহলে একে গ্রহণযোগ্য করার জন্য অংশীজনের সমর্থন আনতে তিনি সফল হতে পারেননি। 

সে সময়ের শাসক প্রেসিডেন্ট এরশাদ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে চিকিৎসকদের ঢালাও দোষারোপ করে বক্তব্য রাখলে খসড়া স্বাস্থ্য নীতিটি রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু এখনো যেকোনো বিচারে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাগ্রসর স্বাস্থ্যনীতি হলো ১৯৯০–এর স্বাস্থ্যনীতি। 

গণস্বাস্থ্যর মডেল নিয়ে ১৯৭৫ সালে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে ল্যানসেট সাময়িকী। ১৯৭৮ সালে আলমা আটায় যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার সংজ্ঞা ও সবার জন্য স্বাস্থ্যনীতি ঘোষণা করে, তখন যে চারটি মডেলকে তুলে ধরা হয়েছিল, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা তাদের অন্যতম। ধূমপায়ীদের আবেদন করার দরকার নেই—তাঁর চালু করা এই নিয়মের মর্ম ৩০ বছর পর অনুধাবন করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ তাঁর কাছ থেকে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংস্কার, দরিদ্রবান্ধব করার পরামর্শ নিয়েছে। যে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বিলেতের আয়েশি জীবন ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেই পাকিস্তানও তাঁকে সম্মান জানিয়ে নিয়ে গেছে, তাঁর কাছে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে পরামর্শ চেয়েছে। পাঞ্জাবের একসময়ের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের আমন্ত্রণ তিনি ফেরাননি; কারণ তিনি চেয়েছিলেন জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে সাধারণ মানুষ বিশেষত পাঞ্জাবের গ্রামীণ নারীরা এগিয়ে আসুক। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোনো স্বাস্থ্য সম্মেলনে যাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের মধ্যে যাদের হয়েছে, তারা প্রত্যক্ষ করেছি, কীভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের খ্যাতনামা ব্যক্তিরা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান দিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ আমূল বদলে দেয় তাঁর জীবন। চিন্তাভাবনায় বাংলাদেশের অনেক উন্নয়নবিশারদের চেয়েও কয়েক দশক এগিয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর অনাড়ম্বর, সাধারণ জীবনযাপন সবার কাছে ছিল বিস্ময়ের ব্যাপার। তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসাযুদ্ধে আইকন হিসেবে বাংলাদেশ হাসপাতাল গড়ার পেছনে অবদান, মুক্তিযুদ্ধে সাংগঠনিক তৎপরতা এবং স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য খাতে, নারীর ক্ষমতায়নে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়ন চিন্তা, সর্বোপরি জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নসহ বাংলাদেশের ওষুধশিল্প প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের জন্য এবং জনস্বাস্থ্যের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর সুপ্রভাবের কারণে তিনি একজন স্মরণীয় ব্যক্তি হয়ে থাকবেন।

খায়রুল ইসলাম: জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী; ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক