রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা

শাহ আবদুল করিম: বাংলা মায়ের ছেলে

জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।

শাহ আবদুল করিম (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬—১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯)
শাহ আবদুল করিম 
(১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬—১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯)

আজকাল বলতে শোনা যায়, হাল আমলে কিছু ব্যক্তি নাকি শাহ আবদুল করিমকে জনসমাজে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন! নাগরিক সমাজে করিমের খ্যাতি পাওয়ার পেছনে কার কার যোগসূত্র রয়েছে, এরও ফিরিস্তি কেউ কেউ দেন। অথচ সেই চল্লিশের দশকেই করিম ছিলেন হাওরাঞ্চলে বিপুলভাবে জনপ্রিয় এক শিল্পী। শিকড়ঘেঁষা মানুষ নন, মূলত শহুরে মানুষই তাঁকে যথাসময়ে চিনতে ব্যর্থ হয়েছে।

টানা সাত দশক গ্রামের উঠোন-সংস্কৃতিকে প্রাণবান করে রেখেছেন শাহ আবদুল করিম। যে কয়েকজন শিল্পীর কণ্ঠে বিকশিত হয়েছে তর্কবিতর্কমূলক মালজোড়া গানের ধারা, করিম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাউলগানে দাপুটে শিল্পী তো তিনি ছিলেনই। কেবল সুর আর কণ্ঠের মাধুর্যে হাওর-অধ্যুষিত সাত জেলায় পেয়েছেন মান্যতা, হয়েছেন আদরণীয়। পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে গান পরিবেশন আর কাগমারী সম্মেলনে অংশগ্রহণের পর ধীরে ধীরে আরও পাকা হয়েছে করিমের অবস্থান। পেয়েছেন ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য। শ্রোতাদের সংগীততৃষ্ণা মেটাতে একাধিকবার গিয়েছেন লন্ডনেও। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে, বিশেষত নব্বইয়ের দশকে করিম হয়ে ওঠেন এক সাংস্কৃতিক ‘আইকন’।

দুই

শাহ আবদুল করিম জন্ম নিয়েছিলেন ধলআশ্রম গ্রামে, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে, ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। পয়সাকড়ির অভাবে পড়াশোনা হয়নি। অল্প বয়সেই গ্রামের মহাজন বাড়িতে গরু চরানোর চাকরি নেন। ছিলেন মুদিদোকানেরও কর্মচারী। সেই শৈশবে ঘরে যখন ‘নুন আনতে পানতা ফুরোয়’ অবস্থা, তখন গানে তাঁর হাতেখড়ি। বয়স ২০ পেরোনোর আগেই হয়ে ওঠেন শ্রোতৃপ্রিয় শিল্পী। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর আগেই ‘একুশে পদক’সহ অনেক সম্মাননায় ভূষিত হন। জীবদ্দশাতেই পান কিংবদন্তির মর্যাদা। করিম-রচিত প্রায় পাঁচ শ গানের অনেকগুলোই তাঁর জীবদ্দশাতেই মানুষের মুখে মুখে ফিরত। এখন তা আরও বেড়েছে।

কণ্ঠের মাধুর্য যেমন শাহ করিমের সম্পদ, তেমনি মনোমুগ্ধকর তাঁর গানের ভাষা। অভিজ্ঞতাপ্রসূত আত্মবীক্ষণ তাঁর গানকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। আশ্চর্য এক নির্মাণশৈলী তাঁর প্রতিটি গানকে অন্য বাউল-ফকির-বৈষ্ণব সহজিয়া গীতিকারদের চেয়ে করেছে আলাদা। হাওরের জল-মাটি-বাতাস থেকে উঠে আসা একেকটা শব্দ আর উপমা করিমের গানকে দীপিত করেছে। কেবল স্বতন্ত্র বুননশীলতা দিয়ে লোকায়ত ভুবনের অনন্য সাধক লালন-হাসন-রাধারমণের একচেটিয়া অবস্থানে ভাগ বসিয়েছেন করিম। তাঁর গানে যেমন তাঁর নিজ এলাকা ভাটির জীবনযাপন আর ইতিহাস মেলে, তেমনি পাওয়া যায় দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব আর মনের মানুষকে খোঁজার আকুলতা। প্রগতি, মুক্তচিন্তা, অসাম্প্রদায়িকতা আর গণচেতনাও তাঁর গানে এসেছে। বাউলসাধনা, মনঃশিক্ষা, ভক্তিগীতি ও বিচ্ছেদ করিম-রচনার অন্যতম বিষয়বস্তু। করিমের চেতনা, দর্শন ও যাপনে আত্ম-অতিক্রমের পথটি নিশ্চয়ই গভীরতর বিচার–বিবেচনার দাবি রাখে। একাধিক গানে করিম সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-সামন্তবাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ফারাক নির্ণয় করেছেন, এমনতর বোধ তাঁকে শেষ পর্যন্ত মার্ক্স-লেনিনদের দর্শনগত-তত্ত্বে ফেলে বিচার-বিশ্লেষণ করতে বাধ্য করে।

বাংলাদেশের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির জীবন্ত চিত্রটিই করিমের অনেক গানে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশ বললেই যে অপরূপ লীলাবৈচিত্র্যের ছবি চোখে ভেসে ওঠে, যেখানে মানুষের পার্শ্বচরিত্র হিসেবে ধরা দেয় গাছ-পাখি-নদী—বাংলাদেশের সে চিত্রই আবদুল করিমের গানে ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি তাঁর অনেক গানে বিরূপ প্রকৃতির মোকাবিলায় ভাটি অঞ্চলের নিরন্ন-অসহায় মানুষের সংগ্রামী জীবনচিত্র ধারনা করা হয়েছে। এসব রচনায় যথার্থভাবে খুঁজে পাওয়া যায় হাওরাঞ্চলের মানুষের সংগ্রামী জীবনের কাহিনি।

জীবনভর যেমন বাউল-দর্শনের চর্চা করেছেন, ব্যস্ত থেকেছেন আত্মানুসন্ধানে, একই সঙ্গে গণসংগীত গেয়ে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন আবদুল করিম। ব্যক্তিজীবনের দারিদ্র্য আর হতাশার মধ্যেও করিম আশা হারাননি, মানুষকে শুনিয়েছেন আশার বাণী। করিম মূলত ছিলেন নিঃস্ব–রিক্ত, দারিদ্র্যজর্জর নিম্নবর্গীয়দের প্রতিনিধি।

শাহ আবদুল করিম

এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন, গান রচনার পাশাপাশি শাহ আবদুল করিম প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামেও ছিলেন সমভাবে তৎপর। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী কর্মসূচিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। এসব পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন গণসংগীত, মঞ্চে-গ্রামীণ উঠোনে সেসব গেয়ে উজ্জীবিত করেছেন অনেককে।

ধর্মান্ধতা ও সব ধরনের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধেও ছিল আবদুল করিমের আন্দোলন-সংগ্রাম। জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে যারা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, তাদের বিরুদ্ধেও তিনি উচ্চকণ্ঠ। এক উদার মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল করিমের স্বপ্ন, যেখানে ধর্ম–বর্ণ-জাতিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতির মধ্যে বাস করবে। বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তি, উদার ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব বিকাশে করিমের রচনা এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

তিন

দেশকালের সীমানা পেরিয়ে শাহ আবদুল করিম এখন কালজয়ী এক পুরুষ। তাঁর গানে মজেছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী মানুষ। ইংরেজি অনুবাদে করিমের গান এমনকি যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পীর কণ্ঠেও উঠেছে। অজপাড়াগাঁয়ের নৈশ বিদ্যালয়ে মাত্র আট দিনের অক্ষর-শিক্ষা পাওয়া করিমের জীবনদর্শনে বুঁদ হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সর্বোচ্চ শিক্ষিত অনেক ব্যক্তিও তাঁকে নিয়ে করছেন অভিসন্দর্ভ রচনা। সময় আর কাল পেরিয়ে শাহ আবদুল করিম এখন মরিমভুবনের উজ্জ্বল এক জ্যোতিষ্ক। সেই জ্যোতিষ্কের আলোয় আলোকিত বাংলা ভূমি।

সুমনকুমার দাশ: শাহ আবদুল করিমের জীবনীকার, লোকসংস্কৃতি গবেষক