বাংলাদেশ এখন তার ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে। আধা স্বৈরাচারী শাসন থেকে প্রত্যাশিত এক কার্যকর গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার পথে সে পা রেখেছে। সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থান এবং হাজার মানুষের, ব্যক্তির সর্বোচ্চ ত্যাগের ফলে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। এই পরিবর্তন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে একটি অন্তর্বর্তী সরকার। ১৫ বছরের শাসক আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে কী দ্রুততার সঙ্গে নামিয়ে দিয়েছে জনগণ, তা বিশ্ব দেখেছে। এই কাজ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তা সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্ম এবং বৃহত্তর জনসাধারণের আবেগ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ এই রূপান্তরকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
জনগণ বাংলাদেশকে দেশে ও বিশ্বে একটি আত্মবিশ্বাসী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায়। ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্ট আন্দোলনে সে আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্ব গ্রহণ বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ ও উদ্দীপনাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। বহুপক্ষীয় সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পশ্চিমা ব্লক থেকে যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া গেছে। আর চীন ও প্রাচ্যের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক শক্তি, যেমন মালয়েশিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। এখন জনগণ সেই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবে দেখতে চায়।
বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য হলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। ড. ইউনূসের প্রশাসনকে অবশ্যই নির্বাচনী সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য বিশ্বব্যাপী সমর্থন। দেশের পররাষ্ট্রনীতির যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে সংস্কার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের পরও ব্যাপক সংস্কার এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা।
যেসব সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে পররাষ্ট্রনীতিও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সেই পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে থাকবে চারটি প্রধান বিষয়। প্রথমত, দুই প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন স্বাভাবিকভাবেই ভূরাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করবে।
এটা বোঝা দরকার যে পররাষ্ট্রনীতি আর শুধু উচ্চ স্তরের রাজনীতির বিষয় নয়। উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে তা এখন জনসাধারণের যাচাইয়ের বিষয় হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্ট আন্দোলনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের প্রতি বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের উপলব্ধি হয়ে উঠেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। আন্দোলন আমাদের বৈদেশিক নীতিতে একটি আমূল পরিবর্তনের পক্ষে জোর দিয়েছে। এই আন্দোলন একটি সক্রিয় বৈদেশিক নীতির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। এই নীতি হতে হবে এক গঠনমূলক বয়ান, যা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতানির্বিশেষে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় ঐকমত্যকে প্রতিফলিত করবে।
পররাষ্ট্রনীতিতে কী সংস্কার করা উচিত
মূল সংস্কার নিহিত থাকা উচিত বয়ানের মধ্যে। বাংলাদেশ সমর্থন করে বহুপক্ষীয় ও নিবেদিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। তবে এটুকুই যথেষ্ট নয়। দেশের সংবিধানের ২৫তম অনুচ্ছেদ রাজনৈতিক, জাতিগত, ধর্মীয় বা জাতিগত সম্পর্কনির্বিশেষে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। আমাদের বৈদেশিক নীতির বয়ানগুলো অবশ্যই বিশ্বব্যাপী মানবিক বিষয়ের পক্ষ অবলম্বন করবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। এ জন্য জাতীয় সার্বভৌমত্বকে স্পষ্টভাবে হাজির করা দরকার, যেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে বাইরের পক্ষের প্রভাবের ওপর সীমা টেনে দেওয়া যায়। তবে একটি ব্যাপারে সতর্কতাও জরুরি। দেশে ভালো সরকার থাকলেই কেবল এই বয়ান জোরদার হবে।
যেসব সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে পররাষ্ট্রনীতিও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সেই পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে থাকবে চারটি প্রধান বিষয়। প্রথমত, দুই প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন স্বাভাবিকভাবেই ভূরাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করবে। অতএব, বাংলাদেশের কৌশল হওয়া উচিত বাণিজ্যিক উদারতাবাদের ওপর ভিত্তি করে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে জাতীয় স্বার্থকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া। বঙ্গোপসাগর হচ্ছে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মাঝখানের সমুদ্র। তাই সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশকে চলমান ভূকৌশলগত জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে।
দ্বিতীয়ত, দ্বিপক্ষীয় সংযুক্তির ক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলিয়ান বাস্তববাদকে কেন্দ্রে রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি বহুপক্ষীয়তাকে আদর্শবাদ থেকে বাস্তববাদে রূপান্তরিত করতে হবে। আর তা করতে হবে বৈশ্বিক মানবতাবাদ এবং অভ্যন্তরীণ মানব নিরাপত্তা স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে। একে হতে হবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার ওপর নির্মিত। সুষ্ঠু ও ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক বিষয়ের পক্ষে দাঁড়ানো এবং আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করা হবে এর প্রেরণা। বাংলাদেশ যে দেশগুলোর সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে, তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
তৃতীয়ত, আমাদের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও প্রসারিত করতে হবে। বাস্তবসম্মতভাবে সমাধান করতে হবে মিয়ানমারের সঙ্গে সমস্যাগুলো। জাপান, কোরিয়া ও দক্ষিণ-পূর্বের দেশগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সংযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, রাখাইন অংশীজন, রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টজনদের সহযোগিতায় মিয়ানমারকে স্থিতিশীল করার জন্য স্পষ্ট বৈদেশিক ও সমন্বিত কৌশলগত নীতি তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ১৯৭৮-৭৯ এবং ১৯৯১-৯২ সালে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সফল ইতিহাস রয়েছে। তাই বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশের স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে জাতীয় কৌশলগত বিবেচনার ভিত্তিতে মিয়ানমার নীতি তৈরি ও প্রয়োগ করতে হবে।
ভারতের ওপর প্রাথমিক ফোকাস রেখে বাংলাদেশকে একটি বিস্তৃত দক্ষিণ এশিয়া নীতি প্রণয়ন করতে হবে। রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা উদ্বেগকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত স্বচ্ছ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতি এবং আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়মের ভিত্তিতে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল আর বঙ্গোপসাগর–সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাহ্যিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সংখ্যালঘু সমস্যা, এমনকি এর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বাংলাদেশের ওপর ভারতীয় অস্থিতিশীলতার সম্ভাব্য প্রভাবের দিকে নজর দিতে হবে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য তাদের বিদেশ নীতিতে ভারতের সব পক্ষ দৃঢ়ভাবে এক পক্ষ থাকে। সে জায়গায় তাদের সংবাদমাধ্যমও ঐক্যবদ্ধ। বলতে দ্বিধা নেই যে তাদের এই অবস্থান থেকে আমাদের রাজনীতিবিদদের অনেক কিছু শেখার আছে।
যাত্রা কোন দিকে
জুলাই–আগস্ট আন্দোলনকে ঘিরে জনসাধারণের মনোভাব বিবেচনা করে বাংলাদেশকে তার বৈদেশিক নীতির দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। একটি আত্মবিশ্বাসী জাতির চেতনা মূর্ত করার জন্য দেশের এমন কূটনীতিক, প্রতিরক্ষাকৌশলবিদ এবং রাজনীতিবিদদের প্রয়োজন, যাঁরা যোগ্য, সাহসী ও উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি আজ সমাজকে পুনর্নির্মাণ করছে। কূটনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়। সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা ভাষার মিথস্ক্রিয়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে সুরক্ষার গ্যারান্টি দিতে পারে না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, ইউক্রেন বা ফিলিস্তিন হলো এর ক্ল্যাসিক উদাহরণ।
বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী, জনতাত্ত্বিক বিভাগ, সম্পদকে ঘিরে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদ, বাণিজ্য সুরক্ষাবাদ, শক্তি সরবরাহ লাইন, প্রযুক্তি বৈষম্য, রাজনৈতিক জনতুষ্টিবাদ, শ্রম অভিবাসন, ভুল তথ্য, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য, জলবায়ু, জল এবং স্বাস্থ্য সংকটের মতো বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য সমস্যা হিসেবে হাজির হতেই থাকবে। বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় উগ্র ডানপন্থী বয়ান ক্রমেই জোরদার হতে দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক নীতিকে ধর্মতত্ত্ব দিয়ে চালিত হওয়ার পরিবর্তে ব্যয় আর বিনিময়ে পাওয়া সুবিধা দিয়ে মাপ হবে।
সব মিলিয়ে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বর্তমানে কাজ করা অতীতের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন রকম। জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকদের সঙ্গে আমার কথোপকথন হয়েছিল। সেসব থেকে আমার মনে হয়েছে, আমাদের পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আমাদের সিদ্ধান্তে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন অর্জনের চেষ্টা করা। পররাষ্ট্রনীতির সমন্বয় সাধন এখনো একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ। সমন্বয়হীনতা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কয়েক দশক ধরে সমস্যায় ফেলেছে। এ ছাড়া বৈদেশিক নীতির জবাবদিহি আরও স্পষ্ট হওয়া দরকার। সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ ১৪৫ ও ১৪৫ক এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এর আলোচনা হতে দেখা যায় না।
সামনের বছরগুলোতে বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির জন্য একটি শক্তিশালী জাতীয় ঐকমত্য অপরিহার্য হবে। মনে রাখা দরকার যে বৈদেশিক নীতির প্রাথমিক চ্যালেঞ্জগুলো জন্ম নেয় রাজনৈতিক বিভাজন থেকে। হেনরি কিসিঞ্জার একবার পরিহাস করে বলেছিলেন, ‘পররাষ্ট্রনীতি অনেক চৌকস হয়ে লাভ নেই, যদি তা অল্প কিছু লোকের মনে জন্ম নিয়ে কারও হৃদয়ে স্থান না পায়।’ কথাটা মনে রাখা দরকার।
মূল ইংরেজি থেকে অনূদিত
* সাহাব এনাম খান : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক