মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্পদে অপ্রতুল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে। কিন্তু নিন্দুকদের আশঙ্কা অসত্য প্রমাণ করে একের পর এক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এই এগিয়ে যাওয়ার পথ রচিত হয়েছিল কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা, অভিনব ভাবনা, ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগে। আমরা ফিরে দেখছি বাংলাদেশের উজ্জ্বল সেসব মুহূর্ত।
স্বাধীনতা–উত্তর সময়ে অর্থাৎ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অংশ। এ সময় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সে সময় প্রান্তিক পর্যায়ের প্রত্যেক মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে তিনি থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ধারণা নিয়ে আসেন। সত্তরের দশকে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামে বাস করত। স্বাস্থ্যসেবাকে এই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার ভিত তৈরি হয় তখনই।
সে সময় মানুষের ধারণা ছিল, রোগবালাই হলে চিকিৎসা পেতে হাসপাতালে যেতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের প্রতিটি থানায় ৩১ শয্যাবিশিষ্ট একটি করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং প্রতিটি ইউনিয়নে একটি রুরাল ডিসপেনসারি (ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র) নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং থানা স্বাস্থ্য প্রশাসক, মেডিকেল কর্মকর্তা, নার্স, অন্যান্য কর্মচারীসহ আনুষঙ্গিক পদ সৃষ্টি করা হয়। সত্তরের দশকের আগে বিশ্বে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হতো না। ‘২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’—এই লক্ষ্য অর্জন করার নিমিত্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৮ সালে আলমা আতা ঘোষণার মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল হিসেবে চিহ্নিত করে।
জন্মের পর থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সব শিশুই বিভিন্ন মারাত্মক সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। কারণ, এ সময় শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা থাকে তুলনামূলক কম। শুধু শিশুই নয়, বড়রাও এ ধরনের রোগে মৃত্যুবরণ করার ঝুঁকিতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে গুটিবসন্তের কথা বলা যেতে পারে। তবে বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে বিশ্বে এসব রোগের বিরুদ্ধে নিরাপদ ও কার্যকর টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বজুড়েই মারাত্মক সংক্রামক রোগের প্রকোপ কমতে থাকে। টিকার মাধ্যমেই গুটিবসন্তের মতো মারাত্মক প্রাণঘাতী রোগকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭৮ সালের আলমা আতা সম্মেলনের পর বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো টিকাদান কার্যক্রমের পথচলা শুরু হয় ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল। প্রাথমিক পর্যায়ে শহরাঞ্চলে এই কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয় এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৮৫ সাল থেকে সম্প্রসারিত আকারে দেশের গ্রামাঞ্চলেও এই কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। উল্লেখ্য, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই শুরুর আগে প্রতিবছর বাংলাদেশে সাত-আট লাখ শিশু মারাত্মক সংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করত বা বিকলাঙ্গ হতো।
ইপিআই কর্মসূচির শুরুতে দেশে ছয়টি সংক্রামক রোগ—যক্ষ্মা, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, পোলিও ও হামের টিকা দেওয়া হতো। সে সময় দেশে ৪টি বিভাগ এবং ২১টি জেলা ছিল। নতুন এই কর্মসূচিকে আরও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত করে বিশদ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ইপিআই শুরুর ছয় বছর পর অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে দেশের মাত্র ২ শতাংশ শিশুকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়। ওই বছরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের সব শিশুকে টিকার আওতায় আনার উদ্দশ্যে শুরু করে ‘ইউনিভার্সাল চাইল্ডহুড ইমিউনাইজেশন’ কর্মসূচি।
মাঠপর্যায়ে ফলাফল আশাব্যঞ্জক হওয়ায় ১৯৮৭ সালে ৬২টি উপজেলায়, ১৯৮৮ সালে ১২০টি উপজেলায় এবং ১৯৮৯ সালে সমগ্র দেশে এই কর্মসূচি সম্প্রসারিত করা হয়। এই কর্মসূচির জন্য সে সময় মাঠপর্যায়ে একেবারে ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁরাই এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা পালন করেন। সে সময় তিনটি ওয়ার্ড নিয়ে একটি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হতো। প্রতিটি ইউনিয়নের তিনটি পুরোনো ওয়ার্ডকে ৮টি করে সাব-ব্লকে ভাগ করা হয়। অর্থাৎ, প্রতিটি ইউনিয়নে ২৪টি সাব-ব্লক। প্রতিটি সাব-ব্লকে মাসে একবার করে টিকা দেওয়া হয়। এসব কেন্দ্রকে বলা হয় ‘অস্থায়ী বা আউটরিচ কেন্দ্র’। দীর্ঘ মেয়াদে টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে এবং টিকা দেওয়া হয়, এমন কেন্দ্রকে বলে স্থায়ী কেন্দ্র। যেমন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল ইত্যাদি। তবে জীবন রক্ষাকারী মূল্যবান টিকাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য বিবেচনা করে ইপিআই স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে প্রতিটি ব্লকে একটি করে অস্থায়ী টিকাকেন্দ্রের প্রচলন করে। এসব কেন্দ্র স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, পাড়া-মহল্লার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বাড়ির উঠান বা বৈঠকখানা, স্কুল-মাদ্রাসা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বারান্দা, গ্রামের কোনো হাট বা বাজার, যেখানে জনসমাগম বেশি, এমন স্থানে অবস্থিত। টিকা–সেবাকে দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে বাংলাদেশের ইপিআই কর্মকৌশল পরবর্তী সময় অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়, যা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। আজ যখন স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন সরকারি সেবাকে টেকসই করতে পৃথিবীজুড়ে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ধারণা বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে ইপিআই অনেক আগেই যুগান্তকারী এই ধারণা সফলভাবে বাস্তবায়ন করে টিকাদান কর্মসূচিকে দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও টেকসই করেছে। ইপিআইয়ের অস্থায়ী বা আউটরিচ কেন্দ্র সেবাটিকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। কারণ, একজন মা তার শিশুকে নিয়ে বাড়ির আশপাশেই এই সেবা নিতে পারেন। তা ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে আমরা যখন এই কর্মসূচি প্রচার করি, তখন তারাও নিজ থেকে এগিয়ে আসে। এমনকি নিজেদের বাড়ির আঙিনায় নিয়মিতভাবে টিকাদান অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে জনগণের মধ্যেও অংশীদারত্বের বোধ সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা নিজেরাও একে তাঁদের দায়িত্ব বলে মনে করেন। টিটেনাস, ডিফথেরিয়া, যক্ষ্মা, পোলিওর মতো মারাত্মক রোগের কারণে বিকলাঙ্গতা ও মৃত্যু যে হতো, এটা মানুষ জানত। সারা দেশে ইপিআইয়ের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির এটিও একটি কারণ। উল্লেখ্য যে সারা দেশে বর্তমানে এ রকম মোট আউটরিচ কেন্দ্রের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি। বাংলাদেশ সরকারকে এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সহায়তা দিয়ে এসেছে গ্যাভি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএসএআইডি, ব্র্যাক, কেয়ারসহ দেশি-বিদেশি অনেক সংস্থা।
মাঠপর্যায়ে ইপিআইয়ের কর্মী হিসেবে নিয়োজিত আছেন স্বাস্থ্য সহকারী। তাঁদের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করেন স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক। এর পাশাপাশি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন এবং বিভাগীয় পরিচালকেরা নিয়মিত কার্যক্রম তদারক করেন। নগরাঞ্চলে ইপিআই কর্মসূচি এনজিওনির্ভর। সিটি করপোরেশন এই দায়িত্ব পালন করে। সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শহরাঞ্চলে ইপিআই কার্যক্রম এনজিও কেন্দ্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম গ্রামঞ্চলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং শহরাঞ্চলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত হয়। ইপিআইয়ের মাঠকর্মী, তথা একজন স্বাস্থ্য সহকারীকে তাঁর নিজের এলাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এর কারণ হলো তিনি তাঁর এলাকার জনসাধারণের কাছে পরিচিত, ফলে কার্যক্রম বাস্তবায়ন অত্যন্ত সহজ হয়। প্রতিবছরের শেষে স্বাস্থ্য সহকারীরা তাঁদের কর্ম এলাকার জনসাধারণের তথ্য সংগ্রহ করে নতুন বছরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও সেশন প্ল্যান করেন, যাকে ইপিআইয়ের ভাষায় মাইক্রোপ্ল্যান বলা হয়। মাইক্রোপ্ল্যান তৈরি শেষে সারা দেশের জন্য একটি টিকাদান ক্যালেন্ডার তৈরি হয়, যা বছরব্যাপী বাস্তবায়িত হয়। এতে কতজন কোন কেন্দ্রে কখন কোন কোন টিকা পাবেন, তা লিপিবদ্ধ থাকে। স্বাস্থ্য সহকারীরা টিকা দেওয়ার আগের দিন তাঁর কর্মএলাকার যাঁরা টিকা পাবেন, তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানিয়ে আসে এবং টিকা কার্ড সরবরাহ করেন। এসবের পাশাপাশি মাইকিং, জুমার নামাজের মাঝখানে প্রচারণা, উঠান বৈঠক ইত্যাদির মাধ্যমেও জনগণকে টিকা সম্পর্কে সচেতন করা হয়। দেশের প্রতিটি কেন্দ্রে টিকাদান সেশন চলাকালে ইপিআইয়ের ‘মণি’ লোগোসংবলিত হলুদ পতাকা দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করা হয়। এ ছাড়া বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় টিভিতে।
ন্যাশনাল ইউমিউনিজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপের (এনআইটিএজি) পরামর্শে এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ইপিআই প্রতিটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ইপিআইয়ের নিজস্ব দল আছে। লাইন ডিরেক্টর, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার—সবাই এই কাজ তদারক করেন। ইপিআইয়ের সাফল্যের বড় কারণ এর নিবেদিতপ্রাণ নেটওয়ার্ক এবং পরিকল্পিত কর্মপদ্ধতি। বাংলাদেশ আজ বহির্বিশ্বে ইপিআই এবং খাওয়ার স্যালাইন—এই দুটি সফল কার্যক্রমের মাধ্যমেই পরিচিত।
নতুন কোনো টিকা মাঠপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আগে প্রতিটি কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এভাবে সবাইকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা সফলতা অর্জন করতে পেরেছি। আমাদের কিছু লক্ষ্য আছে। ইপিআই কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অপারেশন প্ল্যান এমএনসিঅ্যান্ডএএইচের অধীন একটি প্রকল্প। আমরা সারা দেশে এক বছরের নিচের শতকরা ৯৫ ভাগ শিশুকে টিকার আওতাভুক্ত করতে চাই। যদিও দুই বছর বয়সের মধ্যে সব টিকা দেওয়া যায়। তাহলে গড়ে প্রতিটি জেলায় ৯০ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে। টিকাদানের একটি বিশেষত্ব হলো ৮০ শতাংশ টার্গেট গ্রুপকে টিকার আওতায় আনতে পারলে বাকি ২০ শতাংশ প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে।
বর্তমানে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) শিশু, কিশোরী ও নারীদের ১১টি মারাত্মক সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় অনূর্ধ্ব–১ বছর বয়সী শিশুদের পূর্ণ টিকার প্রাপ্তির হার ২০০৯ থেক ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশে এ উন্নীত হয়েছে। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ইপিআই দেশে পূর্ণ টিকাদান কভারেজ শতকরা ৮০ ভাগের বেশি বজায় রাখার ফলে শিশুমৃত্যুর হার বহুলাংশে হ্রাস পায়, যা এমডিজি–ফোর অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে বাংলাদেশ এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, যার অন্যতম দুটি সূচক মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হ্রাস করা। উচ্চ টিকাদান কভারেজ বজায় রাখার মাধ্যমে ইতিমধ্যে অনূর্ধ্ব–৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যু হার ২০১৭ সালের প্রতি ১ হাজার জীবিত জন্মে ৪৩ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২২ সাল নাগাদ প্রতি ১ হাজার জীবিত জন্মে ৩১–এ নেমে এসেছে (তথ্যসূত্র: স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম, বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস)।
যেসব অর্জন আমাদের হয়েছে, তা ধরে রাখার পাশাপাশি ভবিষ্যতে আরও নতুন টিকা ইপিআই কর্মসূচিতে যুক্ত হবে। মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়বে, পাশাপাশি অসুখ–বিসুখের পরিমাণও কমে যাবে।
সার্বিক কার্যক্রমে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে এত দূর পর্যন্ত আসা সম্ভব ছিল না। গত তিন বছরে করোনা মহামারি থেকে আমরা দেখেছি, টিকাদান কর্মসূচির বিস্তৃত নেটওয়ার্কের কারণে এখন পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ মানুষকে কোভিড-১৯ টিকার আওতায় আনতে পেরেছি। এসব অর্জনে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা অবিস্মরণীয়। কোনো কাজ মানুষের নিজের দায়বদ্ধতা থেকে না করলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমাদের যত ইপিআই উপকেন্দ্র আছে, তার মধ্যে অধিকাংশই মানুষের বাড়িতে অবস্থিত। তাঁরা তাঁদের বাড়ি কিংবা ঘর ব্যবহার করতে দিচ্ছেন বছরের পর বছর। এটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে করে আসছেন এবং জনহিতকর কাজ বলেই মনে করেন।
আমাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি চলাকালে ১ দিনে ১ কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছি। বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচির স্যাটেলাইট ক্লিনিক, নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল, যেমন ডায়াবেটিস, ক্যানসার, মাতৃস্বাস্থ্য কিংবা হেলথ এডুকেশন, এমনকি যক্ষ্মা রোগের ওষুধও তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে।
ইপিআইয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্যান্য কর্মসূচি সম্প্রসারিত করতে পারলে মানুষের রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক কমে আসবে।
আমাদের দেশে জনসংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মসূচির শুরুর দিকে প্রতিটি ইউনিয়নে তিনটি ওয়ার্ড ছিল, যা এখন ৯টি। সীমানাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই আমাদের এই কর্মসূচির কার্যক্রমকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করা প্রয়োজন। আশা করি শিগগিরই মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ করা হবে।
অল্প কিছুদিন পরই বাংলাদেশের উত্তরণ হবে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে। এত দিন আমরা যেসব টিকা অনুদান হিসেবে পেয়েছি, তা ভবিষ্যতে আমাদের কিনতে হবে। আমাদের নিজস্ব টিকা উৎপাদন ব্যবস্থা নেই। বর্তমান বাজারদরে এই টিকার মূল্য হাজার কোটি টাকার ওপরে। এসব দিক বিবেচনা করে আমরা নিজেরা যেন টিকা উৎপাদন করতে পারি, এই লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এতে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে টিকা রপ্তানি করে আয় করতে পারব।
কেন্দ্রে নির্দিষ্ট দিনে টিকা পৌঁছানো পর্যন্ত সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখার দরকার হয়। টিকার এই ‘কোল্ড চেইন’ বজায় রাখার জন্য প্রথম ধাপে আমদানি করা সব টিকা ইপিআইয়ের কেন্দ্রীয় গুদামে রাখা হয়। কেন্দ্রীয় গুদাম থেকে জেলা গুদামে নেওয়া হয়। জেলা গুদাম থেকে উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের গুদামে রাখা হয়। প্রতিটি স্তরে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় টিকা রাখার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আছে। টিকা দেওয়ার দিন তৃতীয় স্তরের গুদাম থেকে টিকাকেন্দ্রে টিকা নেওয়া হয়।
এখন পর্যন্ত ৪৭টি জেলায় টিকা সংরক্ষণাগার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে টিকা সংরক্ষণের পাশাপাশি কিছু ড্রাই স্টোরেজ নির্মাণ করতে হবে। প্রতিবছর আমরা ৩৮ লাখ টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করছি। এতে এক কোটির বেশি সিরিঞ্জসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিস প্রয়োজন হয়। এসব সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন স্তরে ড্রাই স্টোর নির্মাণ করা প্রয়োজন।
ইপিআই কর্মসূচির আরেকটি সাফল্য হলো ডিজিটালাইজেশন। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে ইপিআই জনগণের টিকা গ্রহণ সহজীকরণ করতে টিকাদান কার্যক্রমে ধারাবাহিকভাবে সহজ, যুগোপযোগী ডিজিটাল ইনোভেশন, যেমন ভ্যাকসিনেশন সেন্টার অ্যাপ, অনলাইন ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, রিমোট টেম্পারেচার মনিটরিং, ই-ট্র্যাকার, অনলাইন মাইক্রোপ্ল্যানিং অ্যান্ড রিপোর্টিং, টিকা গ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রেশন ও টিকা কার্ড সংগ্রহ এবং টিকা সনদ ডাউনলোডের জন্য অনলাইন ভ্যাক্সইপিআই ওয়েবসাইট, সব ক্রয়প্রক্রিয়ার ইজিপি পদ্ধতি ব্যবহার, ইপিআই কভারেজ মনিটরিংয়ের জন্য অনলাইন ডিএইচআইএস-২ ডেটাবেজের ব্যবহার ইত্যাদি বাস্তবায়ন করে চলেছে। সম্প্রতি জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধী এইচপিভি ভ্যাকসিন কার্যক্রম বাস্তবায়নের সময় ইপিআই তৈরি করেছে অনলাইন টিকা নিবন্ধন পোর্টাল (www.vaxepi.gov.bd), যার মাধ্যমে এইচপিভি ভ্যাকসিনের উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নিজ নিজ জন্মনিবন্ধন নম্বর দিয়ে অনলাইনে টিকা গ্রহণের নিবন্ধন, টিকা কার্ড ও টিকা সনদ ডাউনলোড করতে পারবে। পর্যায়ক্রমে ইপিআইয়ের সব টিকা অনলাইন টিকা নিবন্ধন পোর্টালে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
ডেলটা প্ল্যান তথা বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বাস্তবায়নের জন্য জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শ নিয়ে প্রাইমারি হেলথ কেয়ারকে নতুন করে বিন্যাস করতে হবে।
ডা. মো. শামসুল হক:অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও লাইন ডিরেক্টর, এমএনসিঅ্যান্ডএএইচ