জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
জসীমউদ্দীনের বাংলাদেশ—কথাটা হয়তো একটু খটকাসূচক! কারণ, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলা কবিতার ভূগোলে পা রেখেছিলেন জসীমউদ্দীন। বাংলাদেশ বলে আলাদা কোনো রাষ্ট্র তখন ছিল না। ব্রিটিশ রাজদণ্ডের অধীন অবিভক্ত বাংলার সাহিত্যের তখন একটাই নাম—‘বাংলা সাহিত্য’। বাংলাভাষী যেকোনো লেখক বাংলার যেখানে বসেই লিখুন না কেন, সবই বঙ্গভাষার ‘রতন’ বলে বিবেচিত হতো। ওই সময়ে লেখালেখি করেও জসীমউদ্দীনের সাহিত্যে কীভাবে আলাদা করে একটা বাংলাদেশ ছিল, সেটা একটু খোলাসা করে বলা যাক।
পুরো উনিশ শতক ও বিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলার বিচিত্র জায়গা থেকে বিচিত্র সাহিত্য রচিত হলেও এসবের একটা গড়পড়তা প্রবণতা ছিল। এসবের অধিকাংশই ছিল উপনিবেশবাহিত আধুনিক চিন্তাচেতনা ও রুচির কারবারি। ওই দাগকাটা চেতনা ও রুচির বাইরে গিয়েও লিখেছেন কেউ কেউ। সেই বিরল ব্যক্তিদেরই একজন জসীমউদ্দীন। তিনি কলকাতার গড়পড়তা ছাঁচের মাপে নিজেকে বানিয়ে তোলেননি। পিরহান তুলে পশ্চিম পানেও দৌড়াননি। তিনি ছিলেন জল-জঙ্গল-তাঁতি-জেলে আর ‘গরিব চাষা’র পূর্ব বাংলায় (আজকের বাংলাদেশ)। কবিতায় শুধু পূর্ব বাংলাকে রূপময় করেই বাংলা সাহিত্যে একটা নিজস্ব আসন করে নিয়েছিলেন তিনি।
তাঁর নায়কেরা ব্যতিক্রমহীনভাবে কৃষক, রাখাল বা উজানগাঙের নাইয়া। তারা বাঁশি বাজায়। কোরচে বা গামছার কোনায় ‘হুড়ুম’ আর পাটালি গুড় রেখে খায়। ধানের বোঝা নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় নায়িকার বাড়ির সামনে এসে তেষ্টা পায়। মাথার বোঝা ভারী ভারী লাগে। আশ্বিনের ঝড়ে ঘরের চাল উড়ে গেলে রামকাটারি নিয়ে বাঁশ কিনতে যায় পাশের গ্রামের মোল্লাবাড়ি। সেখানে খড়ি কুড়াতে আসা সোনারবরনী মেয়ের সঙ্গে সলজ্জ দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ঘটে প্রণয়। হাট থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে কিষানি নারীর জন্য নিয়ে যায় পুঁতির মালা, রঙিন চুড়ি, মাজন। তাঁর কবিতার পুরুষেরা জারিগানে ওস্তাদ, বিচ্ছেদি তার বেদনার সাথি, দেহাতি-মুর্শিদা-ভাটিয়ালি তার ভাবের দোসর। লাঠিখেলা আর কাইজ্জায় তার জুড়ি মেলা ভার।
জসীমউদ্দীনের নায়িকারা প্রায় সবাই কিষানি। ‘লাল মোরগের পাখার মতো ওড়ে তাহার শাড়ি।’ বিয়ের গীত, নৈলা গানে, বদনা–বিয়ের গানে তার গলাই আগে শোনা যায়। সেয়াই পিঠা বানানোতে সে অতুল্য। বাহারি শিকা বানায় সে। কাঁথার প্রতি ফোঁড়ে ফুটিয়ে তোলে আনন্দ-বেদনার কাব্য। কৃষক গৃহস্থ্যের এই মেয়েরা ভাব জমায় রাখাল, কৃষক, সিঁদুরের বেসাতি বা উজানগাঙের নাইয়ার সঙ্গে। জসীমউদ্দীনের কবিতায় ক্রিয়াশীল মানুষদের এই রকমসকম থেকে যে কেউ খুব সহজেই এদের ভৌগোলিক পরিচয় শনাক্ত করতে পারবে। পেশা, রুচি, শ্রেণি অবস্থান—সব দিক থেকে এরা বাংলাদেশের মানুষ!
জসীমউদ্দীন কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পূর্ব বাংলার মানুষকে তার নিজস্ব সংস্কৃতিতেই রূপময় করে তুলেছিলেন। মার্জন, ঘর্ষণ, প্রলেপন, আরোপণে তাঁর আস্থা ছিল না। এ কারণে তাঁর কবিতাকে সহজেই একটা নির্দিষ্ট ভূগোলের মধ্যে ফেলে উপভোগ ও আবিষ্কার করা যায়। সংস্কৃতির বহিরঙ্গ নয়, অন্তরঙ্গই ছিল তাঁর আরাধ্য। একটি উদাহরণ দেখা যেতে পারে—‘গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,/ গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!/ কেউ বসে বসে বাখারী চাঁছিছে, কেউ পাকাইছে রসি,/ কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাকা বাঁধে কসি কসি।/ কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল/ কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।/ মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে,/ আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।.../ বউদের আজ কোনো কাজ নাই, “বেড়ায়” বাঁধিয়া রসি,/ সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।/ কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপ্নখানি,/ তারে ভাষা দেয় দীঘল সুতার মায়াবী নক্সা টানি।/ বৈদেশী কোন্ বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে,/ মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেড়ে।’ বাংলাদেশ ও এই ভূখণ্ডের বিশেষ যাপন-সংস্কৃতি ছাড়া এই কবিতাকে কি আর কোথাও জুড়ে দেওয়া যায়!
শুধু মানুষ আর সংস্কৃতির কথাই–বা বলি কেন! জসীমউদ্দীনের কবিতাকে বাংলাদেশের ভাষার বিশেষ টোন আর উচ্চারণ পদ্ধতিকে বাদ দিয়েও পড়া যায় না। শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবধি প্রায় সবাই একবাক্যে বলেছেন, পূর্ব বাংলার ভাষার ধরনধারণ বেশ আলাদা। আসলে, শুধু ক্রিয়াপদের বিশেষ গঠনরীতিই নয়, পূর্ব বাংলার ভাষার উচ্চারণভঙ্গি, এমনকি বাগ্ধারা ও বাগ্বিধির মধ্যেও একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। আঞ্চলিক শব্দ ও আঞ্চলিক চলনভঙ্গিকে তার টোনসহ এমন অনায়াসে জসীমউদ্দীন ব্যবহার করেছেন যে মনে হয় যেন তিনি এগুলোর আঞ্চলিকতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। আসলে তিনি প্রমিত ভাষার চলতি রূপটাকে মান্য করে এর মধ্যে গুছি হিসেবে পুরে দিয়েছেন পূর্ব বাংলার ভাষাবৈশিষ্ট্য। উদাহরণ দেখা যাক—‘কোথা থেকে এলো রসের বৈরাগী আর বোষ্টমী,/ আকাশ হতে নামল কি চান হাসলী পরা অষ্টমী।/ “চেকন চোকন” বোষ্টমী তার ঝাটরা মাথায় দীঘল কেশ,/ খেজুর গাছের “বাগড়া” যেমন পুব হাওয়াতে দুলছে বেশ।/ পাছা পেড়ে শাড়িখানি পাছা বেয়ে যায় পড়ে,/ বৈরাগী কয়, তারির সাথে ফাঁস লাগায় যাই মরে।/ মুখখানি তার ডাগর ডোগর ঘষামাজা কলসখানি,/ বৈরাগী কয় গলায় বেঁধে মাপতে পারি গাঙের পানি।’ এভাবে জসীমউদ্দীনের কবিতায় উঠে আসা মানুষ, তাদের শ্রেণি-পেশা, সংস্কৃতি, রুচি আর ভাষাভঙ্গির বাংলাদেশ–লগ্নতা দেখেই কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, ‘[জসীমউদ্দীনের] কবিতা পূর্ববঙ্গেরই নির্যাস। পূর্ববঙ্গ বাদ দিলে তাঁর কবিতার সামান্যই অবশিষ্ট থাকবে।’ (রণজিৎ দাশ ও সাজ্জাদ শরিফ, ২০০৯, ‘ভূমিকা’, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা)
আসলে দেশ একটা মানসিক আইডিয়া। হ্যাঁ, দেশের একটা ভূগোল থাকে; নির্দিষ্ট জমিন থাকে। এটা দেশের বস্তুগত দিক বটে। কিন্তু একই ভূগোলে বাস করা মানুষের মধ্যেও দেশ বিষয়ে ধারণা হতে পারে বিচিত্র। দেশ সম্পর্কে গরিবের ধারণা আর বড় লোকের ধারণা নিশ্চয় এক না। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষের দেশভাবনাও এক না। এক নয়, ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীনের দেশকল্পনা ও দেশভজনা। সুতরাং মানুষভেদে দেশের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন হয়। জসীমউদ্দীন দেশ বলতে কী বুঝতেন?
ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, জসীমউদ্দীন দেশ বলতে বুঝতেন অধিকাংশ মানুষের সামষ্টিক পরিস্থিতিকে। দেশের বা জাতির রুচি বলতেও তিনি অধিকাংশ মানুষের রুচিকেই বুঝতেন। তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ও তাদের রুচি-সংস্কৃতি-ভাষা নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। বিশ শতকের প্রথম দিকের পূর্ব বাংলা আসলে কৃষক-জেলে-তাঁতি-কুমোরের দেশ। এদের যাপনের নির্যাসই জসীমউদ্দীনের যাবতীয় কবিতার কস্তুরি-সৌরভ। শ্রেণিবিচারে এসব মানুষ নিঃসন্দেহে প্রান্তিক। ফলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় তাদের গুরুত্বও কম। কিন্তু জসীমউদ্দীন খুব স্পষ্ট ভাষায় বারবার বলেছেন, তিনি চিরকাল দুর্বল চাষাদের পক্ষ নিয়েই লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জসীমউদ্দীন যেদিন তাঁর রাখালী ও নক্সী কাঁথার মাঠ বই দুটি উপহার দেন, সেদিন কবি বই দুটি নেড়েচেড়ে এই কথাটিই বলেছিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে তুমি বাংলাদেশের চাষী মুসলমানদের বিষয়ে লিখেছ। তোমার বই আমি পড়ব।’ (ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়, পলাশ প্রকাশনী, ১৯৯২, ঢাকা) জসীমউদ্দীন তাঁর যে দেশে মানুষ বড় বইয়েও নিজেকে বাংলাদেশের ‘কৃষকের কবি’ বলেই উল্লেখ করেছেন।
এসব বুঝেই কি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জসীমউদ্দীনকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ করতে চেয়েছিলেন! (কুদরত-ই-হুদা, জসীমউদ্দীন, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৮) কিন্তু হায়! বাংলাদেশের সাহিত্য থেকে শুরু করে রাষ্ট্রব্যবস্থা ওই সব মানুষের অনুকূলে কতটুকু গিয়েছে! ‘আমাদের আধুনিকতা’, ‘আমাদের জাতীয় চৈতন্য’ ও ‘আমাদের রাষ্ট্র’ আবিষ্কারে আমরা কি যথেষ্ট মনোযোগী ও সফল হতে পেরেছি! এ ক্ষেত্রে জসীমউদ্দীনের বাংলাদেশকে দেখার চোখ ও নিরিখ আমাদের জন্য কাজের হতে পারে বলে মনে হয়।
কুদরত-ই-হুদা: জসীমউদ্দীনের জীবনীকার; গবেষক