জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
বিরল কিছু মানুষের জীবন দেশের ঐতিহাসিক বিবর্তনকে ধারণ করে গড়ে ওঠে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান এমনই একজন মানুষ। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও জাতীয় বিকাশের ধারার সঙ্গে তাঁর জীবনের সিঁড়ি-ভাঙা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সীমিত পরিসরে এই মহতী জীবনের কতিপয় নির্বাচিত বৈশিষ্ট্য বিধৃত করছি।
আমরা অবগত যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের যৌক্তিক ও নৈতিক ভিত্তি দিয়েছিল দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের দ্বারা প্রণীত ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্ব’। রেহমান সোবহান শুধু যে এর ধারণাগত কাঠামো তৈরিতে যুক্ত ছিলেন, তা–ই না; তিনি দুই অর্থনীতি তত্ত্বকে বাঙ্ময় করে তোলা তথা বৃহত্তর সমাজে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রেও ছিলেন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানসহ পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে বিতর্ক করেছেন। পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশন, অর্থনীতি সমিতিসহ বিভিন্ন পাটাতনে তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তিতর্ক দিয়ে পূর্বাঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধিকারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর এই প্রচেষ্টা পরবর্তী সময়ে তাঁকে নিয়ে আসে বঙ্গবন্ধুর কাছে—ছয় দফা প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এবং ১৯৭০–এ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়নের কাজে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত হিসেবে রেহমান সোবহানের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ করা যায়। বিরাট ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে তিনি ভারত হয়ে বিদেশে যান। ভারতে থাকাকালে, ১৯৭১–এর এপ্রিল মাসে, তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের প্রতি ভারত সরকারের আস্থা সৃষ্টিতে তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্য দেওয়া বন্ধের জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে কৃতিত্বপূর্ণ তৎপরতা চালান।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে রেহমান সোবহানের সবিশেষ ভূমিকা সর্বজনবিদিত। একটি স্বাবলম্বী, বিকশিত ও ন্যায্যতাভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে রচিত হয় এই পরিকল্পনা। এসব লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে অনুসৃত কোনো কোনো পদক্ষেপ নিয়ে ঘটনা-উত্তর বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু এসব পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য নিয়ে দ্বিমত সামান্যই আছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার জগতে এই দলিল আজও একটি আকর। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভারতের সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলায় তিনি ছিলেন সক্রিয়।
এই সূত্রে, স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিভিন্ন সংকটকালে রেহমান সোবহানের ভূমিকা স্মর্তব্য। আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের কর্ণধার হয়েও তিনি আশির দশকের দ্বিতীয় ভাগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জুগিয়েছেন সুনির্দিষ্ট উপাদান। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের (১৯৯০-৯১) সদস্য হিসেবে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ছিলেন যুক্ত। আবার ১৯৯৫-৯৬ সালে নির্বাচন নিয়ে দেশে পুনরায় যখন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন আরও চার বিশিষ্ট ব্যক্তিকে (কথিত পঞ্চপাণ্ডব) নিয়ে দুই নেত্রীর মাঝে সমঝোতা সৃষ্টিরও চেষ্টা করেন। দেশে গণতন্ত্রের স্থিতিশীল প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং মৌল মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর সোচ্চার চেষ্টাটি আজও অব্যাহত আছে।
একজন সফল প্রতিষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে রেহমান সোবহানের পরিচয়ও যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য। এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম উদাহরণ হচ্ছে দুটো—বিআইডিএস ও সিপিডি। বিআইডিএসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রায় দুই দশক, যার মধ্যে মহাপরিচালকই ছিলেন ছয় বছর (১৯৮৩-৮৯)। তাঁর নেতৃত্বে বিকাশমান দেশগুলোর মাঝে উন্নয়ন অর্থনীতি চর্চার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় বিআইডিএস। তাঁর সময়ে পরিচালিত গবেষণাগুলো সে সময় অনুসৃত বিভিন্ন নীতি সংস্কারের উদ্যোগকে বস্তুনিষ্ঠভাবে মূল্যায়ন করে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নীতি পর্যালোচনাগুলো হলো শিল্প খাতে বিরাষ্ট্রীকরণ, কৃষি উপকরণ বিতরণব্যবস্থা শিথিলকরণ, শিল্পঋণ বিতরণ উদ্যোগ ইত্যাদি।
তবে ১৯৯৩ সালে সিপিডির প্রতিষ্ঠায় রেহমান সোবহানের ভিন্ন চিন্তা কাজ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা থাকাকালে তিনি দেশের আর্থসামাজিক রূপান্তরের এক বিস্তৃত রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশের আড়াই শর ওপর কৃতবিদ্য পেশাজীবীকে নিয়ে ২৯টি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে তিনি এই বিরাট কর্মযজ্ঞে ব্যাপৃত হন। বাংলাদেশের উন্নয়নচিন্তাকে অনুধাবন করতে হলে চার খণ্ডে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনগুলো অবশ্যপাঠ্য। তবে সেই উদ্যোগের ফলাফল নির্বাচনোত্তর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে খুব একটি আকর্ষণ করতে পারেনি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক সোবহান এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে একটি উন্নত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার জন্য সব অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে ধারাবাহিক আলোচনার প্রয়োজন আর সে জন্য প্রয়োজন একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৩ সালে জন্ম লাভ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বিগত তিন দশকে রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে ও প্রেরণায় সিপিডি স্বকীয় অবদানে জাতীয়ভাবে একটি মর্যাদাপূর্ণ আসন অর্জন করেছে। সিপিডিতে কর্মজীবন শুরু করা বহু পেশাজীবী এখন দেশ–বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন।
বাংলাদেশে অর্থনীতিচর্চায় রাজনৈতিক-অর্থনীতি (পলিটিক্যাল ইকোনমি) বিশ্লেষণী কাঠামো সর্বোত্তম অনুশীলন করেছেন রেহমান সোবহান। রাজনীতি যে অর্থনীতির ঘনীভূত প্রকাশ—এই উপলব্ধিকে আত্মস্থ করেছেন তিনি গভীরভাবে। তাই প্রতিটি আলোচনার শেষে তিনি সর্বদা প্রশ্ন রেখেছেন, উন্নয়নের সুফল কি বঞ্চিত মানুষের পক্ষে গেল, নাকি ক্ষমতার প্রতিষ্ঠিত বিন্যাসকে আরও জোরদার করল? তাঁর মেধা ও জ্ঞানচর্চা বাংলাদেশের মনন গঠনে অনপনেয় ছাপ রেখেছে। তরুণ মুষ্টিযোদ্ধা রেহমান সোবহান তাঁর ‘লড়ে যাওয়া’ মনোভাবটি সর্বদা অক্ষুন্ন রেখেছেন। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন যখন ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’দের কথা লেখেন, তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রেহমান সোবহানের ছবি ভেসে ওঠে।
বহু বিচারে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের প্রধান পরিচয় তিনি একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক। কেমব্রিজ প্রত্যাগত এক তরুণ প্রভাষকের যাত্রা শুরু ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। তবে একজন শিক্ষকের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়কে অতিক্রম করে, প্রাচ্য প্রথায়, তিনি হয়ে ওঠেন একজন ‘গুরু’। বাংলাদেশের কয়েক প্রজন্মের অর্থনীতিবিদদের হাতে খড়ি হয়েছে তাঁর কাছে। পেশাগত উৎকর্ষের পাশাপাশি তিনি তাঁদের শিখিয়েছেন সামাজিক দায়বদ্ধতা বোধ। উদ্বুদ্ধ করেছেন অর্জিত জ্ঞানকে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রয়োগ করতে। তাই সচেতন জনমানুষের কাছে রেহমান সোবহান একজন নীতিনিষ্ঠ দেশপ্রেমিক সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে প্রতীয়মান।
রেহমান সোবহানের সবচেয়ে বড় পরিচয় মনে হয়, তিনি একজন জনসম্পৃক্ত বুদ্ধিজীবী (পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল)। একদিকে শিক্ষকতা, গবেষণা ও অর্থনীতি চর্চা দিয়ে পারিপার্শ্বিকতাকে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন, অপরদিকে চারপাশের ঘটমান বিষয়াবলিকে বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থকে জ্ঞানচর্চায় প্রতিফলিত করেছেন। তিনি তাই ভূমিসংস্কার, কৃষি খাতে সমবায় গঠন থেকে তৈরি পোশাকশিল্পে সামাজিক মালিকানা নিয়ে চিন্তিত থাকেন। সে অর্থে তিনি বনেদি বিত্তশীল পরিবারের সদস্য হয়েও মনোজগতে শ্রেণিচ্যুত (ডিক্লাসড)।
সার্বিক বিচারে অধ্যাপক রেহমান সোবহান একজন রেনেসাঁ ব্যক্তিত্ব। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর তিন খণ্ডের স্মৃতিকথা পাঠ করলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে আমরা পাই তাঁর ঘটনাবহুল জীবনকে ছাড়িয়ে তৎকালীন বিষয়াবলির অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যাখ্যা। একই সঙ্গে উন্মোচিত হয় এই বহুমাত্রিক ব্যক্তিটির সাহিত্য, সংগীত ও কলাপ্রীতি। প্রকাশ পায় তাঁর রসবোধ এবং জীবনতৃষ্ণা।
আমার বিশ্বাস, এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তির জীবন ও জগৎ থেকে উপলব্ধি সঞ্চয় করে বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম আরও আলোকিত ও অনুপ্রাণিত হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বিশেষ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ